প্রায় তিন দশক আগের ঘটনা। এক ভদ্রমহিলা তাঁর বছর দশেক বয়সের অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে ফেয়ারলি প্লেস থেকে হাওড়ার লঞ্চে উঠেছেন। ছেলের চিকিৎসার জন্য ভেলোর যাওয়ার ট্রেন ধরার তাড়া। মা-ছেলের পোশাকেই বোঝা যাচ্ছিল বিশেষ সচ্ছল পরিবারের নয়। লঞ্চ হাওড়ার জেটিতে পৌঁছতে না পৌঁছতেই তাড়াহুড়ো করে লাফিয়ে নামতে যান ছেলেকে নিয়ে। বাচ্চাটি পড়ে যায় জলে। ওই লঞ্চেই ছিলেন ভারতের বিশিষ্ট সাঁতারু সুরজিৎ ঘোষ। সঙ্গে সঙ্গেই তিনিও জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ছেলেটিকে তুলে আনেন।
বাচ্চাটি তখন আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। প্ল্যাটফর্মে যেতে যেতে সুরজিৎ লক্ষ্য করেন ছেলেটির অবস্থা ক্রমশঃ আরও খারাপ হচ্ছে। তিনি ওর মা-কে বলেন, ‘এই অবস্থায় ভেলোর নিয়ে যাবেন না। ট্রেনে অবস্থা আরও খারাপ হলে সমস্যায় পড়বেন। চলুন আমি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।’ এরপর সুরজিৎ ওকে নিয়ে হাওড়া জেনারেল হাসপাতালে যান। সেখানকার হাল খারাপ দেখে নিয়ে যান পাশের এক নার্সিং হোমে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। চিকিৎসার সব খরচ দেওয়াই শুধু নয়, কয়েকদিন পর ছেলেটা একটু সুস্থ হলে নিজের টাকায় মা-ছেলের ট্রেনের টিকিট কেটে দিয়ে ভেলোর পাঠানোর ব্যবস্থাও করেন। আরও ৫ হাজার টাকাও দিয়ে দেন ভদ্রমহিলার হাতে।
এই ঘটনার বছর পনের পর, ২০১৬ সালের একদিন কয়লাঘাটে ইস্টার্ন রেলের অফিসে এসে সুরজিৎ দেখেন এক মহিলা ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য বসে আছেন। কী ব্যাপার? কথা বলে জানতে পারেন, এই সেই মহিলা যাঁর ছেলেকে জল থেকে তুলেছিলেন সুরজিৎ। পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন ভেলোরে। মা-র কাছ থেকে জানতে পারেন, সেই ছেলেটি ডাক্তারি পাস করে সুইডেনে থাকে। কয়েকদিন আগে খবরের কাগজে সুরজিৎ-কে নিয়ে একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। সেই লেখা থেকেই ভদ্রমহিলা জানতে পেরেছিলেন, সুরজিৎ ওখানে চাকরি করেন। তাই দেখা করতে আসা, কৃতজ্ঞতা জানাতে। মাঝে অনেক চেষ্টা করেও তিনি সুরজিতের খোঁজ পাননি। যাই হোক, সুরজিতের উদ্ধার করা ‘সেই ছেলে’ এখন ডাঃ অভিরূপ সরকার, লন্ডনে থাকেন।
আচমকা জলে পড়ে যাওয়া, স্নান করতে নেমে ডুবে যাওয়া, আত্মহত্যার জন্য জলে ঝাঁপ দেওয়া, এরকম কত মানুষকে সুরজিৎ উদ্ধার করেছেন তার হিসেব নেই। সুরজিৎ বলছিলেন, ‘ওভাবে তো হিসেব রাখিনি। তবে পঞ্চাশের কাছাকাছি নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু সবাইকে জীবন্ত অবস্থা্য় তুলতে পারিনি। কয়েকজন মারা গেছে জলেই। কয়েকজন পরে।’ লঞ্চ থেকে জলে ঝাঁপিয়ে একবার এক মহিলাকে বাঁচিয়েও কিছু মানুষের হাতে মার খেতে এবং কয়েক ঘণ্টা পুলিশ লকআপে থাকতে হয়েছিল সুরজিতকে। সেটাও অফিস শেষে ফেয়ারলি প্লেস থেকে লঞ্চে হাওড়া যাওয়ার পথে।
