তখন আমার বয়স ১৩ বছর। টালিগঞ্জের বাড়ির উল্টোদিকে একটু এগোলেই রবীন্দ্র সরোবর। পাড়ার অনেকে মিলে খুব ভোরে যেতাম ওখানে সাঁতার কাটতে, ফুটবল খেলতে। সূর্য পুব আকাশে ঊজ্জ্বল হওয়ার আগেই প্রতিদিন দেখতাম টালিগঞ্জ থেকে রাসবিহারীর দিকে ট্রাম রাস্তা ধরে দৌড়ে চলেছেন এক প্রবীণ। তিনি কে? তখন জানতাম না। পরে জেনেছিলাম ওঁর নাম রবীন সরকার, প্রথম বাঙালি পেশাদার বক্সার। এভাবেই রবীন সরকারকে প্রথম দেখা। এটা ৪৭ বছর আগের ঘটনা। আর তাঁকে শেষ দেখা ১২ বছর আগে ২০০৮ সালের ৩১ আগস্ট দুপুরে। সেদিনই জীবনাবসান হয় তাঁর। মৃত্যুর খবর পেয়ে টালিগঞ্জের বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন বিছানায়।
তাঁর ওই চলে যাওয়াটা ছিল একটি স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে। মাঝের ৩৫ বছরে বহুবার দেখা ও কথা হয়েছে। তিনি তখন পাড়ার আরও অনেকের মতো আমারও ‘রবীনদা’। ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যু। আপাতদৃষ্টিতে একটু বেশিই পরিণত বয়সে। কিন্তু সেদিন দুপুরে তাঁর নিস্প্রাণ দেহটার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার মনে হচ্ছিল যেন ‘অল্প’ বয়সেই চলে গেলেন। কারণ তিনি তো কতবার বলেছেন, শুধু ১০০ নয়, বাঁচতে চান আরও অনেক বেশি। অন্তত ১২৫ বছর। ১৫০ হলে আরও ভাল। কিন্তু সেঞ্চুরিটাই তো শেষ পর্যন্ত হয়নি।
রবীনদার সঙ্গে শেষ কথা মারা যাওয়ার ৯ দিন আগে ২২ আগস্ট। তখন তিনি বেশ অসুস্থ। তার ২ বছর আগে বাড়িতে পড়ে গিয়ে ডান পায়ে গুরুতর চোট পেয়েছিলেন। হয়েছিল অস্ত্রোপচার। একদা নব্বই পেরনো বয়সেও দাপিয়ে বেড়ানো রবীনদার তখন থেকেই চলছিল বন্দীদশা। পরে দেখা দেয় চোখের সমস্যা। অস্ত্রোপচার করেও লাভ হয়নি। শেষ দিকে বাঁ চোখে দেখতেও পেতেন না। তা যাই হোক, ওই অসুস্থ অবস্থাতেও সেদিন দুপুরে টিভিতে তিনি দেখছিলেন বেজিং অলিম্পিকের সেমিফাইনালে কিউবার এমিলিও কোরিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের বিজেন্দ্র সিংয়ের লড়াই। একসময় যে লোকটা অনর্গল কথা বলতেন, সেদিন চেষ্টা করলেও তা পারছিলেন না। অল্প যা কথা বলছিলেন, জড়িয়ে যাচ্ছিল। তবে বোঝা যাচ্ছিল, সেমিফাইনালে হেরে গেলেও বিজেন্দ্র সিংয়ের অলিম্পিক পদক (ব্রোঞ্জ) জয়ে খুব খুশি। আমতা আমতা করে বলেছিলেন, ‘আমরা যা পারিনি, ও তা পারল।’
পদক জয় দূরের ব্যাপার, রবীন সরকারের অলিম্পিকে অংশ নেওয়াই তো হয়ে ওঠেনি। তিনি দুর্দান্ত ফর্মে থাকার সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য দুটি (১৯৪০ ও ১৯৪৪) অলিম্পিক হতেই পারেনি। ১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিকের আগে পেশাদার তকমা লেগে গিয়েছিল। অবসরও নিয়ে ফেলেছিলেন। লন্ডন অলিম্পিকে ভারত বক্সিং দল পাঠাবে শুনে অবসর ভেঙে ফিরেছিলেন রিংয়ে। আইন দিয়েই আইনকে হার মানিয়ে একসময় পেশাদার তকমার সমস্যাও কাটিয়ে ফেলেছিলেন। এরপর অন্য সমস্যা। তখন এদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খেলোয়াড়দের দিতে হত যাতায়াতের খরচ। রবীনদা এই টাকা দিতে পারেননি। ফলে তাঁর আর অলিম্পিকে অংশ নেওয়া হয়ে ওঠেনি।
