তখন কলকাতা ময়দান ছিল অন্যরকম। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ফুটবলের পাশাপাশি গুরুত্ব দিত হকিকেও। তখনকার কর্মকর্তারা হকি নিয়েও ভাবতেন। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের হকি খেলায়ও তখন গ্যালারি থাকত দর্শকে ঠাসা। ১৯৫৮ সালে দিল্লিতে ১৯ ছুঁই ছুঁই বয়সের এক শিখ খেলোয়াড়ের স্টিক-শিল্পে মুগ্ধ হয়েছিলেন জে সি গুহ। তিনি পরের বছর তাঁকে ইস্টবেঙ্গলে খেলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত সমস্যা থাকায় ওই শিখ তরুণ সেবার কলকাতায় খেলতে আসতে পারেননি। জে সি গুহর নজর কিন্তু এড়ায়নি। ওঁকে নিয়ে এসেছিলেন ২ বছর পর ১৯৬১ সালে। তিন মাস কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা আর হাতখরচ ৫০ টাকা, এই চুক্তিতে ১৯৬১ সালে ইস্টবেঙ্গলে খেলতে এসেছিলেন যোগিন্দার সিং। নর্দার্ন রেলের চাকরি ছেড়ে সেবারই যোগ দিয়েছিলেন দিল্লি কাস্টমসে। দু-বছর ইস্টবেঙ্গলে খেলার পর ১৯৬৩-তে মোহনবাগান। তখন হকি মরসুমে তিন মাসের ছুটি নিয়ে দিল্লি থেকে কলকাতায় খেলতে আসতেন। মরসুম শেষে ফিরে যেতেন দিল্লি। ১৯৬৪ সালে ফের ইস্টবেঙ্গলে এবং দিল্লি কাস্টমসের চাকরি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চলে আসা কলকাতায়ও। এই শহরে এসে কয়েকমাস বেকার ছিলেন। হকি লিগ শেষ হওয়ার পর যোগ দেন সাউথ ইস্টার্ন রেলের চাকরিতে। সেই চাকরি সূত্রে ১৯৬৫ থেকে খেলেন বি এন আরের হয়ে। টানা ১৯৭২ পর্যন্ত। পরে হাওড়া ইউনিয়ন, খালসা ব্লুজের হয়েও খেলেছেন। বয়সের ভারে ক্লান্ত ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা রাইট আউট তখন ব্যাক। বয়স হয়ে গিয়েছিল, গতি আগের মতো ছিল না। তবু খেলাটা উপভোগ করতেন পুরোপুরি। দিল্লি ছেড়ে কলকাতায় আসার আগেই খেলে ফেলেছিলেন একটি অলিম্পিকও। তবু দিল্লি নয়, যোগিন্দারের আলাদা টান ছিল কলকাতার ওপরই।
তাঁর এই হকিপ্রেম কীভাবে শুরু? অনেকবার তাঁর কাছ থেকে শুনেছি সেই গল্প, ‘ছোটবেলায় হকি, ক্রিকেট, ফুটবল সবই খেলতাম। বাবার (সজ্জন সিং) প্রথম পছন্দ ছিল হকি। হকিতে আসার প্রথম কারণ এটাই। আর দ্বিতীয় কারণ, বিদেশ ঘোরার প্রবল ইচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই প্লেনে চড়ার খুব শখ। কিন্তু সুযোগ কোথায়? কাগজে দেখতাম, ইন্ডিয়ান হকি টিম মাঝেমধ্যেই বিদেশে খেলতে যায়। আমার মনে হল, হকি খেলাটা ভালভাবে শিখে ইন্ডিয়া টিমে একবার ঢুকে পড়তে পারলেই ঘনঘন বিদেশে যাওয়া যাবে। নিজের কোনও খরচ লাগবে না। প্লেনে চড়াও হবে।’
যোগিন্দারের সামনে প্লেনে চড়ে প্রথম বিদেশ যাওয়ার সুযোগ আসে ১৯৫৯ সালে। গিয়েছিলেন পূর্ব আফ্রিকা সফরে। জাতীয় দলের নতুন খেলোয়াড় যোগিন্দার ওই সফরে করেছিলেন ৮টি গোল। ওই সফরে ২৬টি ম্যাচ খেলে প্রতিটিতেই জিতেছিল ভারত। ভারতের হয়ে শেষ খেলেন ১৯৬৭ সালে মাদ্রিদে, ৮ দেশের আন্তর্জাতিক হকিতে। ভারত ওখানে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। অর্থাৎ ভারতের হয়ে শুরু এবং শেষ দুটোই ভালো যোগিন্দারের।