এক মুসলিম ভদ্রমহিলা শিশু কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন ওই লঞ্চে। ভদ্রমহিলা বারবার পানের পিক ফেলতে লঞ্চ থেকে মাথা বাড়াচ্ছিলেন বাইরে। বৃষ্টির সন্ধ্যায় পা পিছলে পড়ে যান জলে। সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দেন সুরজিৎ। স্রোতের জন্য কিছুতেই মহিলাকে টেনে নিয়ে পাড়ে আসতে পারছিলেন না। স্রোতের টানে ক্রমশঃ ওয়াটগঞ্জের দিকে চলে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত পাড়ে ওঠার সুযোগ পান ওয়াটগঞ্জ থানার কাছাকাছি গিয়ে। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। মহিলা ততক্ষণে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁকে স্থানীয় লোকেরা হাসপাতালে নিয়ে গেলেও সুরজিৎ-কে মারতে শুরু করেন। অভিযোগ কোনও অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। কাছেই থানা। পুলিশ এসে সুরজিৎ-কে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে পুলিশও সুরজিতের কথা না শুনে মারতে মারতে লকআপে ঢুকিয়ে দেয়।
পরে হাসপাতালে ওই মহিলার বক্তব্য শুনে পুলিশ অবশ্য ছেড়ে দিয়েছিল সুরজিৎ-কে। তখন অনেক রাত। কোনওভাবে একটা ট্যাক্সি ধরে ওই মহিলাকে নিয়েই হাওড়ায় ফিরে আসেন সুরজিৎ। মহিলা তখনও জানেন না, তাঁর শিশু কন্যা কোথায়? হাওড়ায় পৌঁছে দেখেন তাঁর মেয়ে স্টেশনের সামনে বসে কেঁদে চলেছে। মা-কে মেয়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পর ট্রেন বা অন্য কোনও গাড়ি পাওয়ার উপায় ছিল না। সেই রাতে হাঁটতে হাঁটতে বালির বাড়িতে ফিরেছিলেন সুরজিৎ। এরকম আরও অনেক ঘটনা রয়েছে ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করতে সুরজিতের জলে ঝাঁপ দেওয়া নিয়ে। শুধুই কি জলে ঝাঁপিয়ে মানুষ উদ্ধার? কতরকম সামাজিক কাজের সঙ্গেই তো জড়িয়ে আছেন একসময় ভারতের হয়ে সোনার পদক জেতা সাঁতারু।
এই তো করোনাকালে লকডাউনের সময় ছিলেন ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে। কীভাবে পরিযায়ী শ্রমিকরা দলে দলে অসহায় অবস্থায় বাড়ি ফিরেছিলেন, সে ছবি তো সবাই দেখেছেন। জাতীয় সড়ক দিয়ে দলে দলে যখন ওঁরা ঘরে ফিরছেন, টানা এক মাস ২০ দিন নিজের গাড়িতে শুকনো খাবার ও জলের বোতল নিয়ে হাজির হয়েছেন সুরজিৎ। ওঁদের হাতে তুলে দিয়েছেন সেই খাবার, জলের বোতল। পুরোটাই নিজের খরচে, নিজের উদ্যোগে। কোনও সংগঠনের ব্যানারে নয়।
করোনাকালেই তো আমরা দেখেছি, দরিদ্র পরিবারের অসুস্থ এক শিশুর অস্ত্রোপচারের জন্য সাঁতারু-বন্ধু মইনের সহায়তায় তিন লক্ষ টাকা জোগাড় করে দিতে। পুরুলিয়া, বর্ধমান, বাঁকুড়ায় দরিদ্র, অনাথ শিশুদের জন্য নানা কাজ করে চলেছেন অনেকদিন ধরেই। ওদের লেখাপড়ার খরচ, জামা-কাপড় কিনে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। এই কাজে এখন অবশ্য আরও দু’জনকে পাশে পেয়েছেন। আর বালিতেই আছে ওঁর ‘প্রয়াস’। এই সংস্থার কাজ অবশ্য একেবারেই অন্যরকম।
পুরুলিয়া, বর্ধমান, বাঁকুড়ায় দরিদ্র, অনাথ শিশুদের জন্য নানা কাজ করে চলেছেন অনেকদিন ধরেই।
আমাদের বাংলায় ছেলেমেয়েদের খেলাধুলো করার সুযোগ দিনদিন কমে যাচ্ছে। অনেকের খেলার ইচ্ছা থাকলেও ঠিক মতো গাইড করার লোকের অভাব। কাকে দিয়ে কী খেলা হবে, সেটা না বুঝেই পথ চলা শুরু করে দেয় অনেকে। অভিভাবকরাও বিভ্রান্ত হন। ‘প্রয়াস’ সংস্থাটি সুরজিৎ চালান ছোটদের সঠিক পথের খোঁজ দিতে। পুরোপুরি বিনা পারিশ্রমিকে পরামর্শ দেন। অনেক অভিভাবকই ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রাথমিকভাবে বুঝে নিয়ে পরামর্শ দেন। আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা ছেলেমেয়েদের নিজের উদ্যোগেই ভর্তি করে দেন কোনও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। স্বীকৃতি? এই সব ভাল কাজের স্বীকৃতি হিসেব ২০১৬ সালে সুরজিৎ ঘোষ পেয়েছেন বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশন থেকে ‘বিবেক সম্মান’।