লকডাউন শুরুর আগে দল নির্বাচন হয়নি। কিন্তু দুর্গাপুরের অনামিকা গড়াইয়ের এবছর টোকিওয় প্যারালিম্পিকে সুযোগ পাওয়াটা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। করোনা পুরো ছবিটাই বদলে দিয়েছে। ট্রায়াল, দল গড়া কিছুই হয়নি। পিছিয়ে গিয়েছে টোকিওর প্যারালিম্পিক। নতুন সূচি অনুযায়ী হওয়ার কথা ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর। যে কারণে প্যারালিম্পিক পিছিয়ে গিয়েছে, সেই কারণেই জল থেকে এখন অনেক দূরে এই প্যারা সুইমার। দুর্গাপুরের বাড়িতে বসে লকডাউন ওঠার অপেক্ষায়।
আড়াই বছর বয়সে পেটে নানা সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসায় কোনও লাভ হয়নি। ক্রমশ আক্রান্ত হয় হেরেডিটারি মোটর সেনসরি নিউরোপ্যাথিতে। দীর্ঘ চিকিৎসাতেও সেই রোগ আর সারেনি। হাত-পা অবশ হয়ে যায়। হাঁটার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। হুইলচেয়ারই একসময় হয়ে ওঠে সঙ্গী। এখনও চলছে সেভাবেই। ডাক্তারই পরামর্শ দিয়েছিলেন সাঁতার শেখাতে। তাতে চলার ক্ষমতা যদি কিছুটা ফিরে পায়। ওই পরামর্শ মেনেই বাবা-মা ভর্তি করে দিয়েছিলেন দুর্গাপুরের আমাজন সুইমিং ক্লাবে। তখন ওর বয়স বছর পাঁচেক। শুরু থেকেই সাঁতারের প্রতি ভালোবাসা জন্মে যায়। সেই ভালোবাসা আর মনের জোরের কাছে হার মানে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। প্যারা সাঁতারে রাজ্য ও জাতীয় পর্যায়ে পরপর সাফল্য পেতে থাকে। অনামিকা এখন দেশের অন্যতম সেরা প্যারা সুইমার।
প্যারা সাঁতারে ভারতের সবচেয়ে ঊজ্জ্বল নাম প্রশান্ত কর্মকার। কয়েক বছর আগে অনামিকাকে দেখে প্রশান্তর মনে হয়েছিল, ভালো প্রশিক্ষণ পেলে মেয়েটা উন্নতি করতে পারবে। তিনি অনামিকাকে নিয়ে আসেন চুঁচুড়ায় নিজের অ্যাকাডেমিতে। ওখানেই অনুশীলন চলছিল অনামিকার। থাকত ওখানকার হস্টেলে। কিন্তু ২০১৯-এর গোড়ায় প্রশান্তর অ্যাকাডেমি বন্ধ হয়ে যায়। প্রশান্তও চলে যান কলকাতার বাইরে। ফলে অনামিকাকে আবার ফিরে আসতে হয় দুর্গাপুরে। অনুশীলন চলতে থাকে পুরনো সেই আমাজন সুইমিং ক্লাবে, কোচ ত্রিদিব ভট্টাচার্যর কাছে। আর ফোনে পরামর্শ নেয় প্রশান্ত কর্মকারের কাছ থেকে। কিন্তু লকডাউনের জন্য এখন ক্লাবে যাওয়া বন্ধ। বাড়িতে কিছুটা ফিজিক্যাল ট্রেনিং চললেও জলের সঙ্গে আপাতত কোনও সম্পর্ক নেই।
অনামিকার জীবনের সেরা সাফল্য ২০১৮-র জুন মাসে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক প্যারা গেমসে ৬টি পদক জয়। সোনা ১, রুপো ৩, ব্রোঞ্জ ২। এবার টোকিওর প্যারালিম্পিক পিছিয়ে না গেলে ভারতীয় দলে ওর সুযোগ পাওয়া নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন কোচ প্রশান্ত। ফোনে প্রশান্ত বললেন, ‘অনামিকা এখন দেশের সেরা। টোকিওয় নিশ্চিতভাবেই অনামিকা যেত। করোনার জন্য সুযোগ হারাল। সামনের বছর প্যারালিম্পিক হওয়ার কথা। একটা বছর নষ্ট হল। ওকে বলেছি, ফোকাস ধরে রাখতে হবে। লকডাউন উঠলে, সব স্বাভাবিক হলে আবার অনুশীলনে নেমে পড়তে। এমনিতে ও পরিশ্রমী। এবার আরও বেশি পরিশ্রম করতে হবে।’ আর অনামিকা বলল, ‘লকডাউন উঠলেই আবার জোর প্র্যাকটিস শুরু করে দেব। সামনের বছরের প্যারালিম্পিকে শুধু দলে থাকা নয়, আমাকে মেডেল জিততে হবে।’
বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তবু বাবা কিংশুক গড়াই ও মা দোলা গড়াই যতটা পারেন তাঁদের একমাত্র সন্তানের খেলাধুলোর ব্যাপারে পাশে থাকার চেষ্টা করেন। প্রশান্ত চেয়েছিলেন প্রশিক্ষণের জন্য অনামিকাকে বাইরে নিয়ে যেতে। দু’টি কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। এক, আর্থিক সমস্যা। দুই, মা বললেন, ‘বাইরে চলে গেলে লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। এজন্যও আমাদের কিছুটা আপত্তি ছিল।’