ফুটবল শুধু খেলা নয় এ এক ভালোবাসার অন্য নাম। ছেলেবেলায় ছোট্ট প্লাস্টিকের বল দিয়ে শুরু করে শৈশব, কৈশোর, যৌবন এমন কী জীবনের শেষ দিন অবধি মানুষের অবাধ্য ভালোবাসার নাম ফুটবল। আর কলকাতা ময়দান এর মোহনবাগান গ্যালারির সামনে আসলেই চোখে চশমা, পাতলা ঠোঁটের যে মানুষটাকে দেখতেই পাবো বলে জানতাম তিনি আর কেউ নয় আমাদের প্রিয় অর্জুন দা।
আজ অর্জুনদা তার জীবনের ৯০ মিনিটের খেলা শেষ করে সাজঘরে ফিরে গিয়েছেন। না চোখে জল এনে তাঁর সম্মান কম করব না। তিনি আমাদের হাসতে শিখিয়েছেন, তিনি আমাদের মোহনবাগান কে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। তিনি বুঝিয়েছেন কিভাবে রক্তের প্রতিটি কণায় কণায় সবুজ-মেরুন কে মিশিয়ে দিতে হয়। তিনি শিখিয়েছেন একটা বড় দল কে বড় করে তোলে তার সমর্থকরা।
যারা চিনতেন অর্জুন দা কে তারা জানতেন তাঁর নাম আসলে অর্জুন নয়। তাঁর নাম ‘মোহনবাগান গাঙ্গুলী’। যারা স্কুল পড়ুয়া, যাদের যুবভারতীতে, কল্যাণী, বারাসাত ও রবীন্দ্র সরোবরের স্টেডিয়ামে টিকিট কেটে ঢোকার আর্থিক সামর্থ ছিল না, তাদের কাছে অর্জুনদা ছিলেন ‘মোহন বাগানের’ দেব দূত। তিনি একটাই কথা বলতেন -“আরে আমি বেঁচে আছি এখনো ” । টিকিট না পেয়ে হতাশ মানুষ গুলো জানতেন এই একটা মানুষই মাঠে ঢোকার আগে ঠিক তাদের হাতে ঠিক টিকিট তুলে দেবে। আর এ ঘটনা হামেশাই চোখে পড়তো মাঠে গেলে।
তিনি বলতেন আরে রক্তের সম্পর্ক থাকলেই আত্মীয় হয় না। আত্মীয় মানে আত্মার যোগাযোগ। তোর আত্মায় মোহন বাগান আমার আত্মায় মোহন। আমরা চির জনমের আত্মীয়। আমাদের বড় পরিচয় আমরা মোহনবাগান সমর্থক। পরিবারের দ্বায়িত্বশীল দাদা যেমন কোথাও গেলে সকল কে সঠিক ব্যবস্থা না করে ক্ষান্ত হতো না, ঠিক তেমনি বন্ধু, ভাই, কাকা, জ্যাঠা যেইই অর্জুনদার সাথে থাকুক না কেনো তিনি তাদের সবাইকে সদস্য গ্যালারিতে না ঢুকিয়ে নিজে ঢুকতেন না। তিনি ভালোবাসার জোরে মোহনবাগান ক্লাবের সদস্য হয়েছিলেন। তাঁর একটাই দাবি ছিলো-” তোরা খেলা না দেখলে মোহনবাগান জিতবে কি করে বল তো? “
তিনি মোহনবাগান রথে চড়া অর্জুন। কেউ যদি ফোন করে বলতো “দাদা একটা সদস্য কার্ড করিয়ে দিতে হবে ! ” তাঁর প্রশ্ন ছিল ‘মোহনবাগান সমর্থক তো?’ উত্তর ‘হ্যাঁ’। ব্যাস,ফোনের অপার থেকে আশ্বাস বাণী শোনা যেত-“চিন্তা করিস না”। হ্যাঁ সত্যিই তাঁর কাছে আসা তাঁর সংস্পর্শে আশা মানুষ গুলো খুব নিশ্চিন্ত থাকতো। তিনি ময়দানে আসা প্রত্যেকের কাছেই অক্সিজেন ছিলেন। চাপের ম্যাচ বা নিয়ম রক্ষা। তাঁর টানেও প্রচুর সমর্থক মাঠে আসতো। মোহনবাগান দলের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।


