ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসির (Haile Selassie) দেহরক্ষী ছিলেন এক যুবক। তাঁকেও টেনেছিল অলিম্পিক। সম্রাটের দেহরক্ষী বলে কথা! কাজের প্রয়োজনেই তাঁকে শরীরচর্চা, দৌড়ঝাঁপ করতে হত। সম্রাটই তাঁর ওই শরীরচর্চা দেখে উৎসাহিত করেছিলেন অলিম্পিকে যেতে। বলেছিলেন, ‘একবার গিয়ে দেখো। তুমি পারবে।’
তখন ইথিওপিয়ার সম্রাটের নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর শরীরচর্চা দেখার জন্য চাকরি দিয়ে সুইডেন থেকে একজন কোচও আনা হয়েছিল। তিনি ওন্নি নিস্কানেন (Onni Niskanen)। সম্রাট ওই কোচকেও বলেছিলেন ওই যুবকের দিকে আলাদা নজর রাখতে। কোচেরও পছন্দ হয়েছিল ওই যুবককে। আস্থা রেখেছিলেন তিনি। কোচও ওই যুবককে বলেছিলেন, ‘তোমার পক্ষে অলিম্পিকে পদক জেতা অসম্ভব নয়।’ সম্রাটের বিশ্বাস, কোচের আস্থা বিফলে যায়নি। আবেবে বিকিলা সত্যি সফল হয়েছিলেন রোম অলিম্পিকে, ১৯৬০ সালে। রোমে সেবার উঁচু-নিচু রাস্তায় ম্যারাথন দৌড়তে গিয়ে সবাই যখন নাজেহাল, ব্যতিক্রম ছিলেন একজনই। তিনি আবেবে বিকিলা। খালি পায়েও তিনি দৌড়েছিলেন সহজভাবে। জিতেছিলেন অলিম্পিক ম্যারাথনের সোনা। গড়েছিলেন বিশ্বরেকর্ড (২:১৫:১৬.২)। আগের বিশ্বরেকর্ড (২:১৫:১৭.০) ছিল সের্গেই পোপোভের।
১৯৬০-র রোম অলিম্পিক ম্যারাথনে তিনটি ঘটনা ঘটেছিল প্রথম। এক, অত্যধিক গরমের জন্য সেই প্রথম অলিম্পিক ম্যারাথন দিনের বদলে হয়েছিল রাতে। দুই, সেই প্রথম অলিম্পিক ম্যারাথনের শুরু ও শেষ দুটোই হয়েছিল স্টেডিয়ামের বাইরে। তিন, সেই প্রথম অলিম্পিক ম্যারাথনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন এক কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান।


১০ সেপ্টেম্বর ছুঁই ছুঁই সন্ধ্যায় বা পড়ন্ত বিকেলে শুরু হয়েছিল রোমে ম্যারাথন। কিছুক্ষণ পর দিনের আলো শেষ হতে রাস্তায় নেমে আসে অন্ধকার। তখন বাকি পথটা ভরসা ছিল টর্চের আলো। ইতালিয় সেনারা বড় বড় টর্চের আলো ফেলে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ম্যারাথনারদের। সেই আলোতেই দৌড়তে হয়েছিল প্রতিযোগীদের।
রোমে ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলেন ৩৫ দেশের ৬৯ জন। অচেনা-অজানা আবেবে বিকিলা ফেবারিটদের তালিকায় ছিলেন না। কিন্তু ১৮ কিলোমিটারের পর থেকেই ছবিটা বদলাতে শুরু করে। লড়াই দাঁড়ায় বিকিলার সঙ্গে মরক্কোর রাদি বেন আবদেসেলেমের (Rhadi Ben Abdesselem). অন্যরা অনেক পিছনে। আবদেসেলেমকে প্রায় ২০০ গজ পিছনে রেখে আর্চ অফ কনস্টানটাইনে শেষ রেখায় পৌঁছে যান বিকিলা। শেষ সময় একটা সমস্যায়ও তৈরি হয়েছিল। শেষ রেখা থেকে বিকিলা তখন ৬০ গজ দূরে। হঠাৎ বিকিলার সামনে স্কুটার নিয়ে পড়ে যান একজন। গতি একটু কমে গেলেও এতে সোনা জয় আটকায়নি বিকিলার।
রোমের ওই দৌড় দেখেই চোখ কপালে উঠেছিল এক জাপানির। নাম কিহাচিরো ওনিতসুকার। তিনি জুতো বানাতেন। বিকিলা কেন খালি পায়ে দৌড়লেন? খোঁজ নিতে শুরু করেন তিনি। বিকিলা জানান, অলিম্পিকের জন্য নতুন জুতো পরেই অনুশীলন করেছিলেন। কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্যবোধে না করায় অলিম্পিকে নেমেছিলেন খালি পায়ে। একথা শুনে বিকিলাকে জাপানে নিয়ে গিয়েছিলেন কিহাচিরো ওনিতসুকার। বানিয়ে দিয়েছিলেন বিকিলার পায়ের মানানসই জুতো। বিকিলা সেই জুতো পায়ে দৌড়েও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। ৪ বছর পর, ১৯৬৪ সালে টোকিও অলিম্পিকেও ম্যারাথনে জিতেছিলেন সোনা। আবার বিশ্বরেকর্ড গড়ে (২:১২:১১.২)। এবার ভেঙেছিলেন বেসিল হিটলের বিশ্বরেকর্ড (২:১৩:৫৫)। অলিম্পিকে এই দ্বিতীয় সোনা জয়ের মাত্র ৪০ দিন আগে বিকিলার অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন হয়। ফলে রোমের মতো টোকিওতেও তাঁকে কেউ ফেবারিটের তালিকায় রাখেননি। কিন্তু সব হিসেবে উল্টে দিয়েছিলেন তিনি।
