তাঁর এখন ‘মন-মেজাজ ভাল নেই’। পায়ের কম-বেশি সমস্যা তো সেই ১৯৫২ সাল থেকেই। তখনও ২৪ পরগনা ভেঙে দু’টুকরো হয়নি। ওই সময় ২৪ পরগনা জেলা ফুটবল লিগ ছিল জমজমাট। কলকাতার বড় দলের অনেক তারকাই খেলতেন ২৪ পরগনা জেলা ফুটবল লিগে। ওই লিগে সনৎ শেঠ খেলতেন নিজের পাড়ার ক্লাব পানিহাটি স্পোর্টিংয়ের হয়ে। ওঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু কেষ্ট পালের দল ছিল শ্যামনগর যুগের প্রতীক। সেবার ওই ২৪ পরগনা জেলা লিগে ওই দুই দলের খেলায় কেষ্ট পালের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষে পায়ে গুরুতর চোট পান সনৎ শেঠ। চোট সারিয়ে পরে দীর্ঘদিন ফুটবল খেললেও তখন থেকেই ডান পা বাঁকা। খেলতে খেলতে তারপরও টুকটাক পায়ে চোট পেয়েছেন। সেসব উপেক্ষা করেই খেলে গিয়েছেন, গোলকিপিং করেছেন বছরের পর বছর, ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত। কিন্তু বার্ধক্যে পৌঁছে পায়ের সেই সমস্যা বড্ড বেশি ভোগাচ্ছে। অনেক বছর হয়ে গেল, ক্রাচকে সঙ্গী করেই তিনি বেঁচে আছেন। ক্রাচ বা অন্য কারও সাহায্য ছাড়া হাঁটা তো দূরের, দাঁড়াতেই পারেন না। পানিহাটির বাড়িতে বন্দি। ৮৭ বছর বয়সে পৌঁছে, একদা হাসিঠাট্টা-গানবাজনা-মজায় মেতে থাকা মানুষটির এখন উপলব্ধি, ‘একসময় বেঁচে থাকতে ভাল লাগত। জীবনটা উপভোগ করতে চাইতাম। কিন্তু এখন আর ভাল লাগে না। এভাবে প্রায় মরে গিয়ে কে বেঁচে থাকতে চায়? আমার জন্য অন্যরা কষ্ট পাচ্ছে। এভাবে সবাইকে কষ্ট দেওয়ার কোনও মানে নেই।’


সাম্প্রতিক সময়ের দু’টি মৃত্যুও ওঁর ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলেছে। বলছিলেন, ‘চুনী, প্রদীপও চলে গেল! বয়সে একটু জুনিয়র হলেও একসঙ্গে খেলেছি। চুনী অনেকটাই জুনিয়র ছিল। ঘরে বসে খবর শুনছিলাম। চুনীর মৃত্যুর খবর শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।’ গত বছর মে মাসে স্ত্রীর মৃত্যুর পর এখন পুত্র, পুত্রবধূ ও দুই নাতনিকে নিয়ে সংসার।
১৯৪৯ থেকে ১৯৬৮, টানা ২০ বছর কলকাতার মাঠে চুটিয়ে ফুটবল খেলেছেন। বিভিন্ন সময়ে ইস্টার্ন রেল, এরিয়ান, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের গোলরক্ষা করেছেন। তারই মাঝে খেলেছেন বাংলা, ভারতের হয়ে। ১৯৫৪-র ম্যানিলা এশিয়ান গেমসে ভারতীয় দলে থাকলেও প্রথম একাদশে সুযোগ পাননি। খেলেছেন তখনকার চতুর্দলীয় প্রতিযোগিতায় পরপর দু’বার ভারতের হয়ে। ১৯৫৫-য় রাশিয়া সফরেও গিয়েছিলেন।


বাড়িতে বন্দিজীবনে মনে পড়ে অনেক সতীর্থর কথা। যাঁদের কেউ কেউ এখনও বেঁচে, অনেকে প্রয়াতও। বলছিলেন, ‘বদ্রুর (সমর ব্যানার্জি) সাথে অনেকদিন দেখা, কথা হয় না। আগে যখন মাঠে যেতাম, গল্প করতাম। বলরামকেও কতদিন দেখিনা। বলরাম খুব ভাল মানুষ। আমেদ, সাত্তার, মান্নাদারা তো বেঁচে নেই! ওরা বয়সে আমার চেয়ে বড় ছিল। তবু ওদের সঙ্গে আমার কত স্মৃতি।’ পুরনো দিনের স্মৃতিতে ডুবে বললেন, ‘ভাল খেলে যেমন প্রশংসা পেয়েছি। আবার ইট-পাটকেলও খেয়েছি। ওভাবেই সনৎ শেঠ হয়ে উঠতে পেরেছিলাম। নিজেকে আমি সবসময় মাঠের মালি মনে করতাম। মাঠকে ভালবাসতাম। এখন তো আর মাঠে যেতেই পারি না! ভেটারেন্স ক্লাবের এক অনুষ্ঠানেই মনে হয় শেষ মাঠে যাওয়া। সেটাও অনেক বছর আগে।’
পায়ের সমস্যা ছাড়া ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা গোলকিপার সনৎ শেঠের অন্য কোনও রোগ নেই। স্মৃতি শক্তিও প্রখর। টুকটাক যেটুকু সমস্যা তা বয়সের কারণে। যেমন এককথা বারবার বলে ফেলেন। ফোনে কথা বলতে বলতে সেটা টের পাচ্ছিলাম। পাশাপাশি টের পেলাম, এখনও তাঁর সঙ্গীত প্রীতি রয়েছে। কথা বলতে বলতেই গান গাইতে শুরু করলেন। বিছানায় বসে বা শুয়ে এখনও নিয়মিত গান শোনেন। গান শুনতে শুনতে নিজেও গলা মেলান। টিভিতে খেলা দেখেন। আবার কখনও রেডিওয় খেলার ধারাভাষ্য শোনেন। সনৎ শেঠ বললেন, ‘ওঠাবসায় সমস্যা। টিভি চালানোর জন্য উঠতে পারি না। বৌমা, নাতনিরা চালিয়ে দেয়। ছেলে, বৌমা, দুই নাতনি সবসময় আমার যত্ন নেয়। কিন্তু ওদেরও তো কাজ আছে। তাই সবসময় ডাকতে চাই না। তখন হাতের সামনে থাকা রেডিও চালিয়ে নিই।’