এক সময় বাজু রাজগড় যখন চাষ করতে যেতেন, কখনও সখনও সঙ্গে যেত মেয়ে প্রমীলা। বাবা চাষের কাজ করতেন, মেয়ে ক্ষেতে দাঁড়িয়ে হাত-পায়ে কাঁদা মাখত, ধান গাছ ধরে টানাটানি করত। ওটা ছিল একরকম খেলা। গ্রামে এরকম ছবি অবশ্য নতুন নয়। এখন ১৯ বছর বয়সেও ধানক্ষেতে যাচ্ছে প্রমীলা। কিন্তু বাবা নয়, মা-র সঙ্গে। খেলার জন্য নয়, পেটের টানে। ২০১৬ সালে বাজু রাজগড় মারা গিয়েছেন। অতি সামান্য যে জমি, তারপর থেকে সেখানে চাষ করতে যান ওঁর স্ত্রী লক্ষ্মী রাজগড়। ওঁদের মেয়ে প্রমীলা অ্যাথলেটিক্স করে। লেখাপড়া, খেলাধুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকে সারা বছর। আর সময় পেলে মা-র সঙ্গে চলে যায় চাষ করতে। যেমন এখন যাচ্ছে।
প্রমীলার দাদা মঙ্গলু রাজগড় রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেন। মা ও দাদা, দু’জনের আয়েও সারা বছর ওদের ৬ জনের সংসার ঠিকঠাক চলে না। আর লকডাউনে সমস্যা তো আরও বেড়েছে। প্রমীলা বলছিল, ‘প্রথম দিকে তো মা, দাদা দুজনের কাজই বন্ধ ছিল। এখন মা চাষ করতে যাচ্ছে, তবে রোজ নয়। দাদার কাজ বন্ধই আছে। আমরা গ্রামের মেয়ে সবরকম কাজ জানি। মা-র সঙ্গে আমিও এখন তাই ক্ষেতে যাচ্ছি চাষ করতে। যদি সংসারের কোনও কাজে লাগে।’


অ্যাথলেটিক্সে প্রমীলার ইভেন্ট হাই জাম্প। রাজ্য অ্যাথলেটিক্সে গত ৪ বছরে তিনবার সোনা জিতেছে হাই জাম্পে। ২০১৬ (অনূর্ধ্ব ১৬), ২০১৭ (অনূর্ধ্ব ১৮) ও ২০১৯ (অনূর্ধ্ব ২০) সালে। ২০১৮ সালে জিতেছিল রুপো। পূর্বাঞ্চল জুনিয়র অ্যাথলেটিক্সেও শিলিগুড়ির প্রমীলার সোনা আছে তিনটি। ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে। ২০১৬ সালে বিশাখাপত্তনমে আন্তঃ জেলা জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে অনূর্ধ্ব ১৬ বিভাগে প্রমীলার গলায় উঠেছিল সোনার পদক।
নকশাল বাড়ির হাতিঘিসা গ্রামের মেয়ে প্রমীলা। ক্লাস ফাইভে যখন পড়ে তখন অ্যাথলেটিক্স শুরু করে। শিলিগুড়ি অ্যাথলেটিক্স ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের শিক্ষার্থী। ওখানে প্রশিক্ষণ নেয় সুজয় ঘোষ রায় ও বিবেকানন্দ ঘোষের কাছে।


হাতিঘিসা হাই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী প্রমীলা বলছিল, ‘আমাদের সংসারের খারাপ অবস্থা তো নতুন নয়। সেটা এখন বেড়েছে। ছোটবেলা থেকেই লড়াই। তার মধ্যেই অ্যাথলেটিক্স করছি। এভাবেই চলবে। জানি না, করোনা-লকডাউন থেকে কবে অবস্থা নর্মাল হবে! মা, দাদার কাজ পুরোপুরি শুরু হয়ে গেলে অন্তত আগের জায়গায় গিয়ে দু-বেলা খেতে পাব।’
দুঃখের কথা বলতে বলতেই প্রমীলার চোয়াল শক্ত হল। জানিয়ে দিল, লড়াই করে করেই পৌঁছতে চায় অলিম্পিকের আসরে। যে স্বপ্নটা প্রমীলা দেখছে অনেক ছোটবেলা থেকে।