২৪ এপ্রিল করোনাকালে এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালে মারা যান বিশিষ্ট চিত্রসাংবাদিক রনি রায়। খেলার মাঠে বিশাল জনপ্রিয়তা ছিল রনির। খেলোয়াড়, কর্মকর্তা—সবার সঙ্গেই ছিল দারুণ সম্পর্ক। মৃত্যুর কারণ করোনা কিনা, জানি না। কিন্তু ওঁর মৃতদেহ দেখতে দেওয়া হয়নি। হয়ত করোনা-আতঙ্কের জন্যই মৃত্যুর পর ওঁকে শেষ বিদায় জানাতে খেলোয়াড়দের ঢল নামেনি। যতটা জানি লকডাউন, করোনা-আতঙ্ককে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দু-চাকা চালিয়ে মাত্র একজন খেলোয়াড়ই হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তাঁকে অবশ্য ভেতরে ঢুকতে বা মৃতদেহ দেখতে দেওয়া হয়নি। সেদিন রাতেই ফোনে তিনি বলেছিলেন, ‘ভীষণ খারাপ লাগছে, রনিদাকে শেষবারের মতো দেখতে পেলাম না! হাসপাতালের গেট থেকেই ফিরে আসতে হল।’


এই তিনি হলেন কুন্তলা ঘোষ দস্তিদার, ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক। ময়দানে অবশ্য ওঁর পরিচিতি আরও ছোট নামে, ঝুমা। এই করোনাকালেও ঝুমার কতো কাজ। লকডাউন, করোনা-আতঙ্কে অনেকেই যখন ঘরবন্দি, ঝুমার কাজ বেড়ে গিয়েছে। লকডাউন ঘোষণা হতেই বেহালার পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন ফুটপাতের দরিদ্র মানুষের পাশে। পাড়ায় খুলে ফেলেন লঙ্গরখানা। সবাই মিলে চাঁদা তুলে বাজার, রান্না। তারপর প্যাকেট করে বেহালার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফুটপাতবাসীদের হাতে দিনের পর দিন সেই খাবার তুলে দেওয়া। পুরো লকডাউনের সময়ই চলেছে ওঁদের সেই কর্মকাণ্ড।
করোনায় আক্রান্ত বেহালারই বাসিন্দা প্রাক্তন জিমন্যাস্ট কৃষ্ণা মালি। সেখানেও পাশে ঝুমা। নিয়মিত চিকিৎসার খোঁজখবর নেওয়া। লকডাউনের সময় নিজের পাড়ার এক মহিলা নার্সের হাসপাতালে কাজে যাওয়ায় সমস্যা। গাড়ি পাচ্ছেন না। সেখানেও পাশে ঝুমা। প্রতিদিন সকালে নিজের দু-চাকায় চাপিয়ে বেহালা থেকে তাঁকে পৌঁছে দিয়েছেন যাদবপুরের হাসপাতালে। করোনার সময়ে এরকম আরও অনেকের পাশে।
আর ওই করোনাকালেই ঘটে গেল উত্তরপ্রদেশে হাথরাস কাণ্ড। কী করে ঘরে বসে থাকবেন? তিনি তো নারী নিগ্রহ বিরোধী নাগরিক কমিটিরও সদস্য। প্রতিবাদে নামতে হল রাস্তায়। বিক্ষোভ, প্রতিবাদ মিছিলেও ঝুমা। বীরভূমে ধর্ষিতা নবম শ্রেণির ছাত্রীর অপমানে আত্মঘাতীর পর ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতেও নারী নিগ্রহ বিরোধী নাগরিক কমিটির মঞ্চে তিনি সোচ্চার। এরকম আরও অনেক প্রতিবাদে হাজির তিনি।
এর বাইরেও অনেক কাজ আছে ঝুমার। চাকরি করেন ইস্টার্ন রেলে। আনলক পর্বে অফিস খুলেছে। সপ্তাহে ২/৩ দিন অফিসে যেতে হচ্ছে। ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়িকা এখন আই এফ এ, এ আই এফ এফের নানা কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত। অনলাইনে করতে হচ্ছে সেই কাজও। ফিউচার স্টারস সকার ফাইন্ডেশনের পুরো কাজটাও চালু রেখেছেন অনলাইনে। বাড়িতে অসুস্থ মা। তাঁর সেবাযত্নও করতে হয় নিয়মিত।


