পুরুলিয়া জেলার বলরামপুরের কদমডিহি গ্রামের মেয়ে পিঙ্কি হাঁসদা বাংলার অ্যাথলেটিক্সে এখন পরিচিত নাম। এরই মধ্যে বিভিন্ন ক্রশ কান্ট্রি প্রতিযোগিতায় বেশ কিছু সাফল্য পেয়েছে। ২০১৮ সালে রাজ্য ক্রশ কান্ট্রি প্রতেযোগিতায় অনূর্ধ্ব ২০ বিভাগে (৬ কিলোমিটার) চ্যাম্পিয়ন। গতবছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছে (২০১৯) সিনিয়র রাজ্য ক্রশ কান্ট্রিতেও (১০ কিলোমিটার)। জোড়া সাফল্য পেয়েছিল ২০১৮ সালে গুয়াহাটিতে সারা ভারত জনজাতি স্পোর্টসে। ওখানে ১৪ কিলোমিটার এবং ৩ কিলোমিটারে প্রথম হয়েছিল। জাতীয় ক্রশ কান্ট্রিতে অংশ নিয়েছে তিনবার। ২০১৮-তে গোয়া (অনূর্ধ্ব ২০), ২০১৯ সালে মথুরা (অনূর্ধ্ব ২০) ও এবছরের গোড়ায় তেলেঙ্গানায় (সিনিয়র)। এবছর (২০২০) আরও দুটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। টাটা ২৫কে দৌড়ে মহিলাদের ১০ কিলোমিটারে প্রথম স্থান পেয়েছে। প্রথম হয়েছে আই ডি বি আই ১০ কিলোমিটার দৌড়েও।
পুরুলিয়ার ওই প্রত্যন্ত গ্রামের পিঙ্কি অ্যাথলেটিক্সে আসে দাদা গোবর্ধনকে দেখে। গোবর্ধন প্র্যাকটিস করত পুরুলিয়া শহরে গিয়ে গৌতম চ্যাটার্জির কাছে। দাদার সঙ্গে ওখানে যেতে শুরু করে পিঙ্কিও। একসময় দাদা অ্যাথলেটিক্স থেকে সরে গেলেও পিঙ্কি থেকে যায়। ভোর-রাতে উঠে গ্রামের বাড়ি থেকে ১০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে বাস স্ট্যান্ড। তারপর বাসে ৪০ কিলোমিটার। এভাবেই যেত পুরুলিয়া শহরে গৌতম চ্যাটার্জির কাছে প্রশিক্ষণ নিতে। তিনি মানভুম জেলা ক্রীড়া সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাও। পিঙ্কির খেলাধুলোর ব্যাপারে নানা ভাবে সাহায্য করেন।




পুরুলিয়ায় প্র্যাকটিস করেই একসময় পিঙ্কি রাজ্য দলে ঢুকে পড়ে। কিন্তু আরও ভালো পারফরমেন্সের জন্য ওর দরকার ছিল কলকাতায় আসা। সেই সুযোগ এসে যায় গত বছরের গোড়ায়। মথুরার জাতীয় ক্রশ কান্ট্রিতে অনূর্ধ্ব ২০ মহিলাদের ৬ কিলোমিটারে সপ্তম স্থান পায়। বাংলা দলের ম্যানেজার হওয়ার সূত্রেই পিঙ্কির সঙ্গে পরিচয় হয় প্রাক্তন অ্যাথলিট রেখা চক্রবর্তীর। কলকাতায় অনুশীলনের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য রেখার কাছে অনুরোধ জানায় পিঙ্কি। রেখা বলেন, ‘বাড়িতে কথা বল। তোর মা-বাবার কোনও আপত্তি না থাকলে কলকাতায় আমার বাড়িতে থাকতে পারিস।’ কদমডিহি গ্রামে গিয়ে রেখা ও ওঁর স্বামী (অ্যাথলেটিক্স কোচ দেবনারায়ণ মজুমদার) কথা বলেন পিঙ্কির মা-বাবার সঙ্গে। তারপর পিঙ্কিকে নিয়ে আসেন কলকাতায়। সেই থেকে দেবনারায়ন-রেখাদের বাড়িতেই থাকে পিঙ্কি। ওঁদের কাছেই বিজয়গড়ের মাঠে প্র্যাকটিস। নেতাজী নগরে ওঁদের বাড়িতেই থাকা-খাওয়া, লেখাপড়া। একেবারে বাড়ির মেয়ের মতো। ভালোভাবে অনুশীলন করতে পারছে। বাড়িতে যা পেত না, খেলাধুলো করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ, পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে। ফলে খেলাধুলোয় আরও বেশি মন দিতে পারছে।
এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু করোনা, লকডাউন সমস্যায় ফেলেছে পিঙ্কিকেও। করোনা আতঙ্ক ও লকডাউনের প্রথম ২ মাসও রেখাদের বাড়িতেই ছিল পিঙ্কি। তার আগে অনেক দিন গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয়নি। তাই ৩১ মে পুলিশের অনুমতি নিয়ে, গাড়ির ব্যবস্থা করে গ্রামের বাড়িতে পিঙ্কিকে পাঠিয়ে দেন দেবনারায়ণ-রেখা। ১৪ দিন গ্রামের কোয়ারান্টিন সেন্টারে থাকার পর বাড়িতে মা-বাবার কাছে যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার ফিরে আসবে, শুরু করবে অনুশীলন, এরকমই ঠিক ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক না হওয়ায় সমস্যায় পড়েছে পিঙ্কি। ফিরতে পারছে না কলকাতায়।
পিঙ্কির বাবা বান্টু হাঁসদা ও মা কলাবতী চাষআবাদ করেন। চাষের কাজে হাত লাগাতে হয় ছেলেমেয়েদেরও। সারা বছর অবশ্য চাষের কাজ থাকে না। তখন রাজমিস্ত্রির কাজ। যে কাজ করতে চলে যেতে হয় অন্য জেলায়, কখনও কখনও পাশের রাজ্য ঝাড়খন্ডেও। এভাবেই চার সন্তানকে নিয়ে চালান সংসার। করোনায় তাঁর সংসারেও টান পড়েছে। অনেকদিন বন্ধ থাকার পর এখন আবার অল্পস্বল্প চাষ শুরু করেছেন। দৌড় নেই, কী আর করবে! তাই পুরনো অভ্যাস মতো চাষে হাত লাগাতে হচ্ছে পিঙ্কিকেও। এতেও গ্রামের বাড়িতে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না। রেখা-দেবনারায়ণের বাড়িতে যে সমস্যা ছিল না।
খেলাধুলোর মতো লেখাপড়ায়ও এগিয়েছে পিঙ্কি। ২১ বছরের মেয়েটি বি এ পাশ করেছে। এবার চাই একটি চাকরি। তারও আগে অবশ্য চাইছে ‘মুক্তি’। গ্রামের বাড়িতে মাসের পর মাস আটকে থেকে চাষ করা আর ভালো লাগছে না। তাড়াতাড়ি শুরু করতে চাইছে দৌড়।