(মিখাইল তালকে বলা হয় ‘দি ম্যাজিসিয়ান ফ্রম রিগা’। আজ ৯ নভেম্বর জন্মদিনে দাবার অষ্টম বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে প্রণাম।)


জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী, দুর্বল স্বাস্থ্য। ডান হাতে ছিল মাত্র তিনটি আঙুল। শৈশব থেকে মৃত্যু’র মুখোমুখি— বাড়ি আর হাসপাতাল করেই কেটে গিয়েছে প্রচুর সময়। সাড়ে ৫৫ বছরের জীবনে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতে হয়েছে ২০ বার। সেই ২০টি অস্ত্রোপচারের মধ্যে ছিল ১৯৬৯ সালে একটি কিডনি বাদ দেওয়া। যে ডাক্তার সেই অস্ত্রোপচার করেছিলেন, তিনি পরে জানিয়েছিলেন, অ্যানেস্থেসিয়ার আগে পর্যন্ত অপারেশন থিয়েটারে শুয়ে দাবা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গিয়েছেন। অত বড় একটি অপারেশন নিয়ে তাঁর কোনও মাথাব্যথা ছিল না। এর ১০ বছর আগে বাদ দিতে হয়েছিল অ্যাপেনডিক্স। ১৩ বছর বয়সে ১৯৪৯ সালে প্রথম সিরিয়স কোনও প্রতিযোগিতায় খেলতে নামা। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা শেষ করে উঠতে পারেননি। প্রথম তিনটি গেম জেতার পর প্রতিযোগিতার হল থেকেই নিয়ে যেতে হয়েছিল হাসপাতালে। বাকি গেমগুলো আর খেলা হয়ে ওঠেনি। এতটা শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেই চালিয়ে গিয়েছেন দাবা খেলা। শুধু চালিয়ে যাওয়াই নয়, হয়েছিলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নও। তিনি মিখাইল তাল।
দাবার অষ্টম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন মিখাইল তালকে বলা হয়ে থাকে ‘দি ম্যাজিসিয়ান ফ্রম রিগা’। তিনি দাবা মহলে পরিচিত ‘মিশা’ (Misha) নামেও। ১৯৬০ সালে মস্কোয় মিখাইল বটভিনিককে (Mikhail Botvinnik) হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তাল। ২৪ গেমের লড়াই। সেবার নিয়ম ছিল, ১২-১২ পয়েন্টে খেলা শেষ হলে খেতাব আগের চ্যাম্পিয়নের দখলেই থাকবে। বটভিনিককে সেই সুযোগ অবশ্য তাল দেননি। ২১ গেমেই খেলা শেষ করে ফেলেছিলেন। মিখাইল তাল জিতেছিলেন ১২.৫-৮.৫ পয়েন্টে। তালের জয় ৬, ড্র ১৩। বটভিনিকের জয় ২। সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নজির গড়েছিলেন। ইমানুয়েল লাসকারের ২৬ বছর বয়সে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড ভেঙে মিখাইল তাল ওই খেতাব জিতেছিলেন ২৪ বছর বয়সে। ২৫ বছর ওই রেকর্ড তালের দখলে ছিল। ১৯৮৫ সালে ২২ বছর বয়সে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেই রেকর্ড ভাঙেন গ্যারি কাসপারভ।
১৯৬০ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাবের চ্যালেঞ্জার হওয়ার লড়াইটাও ছিল কঠিন। ১৯৫৯ সালে ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট হয়েছিল ৮ জনকে নিয়ে। তাতে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন মিখাইল তাল, পল কেরেস (Paul Keres), টাইগ্রান পেট্রোসিয়ান (Tigran Petrosian), ভ্যাসিলি স্মাইসলভ (Vasily Smyslov), সেতোজার গিলিগোরিক (Svetozar Gligoric), ববি ফিশার (Bobby Fischer), ওলাফসন (Friorik Olafsson) এবং পল বেঙ্কো (Pal Benko)। সেখানে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বটভিনিকের চ্যালেঞ্জার হয়েছিলেন তাল। ঠিক ১ বছর ৫ দিন তাল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। ১৯৬১-তে বটভিনিকের কাছেই হেরে বিশ্ব খেতাব হারান। সেই লড়াইও হয়েছিল মস্কোতেই। তাল তখন কিডনির অসুখে ভুগছেন। ডাক্তাররা বারণ করেছিলেন খেলতে। তাল শোনেননি। প্রচণ্ড অসুস্থতা নিয়েই খেলতে শুরু করেছিলেন। ২৪ গেমের লড়াইয়ে হেরেছিলেন ৮-১৩ পয়েন্টে। ২১ গেমেই খেলা শেষ। তারপর কখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু তাতে তালের দাবা খেলা বন্ধ থাকেনি।