আন্তর্জাতিক হকি জীবন ৯ বছরের। অবশ্য ওই সময় টানা ভারতীয় দলে থাকতে পারেননি। যেমন খেলেছেন ১৯৬০ ও ১৯৬৪ সালে অলিম্পিকে। প্রথমটিতে রুপো, পরেরটিতে সোনা জিতেছিল ভারত। এশিয়ান গেমসে ১৯৬২-র রুপোজয়ী ভারতীয় দলে থাকলেও ১৯৬৬ সালের সোনাজয়ী দলে ছিলেন না। কখনও কখনও রাজনীতির শিকার হলেও ১৯৬৬-র এশিয়ান গেমসের দল থেকে বাদ পড়েছিলেন একেবারেই অন্য কারণে। শিবির চলার সময় পড়ে গিয়ে আহত হয়েছিলেন। ওঁর সমসাময়িক খেলোয়াড় গুরবক্স সিং কতবার বলেছেন, ‘হকি স্টিকটা যোগিন্দারের কাছে ছিল যেন জাদুদণ্ড।’
একসময় সাউথ ইস্টার্ন রেলের ফরোয়ার্ড লাইনটা ছিল এরকম: মুস্তাক, জি ডি সিং, পিয়ারা, আবদুল হামিদ, যোগিন্দার। ফুটবলে ইস্টবেঙ্গলের পঞ্চপাণ্ডবের মতো ওঁদের বলা হত, সাউথ ইস্টার্ন রেলের হকির পঞ্চপাণ্ডব। যে কোনও দলের কাছে ওই ফরোয়ার্ড লাইন ছিল তখন আতঙ্ক। যোগিন্দারের স্টিকে তখন সূক্ষ্ম শিল্পের ছোঁয়া। সবুজ মাঠে যেন বল আর স্টিক দিয়ে ছবি আঁকতেন। আবদুল হামিদের কাছে শোনা একটি গল্প, ‘যোগিন্দার তো পারলে নিজের দলের খেলোয়াড়দেরও কাটাত। একবার ভিলাই স্টিলের বিরুদ্ধে আমাদের খেলা। প্রথম দিন আমরা গোল পেলাম না, যোগিন্দার স্টিকে বেশি বল রাখার জন্যই। রিপ্লের দিন সকাল থেকে আমরা ওর পায়ে স্টিক দিয়ে মারতে লাগলাম। যাতে মাঠে বেশি দৌড়তে না পারে। ওই মারের চোটে একসময় ও রেগেও গেল। বলল, খেলবে না। আমরা জোর করে মাঠে নামালাম। ফলও পাওয়া গেল। বল নিয়ে অত দৌড়তে পারল না। দু-তিনজনকে কাটিয়েই বল ছেড়ে দিচ্ছিল। ম্যাচটা আমরা জিতেছিলাম তিন গোলে।’
প্রাক্তন খেলোয়াড় ও আন্তর্জাতিক আম্পায়ার সুশান্ত দে অনেক বছর আগে একটি গল্প শুনিয়েছিলেন, ‘১৯৭২-৭৩, আন্তঃ রেল হকি দিল্লিতে। সেমিফাইনালে যোগিন্দারদের সাউথ ইস্টার্ন রেলের বিরুদ্ধে খেলায় আমরা (ইস্টার্ন রেল) এক গোলে এগিয়ে। গোল শোধের জন্য মরিয়া যোগিন্দার জোরে একটা হিট নিল। বল সরাসরি লাগল আমার অ্যাঙ্কেলে। আমি সঙ্গে সঙ্গে মাঠের বাইরে। ম্যাচটা অবশ্য আমরাই জিতেছিলাম ওই এক গোলেই। কিন্তু আমার যা হওয়ার তাই হল। পা ফুলে ঢোল। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই যোগিন্দার লেগে গেল আমার শুশ্রূষায়। লাল রঙের জার্মান ওষুধের একটা টিউব নিয়ে আমার পা মালিশ করল রাত দুটো পর্যন্ত। ওর ওরকম চেষ্টাতেও পরের দিন আমি ফাইনাল খেলতে পারিনি। যোগিন্দারের এজন্য আপসোসের শেষ ছিল না।’ ফাইনাল ম্যাচটা যোগিন্দার দেখেছিলেন সুশান্তর পাশে বসে। ওঁকে সান্ত্বনা দিতে দিতে।
