অজিত ব্যানার্জি বনাম স্বপন ব্যানার্জি। একজন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির দাদা, আরেকজন ভাই। অনেকে না-ও জানতে পারেন, বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বি ও এ) নামে আমাদের রাজ্যে একটি সংস্থা আছে। শুধু বাংলায় কেন, সব রাজ্যেই অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন আছে। অন্য রাজ্যে যাচ্ছি না, আমাদের বাংলায় এই সংস্থাটির কী কাজ, ঠিকঠাক বুঝে ওঠা সত্যি কঠিন। বছরের পর বছর অনেক চেষ্টা করেও বুঝে উঠতে পারিনি। ওখানকার কর্মকর্তাদের অতি সক্রিয় দেখা যায়, বি ও এ-র নির্বাচন এলে। অতীতেও ছিল, এখনও তাই। এবারও বি ও এ-এর ভোটের আগে সেই সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে। আর গত কয়েকবছর ধরে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন এলেই মুখ্যমন্ত্রীর দাদা-ভাইয়ের একটা সাজানো বা গটআপ লড়াইয়ের আবহ তৈরি করা। পরে আবার অনেক সময় ওই ‘সাজানো লড়াই’ মুখ্যমন্ত্রীর ধমক বা পরামর্শে মিটেও যায়। ওঁরা দু’জন বহাল তবিয়তে চেয়ারে থেকে যান। অন্য অনেকে বলির পাঁঠা হন। এর আগের নির্বাচনে যা হয়েছিল। এবারও দাদা বা ভাইয়ের প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে নিশ্চিতভাবেই কেউ কেউ ‘বলির পাঁঠা’ হবেন।
যাক ওসব কথা। আসল প্রশ্ন হল, বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের কাজ কী? সত্যি, এতদিনেও বুঝে উঠতে পারিনি। সাধারণভাবে যেটা আমরা জানি, বিভিন্ন অলিম্পিক স্পোর্টসের রাজ্য সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়া হয় বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন। অন্য রাজ্যেও পদ্ধতিটা একই। অন্যভাবে বলা যায়, খেলাধুলোয় রাজ্যে ‘মাদার বডি’। রাজ্যের খেলাধুলোর উন্নয়ণে অনেককিছু করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাদের কখনও এই ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। অতীতেও যেরকম ছিল, এখনও তাই। রাজ্যের খেলাধুলোর উন্নতির কথা যদি ওখানকার কর্মকর্তারা ভাবতেন, তাহলে ন্যাশনাল গেমসে বাংলা এখন কত নম্বরে শেষ করে, সেটা দূরবীণ দিয়ে দেখতে হত না। বি ও এ-র নিজস্ব কোনও পরিকল্পনা নেই। পাশাপাশি তাদের অনুমোদিত রাজ্য সংস্থাগুলোকেও কোনও গঠনমূলক পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করার তাগিদও নেই। কয়েক বছর ধরে নেতাজি সুভাষ রাজ্য গেমস করা হচ্ছে। সেখানেও তো গলদে ভরা। অনেকে বলেন, ওটা ‘পিকনিকের আসর’।


রাজ্য সরকার বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থাকে আর্থিক অনুদান দেয়। সেই টাকা দেওয়া হয় বি ও এ-র মাধ্যমে। কারও কারও অঙ্গভাষা দেখে মনে হয়, টাকা বি ও এ দিচ্ছে। আসলে তা নয়। আর রাজ্য বা জাতীয় প্রতিযোগিতা হলে কিছু অনুদান দেওয়া হয়। এই প্রশ্নটা তো তোলা যায়ই, সেই টাকা সত্যি কি খেলাধুলো বা খেলোয়াড়দের উন্নতির জন্য খরচ হয়? কিছু কিছু রাজ্য সংস্থা অবশ্য করে। কিন্তু অধিকাংশ রাজ্য সংস্থারই ওরকম কোনও পরিকল্পনা নেই। বিশেষ করে খেলোয়াড়দের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় না। এই করোনা-কালে এবং আমফানের জেরে গ্রামগঞ্জের কত ক্রীড়াপ্রতিভা আধপেট খেয়ে দিন কাটিয়েছে। কটা রাজ্য সংস্থা ওদের পাশে দাঁড়িয়েছে? বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন কেন উদ্যোগ নেয়নি? কয়েকটি রাজ্য সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁদের সংস্থা বেশ কিছু খেলোয়াড়কে আর্থিক সাহায্য দিয়েছে। এখানেও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, লুকিয়ে কেন? এক কর্মকর্তা বললেন, ‘আমরা প্রচার চাই না।’ ব্যাপারটা সত্যি কি তাই? পাঁচ টাকা, পঞ্চাশ টাকা বা পাঁচশো টাকা যাই দেওয়া হোক, সেটা প্রকাশ্যে জানাতে অসুবিধা কীসের? আমাদের রাজ্যে ‘কাটমানি’ এখন পরিচিত শব্ধ। এটাও সেই কাটমানির গল্প নয় তো?
বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাদের কাছে যে খেলোয়াড়দের কোনও গুরুত্ব নেই, সেটাও তো বছরের পর বছর আমরা দেখে আসছি। খেলোয়াড়রা গুরুত্ব পান না বি ও এ অনুমোদিত অনেক সংস্থার কাছেও। যে সংস্থার নাম বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, সেই সংস্থার দপ্তরে কেন থাকবে না বাংলার অলিম্পিয়ানদের ছবি? ভারতে প্রথম অলিম্পিক পদক এনেছিলেন তো কলকাতারই এক যুবক, ১৯০০ সালে। বি ও এ দপ্তরে কেন নেই নর্মান প্রিচার্ডের একটা ছবি? বাঙালির প্রথম অলিম্পিকে অংশ নেওয়া ১৯২০ সালে। প্রথম বাঙালি অলিম্পিয়ান পি সি ব্যানার্জির একটা ছবিও কি রাখা যায় না বি ও এ দপ্তরে? নির্বাচন নিয়ে এখন সক্রিয় দাদা-ভাই। বাঙালির অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার শতবর্ষপূর্তি চলে গেল এবার। ভার্চুয়াল একটা অনুষ্ঠানও কি করা যেত না?