জীবনের শেষ খেলায় তালের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন গ্যারি কাসপারভ। ১৯৯২ সালের ২৮ মে মস্কোয় সেই ব্লিৎজ টুর্নামেন্টে হাসপাতাল থেকেই তাল খেলতে এসেছিলেন। ওখানে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন কাসপারভ, দ্বিতীয় Evgeny Bareev, তৃতীয় মিখাইল তাল। একটি খেলাতেই হেরেছিলেন চ্যাম্পিয়ন কাসপারভ। সেটা দ্বিতীয় রাউন্ডে তালের কাছে। খেলার শেষে তাল আবার ফিরে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। আর ছাড়া পাননি হাসপাতাল থেকে। এর ঠিক এক মাস পর, ২৮ জুন ওই হাসপাতালেই মারা যান ‘রিগার ম্যাজিসিয়ান’। মৃত্যুর কারণ কিডনি পুরোপুরি অকেজো হয়ে যাওয়া।
মিখাইল তালের জন্ম ১৯৩৬ সালের ৯ নভেম্বর লাতভিয়ার রিগায়। পুরো নাম মিখাইল নেখেমেভিচ তাল (Mikhail Nekhemevich Tal)। বাবা Nehemija Tal ছিলেন সেখানকার নামী ডাক্তার। পাশাপাশি তাঁর ছিল দাবাপ্রেম। শৈশব থেকেই লেখাপড়ায় ভাল ছাত্র মিশা। মাত্র তিন বছর বয়সেই পড়তে শিখে ফেলেছিলেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মুখে মুখে করে ফেলতে পারতেন কঠিন অনেক গুণ-ভাগ। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার অনুমতি পেয়ে গিয়েছিলেন।
আর দাবা শেখা? এখনকার মতো ৩/৪ বছর বয়সে নয়, একটু দেরিতেই। বাবার কাছ থেকে শিখেছিলেন ৬ বছর বয়সে। তখন থেকেই বাবার সঙ্গে নিয়মিত খেলতেন। বাবার চেম্বারে আসা রুগীদের সঙ্গেও বসে যেতেন দাবা খেলতে। তবে সিরিয়াস দাবা খেলা শুরু আরও বছর দুয়েক পরে। এর পেছনেও রয়েছে একটি গল্প। মিশার এক তুতো দাদা এসেছিলেন বেড়াতে। তিনি ভাল দাবা খেলা জানতেন। তাঁর সঙ্গে দাবা খেলতে বসে যান মিশা। মাত্র ৪ চালেই মিশার হার! তারপর আরও পাঁচটি গেম। সব কটিতেই মিশার পরাজয়। পরের দিন আবার ৬ গেমের লড়াই। সেখানেও ৬টিতেই মিশার হার। এটা মেনে নিতে পারেননি মিশা। এবার দাদার কাছে জানতে চান, তিনি কী করে এত ভাল দাবা খেলা শিখলেন? জানতে পারেন, দাদা দাবা খেলেন ওখানকার এক নামী ক্লাবে।
দাদার কাছ থেকে ওটা জানার আগেই পিয়ানোয় অনেকটা পোক্ত হয়ে উঠেছিলেন মিশা। তাঁর যাওয়ার কথা ছিল রিগা প্যালেস অফ ইয়ং পাইওনিয়ার্সে। সেখানকার নাটকের বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্য। সেখানে যাওয়ার পথে মাথায় ঘুরতে থাকে দাদার সেই দাবা ক্লাবের কথাও। নাটকের বিভাগে ভর্তি হবেন কিনা,এটা ভাবতে ভাবতেই ওখানে পৌঁছে যান। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই চোখে পড়ে যায় একটি ঘরের সামনে লেখা ‘চেস সেকশন’। মিশা মত বদলে ফেলেন। নাটকের বিভাগে নয়, ভর্তি হয়ে যান দাবায়। শুরু করে ফেলেন অন্য পথে চলা। তারপর থেকে তো পুরোপুরি দাবা-পাগল। দাবায় পুরোপুরি ঢোকার আগে পিয়ানোর পাশাপাশি মিশার প্রিয় ছিল ফুটবল খেলাও। ছিলেন গোলকিপার। পরেও অবশ্য দাবার পাশাপাশি বেশ কিছু বছর চালিয়ে গিয়েছেন ফুটবল খেলাও। ইউনিভার্সিটি অফ রিগা-র ফুটবল দলের গোলরক্ষাও করেছেন।
১৯৪৮ সালে মিখাইল বটভিনিক প্রথম যখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন, মিশার বয়স তখন পুরো ১২ বছরও হয়নি। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে বটভিনিক রিগাতে এসেছেন জেনেই মিশা চলে গিয়েছিলেন দেখা করতে। আসলে শুধু দেখা করা নয়, ইচ্ছে ছিল বটভিনিকের সঙ্গে একটি গেম খেলারও। বটভিনিক তখন ঘুমোচ্ছিলেন। বটভিনিকের স্ত্রী দেখা করার অনুমতি দেননি। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের বিরুদ্ধে দাবা খেলার স্বপ্নপূরণও সেদিন হয়নি মিশার। আর এটা তো সবার জানাই, সেই বটভিনিককে হারিয়েই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন মিখাইল তাল বা মিশা।