খেলা ছাড়ার পর আম্পায়ারিং করেছেন। এসেছিলেন কোচিংয়েও। ১৯৭২ সালে প্রথম বিভাগে এন আই এস পাসও করেন। জুনিয়র ভারতীয় দলের কোচ হয়েছেন একাধিকবার। ১৯৮৫ সালে জুনিয়র বিশ্বকাপে, ১৯৮৭-তে জুনিয়র এশিয়া কাপে, ১৯৮৮ সালে জুনিয়র ভারতীয় দলের রাশিয়া সফরে। মাঝে ১৯৮৬ সালে ছিলেন জুনিয়র জাতীয় নির্বাচক। ১৯৮৭ সালে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। সেবার বি এন আর এবং ইস্টবেঙ্গল— দু’দলেরই কোচ ছিলেন যোগিন্দার। বেটন কাপ ফাইনালে উঠেছিল ওই দুই দলই। সবসময় হাসিখুশি, প্রাণবন্ত যোগিন্দার ওই অদ্ভুত পরিস্থিতিও সামলে ছিলেন হাসিমুখেই। ফাইনালে বি এন আর হারিয়েছিল ইস্টবেঙ্গলকে, ২-১ গোলে। ওটাই বি এন আরের শেষ বেটন কাপ জয়।
হকির পাশাপাশি ফুটবলটাও অনেকদিন ধরে রেখেছিলেন যোগিন্দার। জন্ম দিল্লিতে ১৯৩৯ সালের ৩ আগস্ট। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে দিল্লিতেই ফুটবল, ক্রিকেট, হকি নিয়ে। ওখানকার লেখাপড়ার পর্ব চুকিয়ে যখন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তখনও চুটিয়ে ফুটবল খেলতেন। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেছেন সর্ব ভারতীয় আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলেও। দিল্লির এস বি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে পড়ার সময়ই খেলাধুলো শুরু করেন। দিল্লির ঘরোয়া হকিতে খেলা শুরু ইনভেডরস ক্লাবের (খালসা ব্লুজের জুনিয়র দল) হয়ে। পুনায় জাতীয় স্কুল গেমসে দিল্লির হয়ে খেলতে যান ১৯৫৫ সালে। খেলার জন্য দিল্লির বাইরে যাওয়া সেই প্রথম। কিডনির অসুখে দীর্ঘদিন ভুগে মারা যান ২০০২ সালের ৬ নভেম্বর। মৃত্যুর আড়াই বছর আগে গার্ডেনরিচে সাউথ ইস্টার্ন রেলের কোয়ার্টার্সে গিয়েছিলাম একটি সাক্ষাৎকার (যা ‘হকি দর্পণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল) নিতে। তিনি তখন অসুস্থ, গৃহবন্দি। কিন্তু ছোটবেলার স্মৃতিগুলো ধুসর হয়ে যায়নি। বলেছিলেন, ‘আমাদের পরিবারের কেউ কখনও খেলাধুলো করেননি। সবাই ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। তবে বাবা হকি খেলার ব্যাপারে খুব উৎসাহ দিয়েছেন। আমি যখন স্কুলে পড়ি, একটা হকি স্টিকের দাম ছিল চার আনা। বাড়ি থেকে কনট প্লেসের স্কুলে গাড়িতে না গিয়ে দৌড়ে চলে যেতাম। টিফিনও একটু কম খেয়ে পয়সা বাঁচাতাম। ওই পয়সা দিয়েই স্টিক, বল, খেলার পোশাক কিনতাম। মা (প্রীতম কাউর) এতে খুব বকাবকিও করতেন।’
অলিম্পিকে একটা করে সোনা ও রুপোর মালিক সেদিন বলেছিলেন, ‘অলিম্পিকে সোনা জয়টা (১৯৬৪) অবশ্যই আমার হকিজীবনের সেরা মুহূর্ত। কিন্তু টোকিওর সোনার দলের চেয়ে রোমের (১৯৬০) রুপোর দলটা অনেক ভালো ছিল।’ তারপর যোগ করেছিলেন, ‘এখন তো ঠেলাওয়ালা, সবজি বিক্রেতা সবাই ট্র্যাকস্যুট পরে। আমাদের সময়ে ট্র্যাকস্যুটের অন্যরকম ইজ্জত ছিল। আমি রোম অলিম্পিকের সময়ই প্রথম ট্র্যাকস্যুট পরি। অশ্বিনীকুমার লন্ডন থেকে বানিয়ে এনেছিলেন। পেছনে বড় অক্ষরে ইন্ডিয়া লেখা ছিল। ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে হারার পর লজ্জায় আর পরতে পারিনি। মনে হয়েছিল, ইন্ডিয়া লেখা ট্র্যাকস্যুট পরার যোগ্যতা আমার নেই।’
জন্ম: ৩ আগস্ট, ১৯৩৯
মৃত্যু: ৬ নভেম্বর, ২০০২