১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কিতে পরের অলিম্পিকে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন ফ্রিলান্স সাংবাদিক হিসেবে। তখনকার অমৃতবাজার পত্রিকা ও যুগান্তরে অলিম্পিকের খবর পাঠাতেন। তার আগে থেকেই ওই দু’টি খবরের কাগজে ও অন্য কিছু ম্যাগাজিনে খেলাধুলো নিয়ে লিখতেন। হেলসিঙ্কিতে অলিম্পিক চলাকালীন এক প্রদর্শনী বক্সিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন।
১৯২৫ সালে ১২ বছর বয়সে বক্সিংয়ে এসেছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তীকে রিংয়ে লড়তে দেখে। বলাইদাস চ্যাটার্জির ছাত্র ছিলেন যতীন চক্রবর্তী। বিডন স্ট্রিটে এক প্রদর্শনী বক্সিংয়ে লড়তে নেমেছিলেন যতীন চক্রবর্তী। তাঁর লড়াই দেখে মুগ্ধ হন রবীন সরকার। ঠিক করেন বক্সিং শিখবেন। ভর্তি হয়ে যান বলাইদাস চ্যাটার্জির কাছে বক্সিং শেখার জন্য। তারপর জীবনের অধিকাংশ সময় বক্সিং নিয়ে কাটিয়ে দিলেও আরও অনেক কিছুর সঙ্গেও জড়িয়ে ছিলেন। অ্যাথলেটিক্স করতেন, প্রিয় ইভেন্ট ছিল হাইজাম্প। ফুটবল খেলতেন, ফুটবলে রেফারিং করতেন। পরে ফুটবলের রেফারিং নিয়ে একটি বইও লিখেছিলেন। পারদর্শী ছিলেন নৃত্যনাট্যেও। তবে তিনি নিজেকে বক্সার হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করতেন। যখন বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লিখতেন, অনেক জায়গাতেই লেখকের নাম লেখা থাকত এভাবে : ‘মুষ্টিযোদ্ধা রবীন সরকার’।
রবীনদার প্রথম জীবন কেটেছে উত্তর কলকাতায়। মাঝে আমেরিকা, ইংল্যান্ড হয়ে শেষ জীবন দক্ষিণ কলকাতায়। যখন উত্তর কলকাতায় থাকতেন পাড়ার অন্যদের নিয়ে গড়েছিলেন ফ্রেন্ডস ইউনাইটেড ক্লাব, ছেলেমেয়েদের ব্যায়াম, ব্রতচারী, অ্যাথলেটিক্স শেখানোর জন্য। উত্তর কলকাতায় যে মাঠে রবীনদা ছোটদের খেলাধুলো নিয়ে মেতে থাকতেন তার পাশের এক বাড়িতেই থাকতেন সাহিত্যিক ও চিত্র পরিচালক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। তিনি খুব পছন্দ করতেন রবীনদাকে। ওই বাড়িতে আসতেন চিত্র পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়। ১৯৪০ সালে আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানকে ৪-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল এরিয়ান। সেই চ্যাম্পিয়ন দলের গোলকিপার ছিলেন রাম ভট্টাচার্য। পরে খেলেছেন মোহনবাগানের হয়েও। তিনি ছিলেন রবীনদার বন্ধু। ওই মাঠেই রাম ভট্টাচার্য ছোটদের ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল খেলা শেখাতেন। স্মৃতি কথা ‘দুটি নয়ন মেলে’ বইয়ে রবীনদার আমেরিকা যাত্রা নিয়ে রাম ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘আমাদের পাড়ার বন্ধু জীতেন চ্যাটার্জি ছিল স্টিভেডর। সেই সময় একটা নরওয়েজিয়ান জাহাজে বাঁদর বোঝাই করে চালান যাচ্ছিল। জীতেন সেই জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বলে কয়ে রবীনকে সেই জাহাজে উঠিয়ে দিল। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ও অর্ধেন্দু মুখার্জি রবীনকে নানান রকম সাহায্য করেছিলেন। রবীন হাফপ্যান্ট পরে, গরম সোয়েটার আর কোট গায়ে দিয়ে, একহাতে একটা সুটকেস, অন্য হাতে ছোট্ট বেডিং নিয়ে সমুদ্র যাত্রা করল। সেই জাহাজ অনেক দেশ ঘুরে আমেরিকায় পৌঁছলো। জাহাজের দোলানিতে অনভ্যস্ত, তাদের খাদ্য খেতে অনভ্যস্ত, সব রকম কষ্ট রবীন হাসি মুখে সহ্য করল।’
রবীনদা আমেরিকায় বেশিদিন থাকেননি। ওখান থেকে চলে গিয়েছিলেন লন্ডন। দু’দেশ মিলিয়ে টানা ১৮ বছর বিদেশে কাটিয়ে ফিরেছিলেন কলকাতায়। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে থাকার সময় খেলাধুলো ছাড়াও ছোটদের শেখাতেন ভারতীয় নৃত্যনাট্য। আমেরিকায় নৃত্যনাট্যের অভিনয়ও করেছেন। লন্ডনে ফুটবল রেফারিংও করেছেন। ওখানে অর্থোপার্জনের জন্য অনেক রকম কাজ করেছেন। যেমন খবরের কাগজ বিক্রি, বাড়ি রঙ করা, রাস্তায় টুল পেতে বসে লোকের হাতের রেখা দেখে ভাগ্য গণনা।
সব মিলিয়ে রবীনদা ছিলেন এক বর্ণময় চরিত্র। বলে শেষ করা যাবে না, কত ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত। তাঁকে নিয়ে কত গল্প। রবীনদার জীবনের একটি ঘটনার বর্ণনা ‘দুটি নয়ন মেলে’ বইয়ে রাম ভট্টাচার্য দিয়েছেন এভাবে, ‘রবীন আসানসোল থেকে ট্রেনে ফিরছিল। সেই কামরায় এক নবীন দম্পতি ছিল। কয়েকজন ষন্ডাগন্ডা অভদ্র লোক মধুপুর থেকে সেই কামরায় ওঠে। তারা সেই দম্পতিকে নানা রকম ভাবে বিরক্ত করতে থাকে। গায়ের ওপর পড়তে চায়। অন্যান্য যাত্রীরা ভয়ে কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। রবীন আর থাকতে পারল না, চেঁচিয়ে উঠে তাদের সাবধান করে। তাতে রেগে গিয়ে একজন পালোয়ান মতন ছোকরা এগিয়ে এসে রবীনের জামার কলার ধরে তার মুখে ঘুঁসি মারতে গেল। চক্ষের নিমেষে রবীনের সোজা একটা লেফট পাঞ্চ তার থুতনিতে গিয়ে আঘাত করলো। লোকটা উল্টে পড়ে গেল। তখন তার সঙ্গীসাথীরা একযোগে তাকে আক্রমণ করলো। রবীন কামরার একটা কোণ বেছে নিয়ে দেওয়ালে পিঠ রেখে দমাদম দু’হাতে মুষ্টি বৃষ্টি করে যেতে লাগলো। তাদের দাঁত ভেঙ্গে গেল, নাক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগলো। তারা ভয় পেয়ে গেল। এতক্ষণে রবীনকে কামরার লোকেরা চিনতে পেরেছে প্রফেশনাল বক্সার বলে। সেই ষন্ডামতন লোকগুলো রেলওয়ে পুলিশকে ডেকে এনে রবীনকে এ্যারেষ্ট করিয়ে দিল। উপস্থিত ভদ্রলোকদের আপত্তিতে পুলিশ কান দিল না। সেই ট্রেনের ফার্ষ্ট ক্লাসে যাত্রী ছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, পরে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। তিনি রবীনকে ছাড়িয়ে আনলেন।’
বর্ণময় রবীনদা সারা জীবন খেলাধুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকায় চাকরি করেননি। অকৃতদার মানুষটি থাকতেন ভাই বিখ্যাত রাইফেল শুটার নৃপেন সরকারের কাছে। জীবনাবসানও টালিগঞ্জের সেই বাড়িতেই।