দু’টি অলিম্পিকেই সোনা জেতার পর বিকিলাকে বিশেষ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল না। দু’বারই প্রায় একই কথা বলেছিলেন তিনি, আরও একবার দৌড়ে আসতে পারেন পুরো পথটা। সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, তিনি এত স্ট্যামিনা কোথা থেকে পান? বিকিলা বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে পুকুরে পুকুরে তেলাপিয়া মাছ। যাতে প্রচুর প্রোটিন। কিন্তু দাম খুব কম। গরীবের ছেলে দামী কী আর খাবো! তেলাপিয়া মাছের ঝোল আর ভাত খেয়েই আমি বড় হয়েছি। ওটাই আমার শক্তি।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইথিওপিয়াকে কয়েক বছর দখল করে রেখেছিল ইতালি। সেটা মনে ছিল ইথিওপিয়ার মানুষের। বিকিলার সোনা জয়ের পর অনেকে তাই বলেছিলেন, ‘ইথিওপিয়া জয় করতে ইতালির লেগেছিল পুরো সেনাবাহিনী। আর রোম দখল করল মাত্র একজন ইথিওপিয়ান যোদ্ধা।’
ম্যারাথন কঠিন পরিশ্রমের দৌড়। পরপর দুটি অলিম্পিকে সেই ম্যারাথনে সোনা জেতার মতো কঠিন কাজটি করেছিলেন বিকিলা। তাঁর আগে দুটি অলিম্পিকে কেউই ম্যারাথনের সোনা জেতেননি (পরে জিতেছেন Waldemar Cierpinski, ১৯৭৬ ও ১৯৮০ সালে)। এরপর বিকিলা তৈরি হচ্ছিলেন অলিম্পিক ম্যারাথনে সোনা জয়ের হ্যাটট্রিকের জন্য। হঠাৎই ছন্দপতন ১৯৬৭-র জুলাইয়ে। একটি প্রতিযোগিতায় (Zarautz International Marathon) দৌড়নোর সময় হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পান। মাঝপথে সরে যেতে হয়। মেক্সিকো অলিম্পিকের কথা মাথায় রেখে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন জার্মানিতে। পুরোপুরি পায়ের সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারেননি। তবু মনের জোরে নেমেছিলেন ১৯৬৮ সালে মেক্সিকো অলিম্পিকে। কিন্তু সেখানে দৌড় শেষ করতে পারেননি। ১৭ কিলোমিটারের পর সরে দাঁড়িয়েছিলেন, পায়ে আবার চোট লাগায়।
ম্যারাথনের রাজা আবেবে বিকিলার জন্ম এক অলিম্পিক ইয়ারেই, ১৯৩২ সালে, ৭ আগস্ট। কাকতালীয় ঘটনা সেবার লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে ম্যারাথন হয়েছিল ওই ৭ আগস্টই। জন্ম স্থান ইথিওপিয়ার জাতো। বিকিলার মা বেনেবেরু (Wudinesh Beneberu)। বাবা বিকিলা দেমেসি (Bikila Demissie), যিনি বেনেবেরুর দ্বিতীয় স্বামী। তিনি ছিলেন মেষপালক। আর্থিক অনটনের সংসার। আবেবে বিকিলার বয়স যখন বছর পাঁচেক মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ছেলেকে নিজের কাছেই রাখেন মা। আবার বিয়ে করেন বেনেবেরু। তৃতীয় স্বামীর ঘরে যান ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই।