আর আছে শরীরচর্চা। মাঠ এখন বন্ধ। এত কাজের মধ্যেও তাই নিয়ম করে যা চলছে বাড়িতে। লকডাউন, করোনা ওঁকে কোনও কিছু থেকেই বিরত রাখতে পারেনি। ঝুমার কাছে এরকম কাজ অবশ্য নতুন নয়। যে কোনও সমস্যায় মানুষের পাশে থাকাটা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন। ১৯৯৮ সাল। ব্যাঙ্কক এশিয়ান গেমসে জ্যোতির্ময়ী শিকদারের জোড়া সোনা জেতার বছর। বাংলার কিছু ধান্দাবাজ কর্মকর্তার জন্যই বাঙালি খেলোয়াড়রা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বারবার রাজনীতির শিকার হন। অতীতেও হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন।
সেবার জোড়া সোনা জেতার আগে, ব্যাঙ্ককে পৌঁছেও জ্যোতির্ময়ীকে বারবার প্রাদেশিক রাজনীতির শিকার হতে হয়েছিল। তখন সেই ব্যাঙ্ককেও জ্যোতির্ময়ী পাশে পেয়েছিলেন একজনকে। তিনি ওই কুন্তলা ঘোষদস্তিদার। দিদির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আগলে রেখেছিলেন জ্যোতির্ময়ীকে। ব্যাঙ্ককে জ্যোতির্ময়ীকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল জঘন্য একটি ঘরে। ওখানে ঝুমা ছিলেন ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলের সহকারী কোচ। তিনি নিজের ঘর ছেড়ে দিয়েছিলেন জ্যোতির্ময়ীকে। নিজে ছিলেন এক ফুটবলারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে অন্য ঘরে।
পিঙ্কি প্রামাণিকের নারীত্ব নিয়ে তখন জোরালো বিতর্ক। এক মহিলা ভারতের এই বিশিষ্ট অ্যাথলিটের বিরুদ্ধে সরাসরি ধর্ষণের অভিযোগ আনেন। পিঙ্কিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে জেলেও যেতে হয়। তখনও এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানাতে সবার আগে এগিয়ে এসেছিলেন ঝুমা। বাংলার একঝাঁক মহিলা খেলোয়াড়কে তিনি জড়ো করে ফেলেছিলেন সেই আন্দোলনে। কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনে রীতা সেন, জ্যোতির্ময়ী শিকদার, বুলা চৌধুরি, শান্তি মল্লিকরা বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ওখানে এসেছিলেন সুব্রত ভট্টাচার্য, সুরজিৎ ঘোষরাও।
পরের দিন বারাসত আদালতে যখন পিঙ্কিকে তোলা হয়, সেখানেও বিক্ষোভ দেখাতে গিয়েছিলেন জ্যোতির্ময়ী, শান্তি-সহ একঝাঁক মহিলা খেলোয়াড়। সেখান থেকে দমদম জেল, যেখানে রাখা হয়েছিল পিঙ্কিকে। সেখানেও হাজির ছিলেন ওঁরা, জেলের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে। পুরো ব্যাপারটাই সংগঠিত করেছিলেন ঝুমা। পিঙ্কি জামিন না পাওয়া পর্যন্ত নানাভাবে চলেছিল সেই আন্দোলন। এখানে অন্য একটি ব্যাপারও উল্লেখ করা দরকার, ঝুমা এতটা উদ্যোগ নিলেও বাংলার কয়েকজন নামী মহিলা ক্রীড়াবিদকে পাশে পাননি। স্রেফ রাজনীতি!
কুন্তলা ঘোষ দস্তিদার, ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক নারী নিগ্রহ বিরোধী নাগরিক কমিটির মঞ্চে
আরও আগে ও পরে যখনই কোনও খেলোয়াড় সমস্যায় পড়েছেন পাশে থেকেছেন বা থাকার আন্তরিক চেষ্টা করেছেন ঝুমা। পিঙ্কি প্রামাণিকের মতো, মহিলা ফুটবলার বন্দনা পালের জীবনও যখন বিপন্ন, পাশে সেই ঝুমাই। আর্থিক অনটনে মহিলা ফুটবলার শান্তা ধাড়া যখন দিশেহারা, সেখানেও পাশে ঝুমা। এরকম আরও অনেক উদাহরণ আছে। আসলে খেলতে খেলতেই সমাজসেবাকেও জীবনের অঙ্গ করে নিয়েছেন কুন্তলা ঘোষদস্তিদার। ময়দানে সবার প্রিয় ঝুমা।