ফোনে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল, সদ্য পিতৃহারা কিশোর দুলাল আলি। বৃহস্পতিবার দুপুরে ফোনেই ওর আকুতি, ‘একটু দেখুন আমাকে সাহায্য করার কেউ যদি থাকেন। একটু সাহায্য পেলে খেয়েদেয়ে খেলাটা চালাতে পারি।’ উত্তর দিনাজপুর জেলায় রায়গঞ্জ থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে গোমর্দা গ্রাম। ওখানেই দুলালরা থাকে পাটকাঠির দেওয়াল ও টিনের চালের ঘরে। দুলালের বাবা বারো মহম্মদ হার্টের অসুখে ভুগছিলেন অনেকদিন। লকডাউনের আগে শিলিগুড়িতে গিয়ে চিকিৎসাও করিয়ে এসেছিলেন। তারপর বেশ ভালই ছিলেন। কিন্তু ৩০ জুলাই ব্রেন স্ট্রোক হয়। ডাক্তার দেখানোর আর সুযোগ হয়নি। বাড়িতেই মারা যান বারো মহম্মদ।
গতবছরই রাজ্য অ্যাথলেটিক্সে দুলাল প্রথম অংশ নেয়। উত্তর দিনাজপুর জেলা দলের হয়ে অনূর্ধ্ব ১৪ বিভাগে লং জাম্পে সোনা জিতেছিল। তারপর রাঁচিতে পূর্বাঞ্চল জুনিয়র অ্যাথলেটিক্সে গলায় তুলেছিল লং জাম্পের ব্রোঞ্জ পদক। গতবছর রাজ্য স্কুল অ্যাথলেটিক্সেও অনূর্ধ্ব ১৪ বিভাগে সোনাজয়ী। তবে সেটা লং জাম্পে নয়, ২০০ মিটার দৌড়ে। গত বছর থেকেই জলপাইগুড়ি সাই হস্টেলে থাকার সুযোগও পেয়ে যায়। লকডাউনের জন্য এখন অবশ্য হস্টেল ছেড়ে বাড়ি চলে আসতে হয়েছে।
দুলালের বাবা অন্যের জমিতে দৈনিক মজুরিতে চাষের কাজ করতেন। অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই কাজ অনেকদিন আগে থেকেই বন্ধ ছিল। তারপর লকডাউন। কিছুটা সুস্থ হয়ে লকডাউন একটু শিথিল হতে আবার ক্ষেতে যাওয়া শুরু করেছিলেন। তারপরই বিপত্তি। বাবার মৃত্যু। দুলালের দাদা হাসিবুল রহমান এবারই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। বাবা অসুস্থ থাকার সময় থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু বেশিদিন সেই কাজ করতে পারেনি। অসুস্থ হয়ে এখন গৃহবন্দী। কোমড়ের সমস্যা। লকডাউনের পাশাপাশি টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারছে না। কলেজে ভর্তি হওয়ার কোনও পরিকল্পনাও নেই। দুলালের মা হাসেন বানু খাতুনও স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর সংসার চালাতে চাষের কাজ শুরু করেন, প্রতিদিন ২০০ টাকা মজুরিতে। লকডাউনে কয়েকমাস সেটাও বন্ধ ছিল। তারপর আবার যখন যেতে শুরু করেন, তখনই স্বামীর মৃত্যু। আবার ছেদ পড়েছে কাজে।
দুলাল বলছিল, ‘না খেয়ে মরার মতো অবস্থা এখন। আমার কোচ সজলকুমার দাস, উত্তর দিনাজপুর ডি এস এ-র সেক্রেটারি সুদীপ বিশ্বাস হেল্প করছেন। আমাদের ঘরের পাশে কিছুটা ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে নিজেদের খাবার জন্য কয়েকটা শাক-সবজির গাছ আছে। রেশনের ফ্রি চালের ভাতের সঙ্গে ওই শাক-সবজি দিয়েই কোনওভাবে খেতে হচ্ছে। বেঁচে থাকাই এখন কঠিন। লেখাপড়া, খেলাধুলো আর করব কী করে!’ এরপরই রামপুর ইন্দিরা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র দুলালের আবার আকুতি, ‘এশিয়ান গেমস, অলিম্পিকের স্বপ্ন দেখে এসেছি। এখন তো কারও হেল্প না পেলে খেলাই ছেড়ে দিতে হবে! কেউ যদি আমাকে হেল্প করেন, একটু খেতে পারি, খেলাধুলো চালিয়ে যেতে পারি।’