ভোর ৪টে ২৫-র বনগাঁ-শিয়ালদা লোকাল চাঁদপাড়ায় আসে ৪টে ৩৪-এ। দীঘা গ্রামের বাড়ি থেকে ১০ মিনিট সাইকেল চালিয়ে এসে সপ্তাহে দু’দিন ওই ট্রেন ধরে সল্টলেকের সাই সেন্টারে অনুশীলনে আসা। সপ্তাহে আরও দু’দিন দুপুরের ট্রেনে এসে বিকেলে ট্রেনিং সাইয়ে। লকডাউন শুরু হওয়ার আগের তিন মাস এটাই ছিল সূচি। করোনায় সাই সেন্টার বন্ধ, ট্রেন চলছে না। গ্রামের বাড়িতে আটকে থাকা অনূর্ধ্ব ১৬ বালক বিভাগে রাজ্য সেরা অ্যাথলিট অতনু রায়ের সূচি অনেক বদলে গেলেও এখনও ভোরে ঘুম থেকে উঠতেই হচ্ছে। সাইয়ে অনুশীলনে আসার বদলে বাড়ি থেকে মিনিট তিনেকের হাঁটা পথ পেরিয়ে বাবার সঙ্গে যেতে হচ্ছে চাষ করতে।
২০১৯ সালে রাজ্য অ্যাথলেটিক্সে উত্তর ২৪ পরগনার হয়ে অনূর্ধ্ব ১৬ বিভাগে ১০০ মিটার হার্ডলসে সোনা জিতেছিল অতনু। মেডলি রিলেতে পেয়েছিল ব্রোঞ্জ। অনূর্ধ্ব ১৬ বালক বিভাগের সেরা অ্যাথলিটের পুরস্কারও উঠেছিল ওর হাতে। গত বছর রাঁচিতে পূর্বাঞ্চল অ্যাথলেটিক্সেও অনূর্ধ্ব ১৬ বিভাগে ১০০ মিটার হার্ডলসে গলায় উঠেছিল সোনার পদক। আর মেডলি রিলেতে জিতেছিল রুপো। অন্ধ্রপ্রদেশে জুনিয়র জাতীয় অ্যাথলেটিক্সেও বাংলার হয়ে অংশ নিয়েছিল। ১০০ মিটার হার্ডলসে পেয়েছিল ষষ্ঠ স্থান। আর এবার তো কোনও প্রতিযোগিতা এখনও পর্যন্ত হয়নি।
বনগাঁয় রুরাল অ্যাথলেটিক্স ডেভেলপমেন্ট অ্যাকাডেমিতে (RADA) অভিজিৎ বিশ্বাসের কাছে একসময় প্রশিক্ষণ নিত অতনু। লকডাউনের তিন মাস আগে থেকে আসতে শুরু করেছিল সাইয়ে কোচ সুশান্ত রায়ের কাছে। সাই হস্টেলে ভর্তির ব্যাপারটাও অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। সব ঠিক থাকলে এপ্রিল মাসে আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে ঢুকে যেতে পারত সাইয়ে। কিন্তু করোনা আপাতত পিছিয়ে দিয়েছে অতনুকে। তবে সাইয়ে না আসতে পারলেও লকডাউন একটু শিথিল হতেই ঢাকুরিয়া হাই স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র অতনু গ্রামের মাঠে বিকেলে টুকটাক অনুশীলন শুরু করে দিয়েছে।
অতনুর বাবা শঙ্কর চন্দ্র রায় ভাগচাষী। করোনা-লকডাউনে আটকে গিয়েছিল চাষের কাজ। সংসারে বাড়ছিল দারিদ্র্য। লকডাউন শিথিল হলেই আবার নেমে পড়বেন চাষের কাজে, এটা ভাবতে ভাবতেই আমফান। যার ধাক্কায় পরিবারে দারিদ্র্য আরও বেড়েছে। টিনের চালের ঘর। আমফানে উড়ে গিয়েছে সেই টিনের চাল। ক্ষতি হয়েছে আরও অনেক। ধানের খেত লণ্ডভণ্ড। আমফানের জন্য ক্ষতির সরকারি সাহায্য এখনও হাতে আসেনি। কোনওরকমে জোড়াতালি দেওয়া হয়েছে ঘরে। অতনু বলছিল, ‘সামনেই ধান ওঠার ছিল। সব নষ্ট হয়ে গেছে। আবার নতুন করে সব করতে হচ্ছে। বাবা একা পারছেন না। তাই আমাকেও যেতে হচ্ছে চাষ করতে। নতুন ধান যতদিন না উঠবে আয় বলতে আমাদের কিছু নেই। বাবার পক্ষে এখন সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।’
একের পর এক ট্র্যাকের ‘হার্ডল’ পার হওয়ার পর এখন সংসারের ‘হার্ডল’ পেরনোর লড়াইয়ে ব্যস্ত অতনু।