ফুলচাঁদ রায় বাজারে সবজি বিক্রি করতেন। ৮ মাস আগে বাড়িতে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন। ডান কাঁধের হাড় সরে গিয়েছে। ডাক্তার অস্ত্রোপচারের কথা বললেও টাকার অভাবে এখনও পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। হাত নড়াচড়া করতে পারেন না। ফলে ৮ মাস হয়ে গেল তিনি আর সবজি নিয়ে বাজারে বসতে পারছেন না। লকডাউনের আগে পর্যন্ত তাই সংসার টানতে হচ্ছিল তাঁর স্ত্রী অলকা রায়কে। নিজেদের কোনও চাষের জমি নেই। অন্যের জমিতে চাষের কাজ করেন অলকা, দৈনিক মজুরিতে। প্রতিদিন কাজ পান না। যেদিন কাজ থাকে দিনের শেষে হাতে পান ২০০ টাকা। করোনা-লকডাউনের জেরে প্রায় ৪ মাস সেই কাজও বন্ধ ছিল। মাস খানেক হল চাষের কাজে আবার যেতে শুরু করেছেন। কিন্তু সপ্তাহে কদিন কাজ পাবেন, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এর মধ্যেই আরেক সমস্যা। ফুলচাঁদ-অলকার ছেলে বাংলার উঠতি অ্যাথলিট জয়দেব রায় জলপাইগুড়ি সাই সেন্টারের শিক্ষার্থী। ২০১৮ সাল থেকে ওখানেই হস্টেলে থাকে। লকডাউন শুরু হতেই হস্টেলে তালা। জয়দেবকেও চলে আসতে হয়েছে জলপাইগুড়ির চামড়া খাল গ্রামের বাড়িতে। ফলে সংসারে বেড়েছে আরও একজন ‘খাওয়ার লোক’। নিরুপায় হয়ে সংসার চালানোর দায়িত্ব অনেকটা নিতে হচ্ছে বোলবাড়ি নীলকান্ত পাল হাই স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র জয়দেবকেও। সকালে ট্র্যাকে দৌড়তে যাওয়ার বদলে ওকে এখন যেতে হচ্ছে ধানক্ষেতে। যদি চাষের কাজ পাওয়া যায়। জয়দেব বলছিল, ‘সপ্তাহে দিন তিনেকের বেশি কাজ পাচ্ছি না!’


এবছর করোনার ধাক্কায় এখনও রাজ্য অ্যাথলেটিক্স হয়নি। ২০১৯-এ রাজ্য মিটে জোড়া সোনার পদক জিতেছিল জলপাইগুড়ি জেলা দলের জয়দেব। অনূর্ধ্ব ১৬ বিভাগে জ্যাভলিন থ্রো এবং পেন্টাথলনে। পাটনায় পূর্বাঞ্চল অ্যাথলেটিক্সেও গলায় উঠেছিল জোড়া পদক। জ্যাভলিনে রুপো, পেন্টাথলনে ব্রোঞ্জ। গুন্টুরে জুনিয়র জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে জিতেছিল জ্যাভলিনে ব্রোঞ্জ পদক। বাঁশের বেড়া আর টিনের চালের ঘরে যা শোভা বাড়িয়েছে।
সাই সেন্টারে ভর্তি হওয়ার আগে জয়দেব প্র্যাকটিস করত ওর স্কুলের শিক্ষক রাজীব ভট্টাচার্যর কাছে। তিনিই জয়দেবের প্রথম কোচ। জীবনের এই কঠিন সময়ে বাংলার এই প্রতিভাবান অ্যাথলিটের পাশে আছেন জয়দেবের ‘রাজীব স্যার’ ও জলপাইগুড়ি জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তা ঊজ্জ্বল দাস চৌধুরি। জয়দেব বলছিল, ‘রেশনের ফ্রি চাল, আটায় কোনওভাবে খাওয়া চলছে। ঘরে টাকা নেই। সবচেয়ে বড় চিন্তা বাবার চিকিৎসা কীভাবে হবে!’
নিজেদের এই দুর্দশার মধ্যেও জয়দেবের পরিবার লকডাউনের সময় মহত্বের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। সাই হস্টেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পর লকডাউনের জন্য উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর বাড়িতে ফিরতে পারছিল না ওখানকার শিক্ষার্থী পলাশ হালদার। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল জয়দেব। বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল বন্ধু পলাশকে। জয়দেবের মা-বাবাও আপত্তি করেননি। বাস চলাচল শুরু না হওয়া পর্যন্ত ২ মাস জয়দেবদের বাড়িতেই ছিল পলাশ। সত্যি, ভাবা যায় না!