বয়স ২০ হতেই চাকরির খোঁজে নেমে পড়তে হয় বিকিলাকে। একসময় জানতে পারেন সম্রাটের নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীতে (5th Infantry Regiment) লোক নেওয়া হবে। বাড়ি থেকে কিছুটা হেঁটে কিছুটা দৌড়ে ২০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আদিস আবাবায় (Addis Ababa) চাকরির দরখাস্ত জমা দিতে যান। চাকরিটি হয়েও যায়। এটা ১৯৫২ সালের কথা। চাকরি হওয়ার পর প্রথম দিকে এভাবেই যাতায়াত করতেন (পরে অবশ্য আদিস আবাবাতেই থাকতেন)। এটা দেখেই সম্রাট ও কোচ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তখন থেকেই কোচের লক্ষ্য ছিল রোম অলিম্পিকের জন্য বিকিলাকে তৈরি করবেন। ১৯৫৬ সালে আদিস আবাবাতেই একটি ম্যারাথন প্রতিযোগিতায় নামিয়েছিলেন বিকিলাকে, স্রেফ দেখে নেওয়ার জন্য। দ্বিতীয় হয়েছিলেন বিকিলা। তখনই কোচ বুঝেছিলেন, ছাত্রকে দিয়ে হবে। পরের তিন বছর কোনও প্রতিযোগিতায় না নামলেও মাইলের পর মাইল দৌড় করিয়েছেন। অবশেষে অলিম্পিক ইয়ারে এসে, ১৯৬০ সালে জুলাই মাসে নামান একটি প্রতিযোগিতায়। প্রথম হন বিকিলা। আগস্টে আবার একটি প্রতিযোগিতায়। সেখানে শুধু প্রথম হওয়া নয়, এমিল জ্যাটোপেকের অলিম্পিক রেকর্ডের (১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কিতে,২:২৩:০৩.২) চেয়েও ভালো সময় (২:২১:২৩) করেছিলেন। তারপরই সেপ্টেম্বরে রোম অলিম্পিক।
ম্যারাথনের এই রাজার শেষ জীবন কিন্তু সুখের হয়নি। বলতে গেলে অলিম্পিকের দ্বিতীয় সোনাটাই বিকিলার জীবনে টেনে এনেছিল এক করুণ অধ্যায়। ওই সোনা জয়ের পরই ইথিওপিয়ার সরকার বিকিলাকে উপহার দিয়েছিল একটি Volkswagen Beetle গাড়ি। ১৯৬৯ সালের ২২ মার্চ রাতে ওই গাড়ি চালাতে গিয়েই দুর্ঘটনায় পড়েন। ভোরে পথের ধারে পড়ে থাকা গাড়ির ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল আহত, সজ্ঞাহীন বিকিলাকে। কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছিল? আবেবে বিকিলার জীবনীকার টিম জুদার (Tim Judah) লেখা থেকে জানা যায়, বিকিলা সম্ভবত মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আর বিকিলার মেয়ে Tsige Abebe পরে বলেছেন, ‘বাবার কাছে শুনেছিলাম, উল্টো দিক থেকে একটা গাড়ি দ্রুত গতিতে আসছিল। যাতে মুখোমুখি ধাক্কা না লাগে, তাই পাশে সরতে গিয়েই বাবার গাড়ি উল্টে পড়েছিল।’
২৯ মার্চ চিকিৎসার জন্য বিকিলাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ইংল্যান্ডে। সেখানে (Stoke Mandeville Hospital) টানা ৮ মাস চিকিৎসা চলে। কোনও লাভ হয়নি। শরীরের নিচের অংশ অসাড় হয়ে গিয়েছিল। আদিস আবাবাতেই মারা যান ১৯৭৩-এর ২৫ অক্টোবর, ব্রেন স্ট্রোকে। মাঝের ৪ বছর ম্যারাথনের রাজার সঙ্গী ছিল হুইলচেয়ার! কিন্তু তাতেও সরে থাকতে পারেননি মাঠের আকর্ষণ থেকে। যখন জানতে পারেন তাঁর সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে গিয়েছে হুইলচেয়ার, ১৯৭০ সালে লন্ডনে Stoke Mandeville Wheelchair Games-এ অংশ নেন। নেমেছিলেন টেবিল টেনিস এবং আর্চারিতে। তিনি তখন চিকিৎসার জন্য লন্ডনেই ছিলেন। ১৯৭১ সালে নরওয়েতেও গিয়েছিলেন বিশেষভাবে সক্ষমদের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরও ইথিওপিয়ার সরকার এবং ওখানকার সাধারণ মানুষ নানা ভাবে সম্মান জানিয়েছেন আবেবে বিকিলাকে। দুর্ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার আগে থেকেই বিকিলার নামে স্টেডিয়াম তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। হুইল চেয়ারে বসে ‘বিকিলা স্টেডিয়াম’-এর উদ্বোধন করেছিলেন স্বয়ং আবেবে বিকিলা। স্টেডিয়ামে ঠাসা দর্শকদের সবার চোখেই তখন জল!
আজ জন্মদিনে ম্যারাথনের রাজাকে প্রণাম।
জন্ম: ৭ আগস্ট ১৯৩২
মৃত্যু: ২৫ অক্টোবর ১৯৭৩