মিখাইল তালের মৃত্যুর ১১ বছর পর, ২০০৩ সালে তাঁর প্রথম স্ত্রী সালি লানদাও (Salli Landau) একটি বই লেখেন, রুশ ভাষায়। প্রিয় মিশাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ। অভিনেত্রী ও গায়িকা সালি লানদাওয়ের সঙ্গে মিখাইল তালের বিয়ে হয় ১৯৫৯ সালে। বিচ্ছেদ ১৯৭০-এ। শুধু ১১ বছরের দাম্পত্য জীবনের কাহিনী নয়, ওই বইয়ে খুব ভালভাবেই ধরা আছে মানুষ মিশাকেও। তিনি লিখেছেন, ‘মিশার জীবন ছিল অগোছাল। যখন কোনও প্রতিযোগিতায় খেলতে যেত, নিজের স্যুটকেসও ঠিকঠাক গোছাতে পারত না।....জানত না টাই পরতে।....বাড়িতে রান্নার গ্যাস কীভাবে জ্বালাতে হয়, সেটাও জানত না। কখনও আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে মহা সমস্যা! প্যানিক তৈরি করে ফেলত। নিজের চা-ও তৈরি করে নিতে পারত না।কখনও চেষ্টা করে যে দেখেনি, তা নয়। পেরে ওঠেনি।....বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর একটা গাড়ি উপহার পেয়েছিল। তা দিয়ে দিয়েছিল ভাইকে। কারণ, নিজে গাড়ি চালাতে জানত না।....কখনও গাড়িতে আমার সঙ্গে কোথাও যাচ্ছে, এমন ভাবে তাকাত যে, মনে হত আমি অন্য গ্রহ থেকে এসেছি। আমি দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করলে ও বিরক্ত হত।....নিজের শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতিও কোনও যত্ন নিত না।’
প্রচণ্ড অসুস্থতার মধ্যেও মদ বা সিগারেট ছাড়েননি। তিনি এত বেশি সিগারেটে আসক্ত ছিলেন যে, লাইটার ব্যবহার করতে হত না। একটা শেষ হওয়ার আগেই সেই আগুনে ধরিয়ে নিতেন আরেকটা। আরও অনেক খেলোয়াড়ের মতো মিখাইল তালেরও সংস্কার ছিল। কী? তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী জানিয়েছেন, ‘যে কোনও প্রতিযোগিতায় একই জামা-প্যান্ট পরে খেলত।’ এ নিয়ে তিনি দু’টি গল্পও শুনিয়েছেন, ‘একবার মালাগায় খেলতে গেছে। টানা অনেকদিন খেলা। আমাকে ২০ বার জামা ধুয়ে দিতে হয়েছিল। কারণ, ওই লাকি জামা ছাড়া সে খেলবে না।.... আমাদের বিবাহ বিচ্ছেদের পরের আরেকটি ঘটনা। ১৯৮৩ বা ১৯৮৪ সাল হবে। ব্রাসেলসে খেলতে এসেছে। নোংরা পোশাক পরা। আমি একটা দোকানে নিয়ে গিয়ে নতুন জামা-প্যান্ট কিনে দিই। পরের দিন সেই নতুন পোশাক পরে খেলে হেরে যায়। এবং সেই হারের জন্য পুরোপুরি দায়ী করে আমাকে।’
প্রচলিত আছে, ‘নো রিস্ক, নো গোইন’। এতে পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল মিশার। প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে যে কোনও ধরনের আক্রমণে যেতেন। সব সময়ই খেলতেন আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে। সাফল্যও পেতেন। দ্রুত চাল দেওয়ায় তিনি ছিলেন ওস্তাদ। দাবার প্রথম সরকারি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন উইলহেম স্টেইনিৎজ মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, ‘আমি দাবা ইতিহাসবিদ নই। কিন্তু দাবা ইতিহাসের একটি অঙ্গ। যা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। আমাকে উপেক্ষা করতে পারবেন না।’ ছন্নছাড়া জীবনধারায় অভ্যস্ত মিখাইল তাল নিজের সম্পর্কে এরকম কথা কখনও বলেননি। কিন্তু ঘটনা হল, বিশ্ব দাবার ঊজ্জ্বল ইতিহাসের অন্যতম সেরা নক্ষত্র হিসেবে মিশাকে কেউ উপেক্ষা করতে পারবেন না। এখনকার অত্যাধুনিক দাবায়ও মিখাইল তাল যে খুবই প্রাসঙ্গিক, তা বোঝা যায় কচিকাঁচাদের হাতে হাতে তাঁর লেখা বই দেখে। তালের মৃত্যুর পর একটি পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘ম্যাজিসিয়ান চলে গেলেন। কিন্তু ম্যাজিক থেকেই গেল, বইয়ের পাতায়। থেকে যাবে অনন্তকাল।’ সত্যি তাই।
জন্ম: ৯ নভেম্বর, ১৯৩৬
মৃত্যু: ২৮ জুন, ১৯৯২