শুধু ফুটবল, শুধু মোহনবাগান বা শুধু আর্জেনটিনা বা শুধু মেসি নয় , তিনি সব সময় বলতেন মাঠে আড্ডা দাও। এর থেকে হেলথি ডায়েট আর কিছু নেই। আর সকলের সাথে মাঠে দেখা হলেই সবসময় হাঁসি মুখে বলতেন “জয় মোহনবাগান” কী রে কেমন আছিস? বিকালে নিয়মিত মাঠে আড্ডা দিতে ভুলিস না যেনো।
উল্লেখ্য, খেলার প্রতি তাঁর এতটাই ভক্তি ছিল যে এ বছর আইলিগে মিনার্ভার সাথে অ্যাওয়ে ম্যাচের দিন গোল হচ্ছিলো না। কী করেন তখন। পাশেই বসে ছিল আমাদেরই পরিচিত বুবাই। আমরা সকলেই ক্যান্টিনে বসে খেলা দেখছিলাম। বুবই খচ খচ করছিল। তিনি বুবাই কে বের করে দিয়ে বললেন গোল হলে তবেই ঢুকবি ক্যান্টিনে। মোহনবাগান গোল শোধ করার পর বুবাই কে ডেকে নিয়ে এলেন। এরকম শিশুসুলভ রাগ, অভিমান আর ভালোবাসায় ভরা মানুষটার ‘মোহনবাগান’ দলের প্রতি এই আনুগত্য আর গভীর অনুরাগ দেখে প্রত্যকেই তাঁকে মনের ভেতর থেকে ভালবেসে ফেলেছিল।
মাঠে কারকেই কোনো দিন খাবারের টাকা দিতে দেন নি। যদি দেখতেন মোহনবাগান মাঠে কেউ কোনো খাবার খাচ্ছে, তখনও খাওয়া শেষ হয় নি তার , দাদা এসে খাবার নিলেন, ” জয় মোহনবাগান ” বলেই জিজ্ঞাসা করলেন- ” কি রে কেমন আছিস ? যা তোকে টাকা দিতে হবে না , আমি দিয়ে দিচ্ছি “।
মোহনবাগানের খেলার দিন , মোহনবাগান জিতলে , খেলার শেষেই কলকাতার বিভিন্ন দোকানে কখনো ৪ জন কোনো কোনো দিন ৫ জনের একটা বিশেষ বন্ধুদের দল, যারা সবাই ক্লাব সদস্য, সবাই একসাথে বসে খেলা নিয়ে আড্ডা চলতো অনেক রাত পর্যন্ত। সাথে থাকতো লজ্জা না করে যাচাই খাবার। এ বছর আই লীগ জেতার দিন, সেই সদস্য সংখ্যা টা বেড়ে হয়েছিল ৮ জন । আমরা প্রায় রাত ১ টা অবধি বিজয় উৎসব পালন করে বাড়ি ফিরেছিলাম। আজ ভাবতেই অবাক লাগছে দাদা আর আমাদের মধ্যে নেই। আজ এই অনুভুতি টা অনেকটাই মোহনবাগান দলের হেরে যাওয়ার মত। বার বার চোখে ভেসে উঠেছে তাঁর সেই হাসি মুখ। কোমরে দু হাত রেখে তদারকি করতে থাকা, গোলের উত্তেজনায় বাচ্চাদের মত লাফিয়ে লাফিয়ে আনন্দ করা।
বারাসাতের জামাই ছিলেন তিনি। তাই বারাসত এলে অনেক সমর্থক ও সদস্য কে ফোন করেডেকে নিতেন। চা-সিঙ্গাড়া খেতে খেতে অনেক আড্ডা হতো। আজ ও মনে পড়ে যাচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবলের গ্যালারিতে হাতে মোহনবাগানের পতাকা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দাদা কে। সদস্য আসবে যাবে কিন্তু অর্জুন “মোহনবাগান’ গাঙ্গুলী আর হয়তো আসবে না। ভগবান রেফারিরর ভুল সিদ্ধান্তে দাদা আজ এই জীবন মাঠের বাইরে। এই ক্ষত কিভাবে সেরে উঠবে জানি না। শুধু জানি এই টুকু ‘জয় মোহনবাগান’ এই ধ্বনিতে চিরদিন বেঁচে থাকবেন আমাদের সবার প্রিয় ময়দানের অর্জুন দা।