মাঝ রাত তিনটে-সাড়ে তিনটের মধ্যে ঘুম থেকে ওঠা। ব্যারাকপুরের চক কাঁঠালিয়া সরস্বতী পল্লীর বাড়ি থেকে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে মোটর ভ্যানে সওয়ার হয়ে নীলগঞ্জ। ওখানে কোনও পুকুরে মাছ ধরা। তারপর পুকুরের মালিকের টাকা-পয়সা মিটিয়ে মাছ নিয়ে আবার ভ্যানে চেপে ভেরি গেট বাজার। ওখানে মাছ বিক্রি করে বাড়ি ফিরতে দুপুর দেড়টা-দুটো। পরপর দু’বছর রাজ্য অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে পদকজয়ী সাগর বিশ্বাসের এটাই এখন রুটিন। কয়েকদিন আগে বাংলার বিশিষ্ট এক অ্যাথলেটিক্স কোচ বলছিলেন, ‘করোনার জন্য যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, মনে হয় বাংলার খেলাধুলোর একটা প্রজন্ম শেষ হয়ে যাবে। খেলাধুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।’ সত্যি তাই। করোনা-লকডাউনে গভীর সমস্যায় পড়া ক্রীড়াপ্রতিভাদের পাশে কেউ নেই। শতবর্ষের আলোয় ঊজ্জ্বল ইস্টবেঙ্গলের এক তরুণ অ্যাথলিটের যদি এই অবস্থা হয়, অন্যরা আর কী করবে!


সাগর বিশ্বাস ২০১৪ সালে রাজ্য অ্যাথলেটিক্সে প্রথম অংশ নেয় উত্তর ২৪ পরগনার হয়ে। সেবার অনূর্ধ্ব ১৪ বিভাগে সোনা জিতেছিল ৬০০ মিটারে। কোচবিহারে রাজ্য স্কুল অ্যাথলেটিক্সে অনূর্ধ্ব ১৪ বিভাগে জিতেছিল তিনটি সোনা। ২০০, ৪০০ ও ৬০০ মিটারে। পেয়েছিল ওই বিভাগের সেরা অ্যাথলিটের পুরস্কার। সেবার রাঁচিতে স্কুল ন্যাশনালেও গলায় উঠেছিল সোনার পদক, ৪০০ মিটারে। সেই থেকে কোনও বছরই রাজ্য অ্যাথলেটিক্সে পদকহীন থাকেনি। কখনও সোনা, কখনও রুপো, কখনও ব্রোঞ্জ পদক ওর গলায় উঠেছে। শেষ দু’বছর অর্থাৎ ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সাগর অংশ নিয়েছে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে। ২০১৮-তে অনূর্ধ্ব ১৮ বিভাগে জিতেছিল জোড়া রুপো, ১০০ ও ২০০ মিটারে। ২০১৯ সালেও জোড়া রুপো, অনূর্ধ্ব ২০ বিভাগে ১০০ মিটার ও রিলেতে। এছাড়া পূর্বাঞ্চল অ্যাথলেটিক্সেও বিভিন্ন বছরে পদক জিতেছে। যার মধ্যে রয়েছে তিনটি সোনা। একাধিকবার অংশ নিয়েছে জুনিয়র জাতীয় অ্যাথলেটিক্সেও।
সাগরের বাবা তারক বিশ্বাস মাছ বিক্রেতা। কিন্তু সেই আয়ে সংসার চলে না। তাই সাগরের মা পুতুল বিশ্বাসকে লোকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতে হয়। এভাবেই চলে আসছিল সংসার। কিন্তু করোনা-লকডাউনে সব চুরমার। অনেকদিন তো বাজার বন্ধই ছিল। পরে বাজার খুললেও আগের মতো বিক্রি নেই। তারকের আয় অনেক কমে গিয়েছে। আর যে ৪-৫ বাড়িতে পুতুল কাজ করতেন, তার একটিও এখন নেই। জলপাইগুড়ি সাই কেন্দ্রের শিক্ষার্থী সাগর। ওখানে অনুশীলন করে কোচ ওয়াসিম আমেদের কাছে। হস্টেল এখন বন্ধ। ওদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি ফিরে সাগরকে তাই নামতে হয়েছে সংসারের হাল ধরতে, বাবার সঙ্গে মাছ বিক্রি করতে।