নির্মলকুমার সাহা
ট্রেনে শিয়ালদা-গেদে লাইনের আড়ংঘাটা স্টেশন। সেখান থেকে টোটোয় হরিতলা মোড়ে নেমে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই বস্তা মুসলিম পাড়া। ভাগচাষী বজলু মণ্ডলের বাড়ি ওই পাড়াতেই। আড়ংঘাটার ওই অঞ্চলে ফুলের চাষই বেশি। বছরের অধিকাংশ সময় বজলু ও তাঁর ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত থাকেন ফুল চাষেই। এর পাশাপাশি আছে কলাগাছের বাগান, সর্ষে খেত। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিল ও নানা রকম সবজির চাষও হয়। বাবার সঙ্গে চাষের কাজ করা ছাড়াও বজলুর ছেলে বিলাল, দুই মেয়ে সাধনা ও মৌসুমির আরও একটা কাজ আছে। সেটা হল অ্যাথলেটিক্স। সাধনা ও মৌসুমি বাংলার প্রথম সারির ওয়াকার। ওঁদের দাদা বিলালের ইভেন্টও ওয়াকিং। তবে অ্যাথলেটিক্সে নাম বেশি সাধনা আর মৌসুমিরই। তার মধ্যে আবার সাধনা একটু বেশি এগিয়ে। সংসারে লড়াই করেও ওঁরা এগোচ্ছিলেন। করোনা আর আমফানের আগে পর্যন্ত এটাই ছিল ওঁদের জীবনযাত্রার ছবি।
এখন করোনা ও আমফানের জোড়া ধাক্কায় ছবিটা পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। সংসারে দারিদ্র্য থাকলেও ওঁরা হাসিমুখেই আসতেন খেলার মাঠে। কিন্তু সংসারের হাল যদি একটু ভালো হয়, এই আশায় বছরের গোড়ায় বিলাল কাজের খোঁজে চলে যান বেঙ্গালুরুতে। ওখানে গিয়ে ওক হোটেলে কাজ শুরু করেন। ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ তকমা লেগে যায় গায়ে। মাত্র ২২ দিন কাজ করার পর সারা দেশে শুরু হয়ে যায় লকডাউন। অচেনা শহরে অথৈ জলে পড়েন গ্রামের ছেলেটি। হোটেল বন্ধ হয়ে গেলেও, মালিক দয়া করে একটি ঘরে থাকতে দিয়েছিলেন। কিন্তু খাবেন কী? ওদিকে ট্রেন বন্ধ, নিজের রাজ্যে ফিরতেও পারছেন না। কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েন বিলাল। অবশেষে পরিযায়ী শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চালু হলে নিজের জেলা নদীয়ায় ফেরেন ১ জুন। বিধি মেনে ১৪ দিন কোয়ারান্টিনে থাকার পর গ্রামের বাড়িতে ঢোকেন। এই কঠিন অভিজ্ঞতার পর বিলালের সিদ্ধান্ত ঝেড়ে ফেলবেন ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ তকমা। আর বাইরে যাবেন না কাজের খোঁজে। গ্রামের খেতেই চাষ করবেন বাবা-বোনদের সঙ্গে। আবার মন দেবেন অ্যাথলেটিক্সে।
বিলাল ফিরে আসায় বাড়িতে স্বস্তি। কিন্তু আর্থিক অনটন বেড়েই চলেছে। লকডাউনে চাষের কাজ শিকেয় উঠেছিল। তারপর আমফানের ধাক্কা। সাধনা বললেন, ‘করোনা সমস্যা তৈরি করেছিল। আমফান সেই সমস্যা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। কলাবাগানটা পুরো শেষ হয়ে গেছে। আর খেতে ছিল তিল। সব ধুয়ে গেছে। কিছুদিন সময় পেলে ওই তিল উঠে যেত। ওখানে শুরু হত ফুলের চাষ। পুজোর আগে যা উঠত। তিল ধুয়ে যাওয়ার পর খেতে গাঁদা ফুলের চারা লাগানো হয়েছে।’ সাধনা জানালেন, এখন খেত থেকে আয় বলতে কিছুই নেই। পুজোর সময় ফুল উঠবে, তারপর ঘরে পয়সা আসবে। বললেন, ‘ফ্রি রেশন পাচ্ছি। ওটাই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে!’
এত সমস্যার মধ্যেও কিন্তু ওঁরা বাঁচিয়ে রেখেছেন স্বপ্ন। প্রতিদিন নিয়ম করে গ্রামের বাড়ির উঠোনেই সেরে নিচ্ছেন শরীরচর্চা। ট্রেন চালু হলেই যেতে শুরু করবেন বাদকুল্লার অনামী ক্লাবে। আবার শুরু করে দেবেন রঞ্জন দত্তর কাছে অনুশীলন।