(ভারতীয় টেনিসের ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’-এর একজন তিনি। জীবনাবসান ২০০৮-এর বর্ষবিদায়ের সন্ধ্যায়। আজ, ২০ অক্টোবর, ৮০ বছর পূর্ণ হওয়ার জন্মদিনে প্রেমজিৎ লালকে স্মরণ।)
২০০৮-এর বর্ষবিদায়ের রাতের একটি দৃশ্য। মধ্য কলকাতার বিলাসবহুল এক কমপ্লেক্সের স্টাফস কোয়ার্টার্সের ঘরে চূড়ান্ত অবহেলা, উপেক্ষায় পড়ে রয়েছে প্রাণহীন একটি দেহ। কিছুক্ষণ আগে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন ভাই অজিত লাল। মৃতদেহ পাহাড়ায় ওড়িশার এক যুবক, নরেন্দ্র দাস। যিনি প্রায় শেষ দুই দশক ছিলেন সর্বক্ষণের সঙ্গী। ‘প্রভু’-র মৃত্যুর পরও নৈশসঙ্গী তিনি একাই। ওখান থেকে বের হয়ে অফিসে যখন ফিরছি পার্ক স্ট্রিট এবং সংলগ্ন রাস্তায় বর্ষবরণের তোড়জোড়। সেদিকে চোখ যাচ্ছিল না। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল অবহেলায় পড়ে থাকা সেই প্রাণহীন দেহটা। বারবার একটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল, এতটা উপেক্ষা, অবহেলা কি প্রাপ্য ছিল প্রেমজিৎ লালের?
এর ৬ বছর আগে ২০০৩-এর জানুয়ারির এক সকালেও গিয়েছিলাম ওই ঘরে। প্রেমজিৎ লাল তখন অসুস্থ। হুইল চেয়ার তাঁর সঙ্গী। কিন্তু মানসিক ভারসাম্য তখনও হারাননি। কথা বলতে পারতেন বেশ ভালই। স্মৃতিশক্তিও অনেকটা টাটকা ছিল। গৃহবন্দি, প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায়ও তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘আমি ভাল আছি। জীবনটা উপভোগ করছি। আমার কোনও ক্ষোভ, হতাশা, দুঃখ নেই।’
তারপরও আরও কয়েকবার গিয়েছি ওই ঘরে। প্রেমজিৎ লালের সামনে। কখনও ভীষণ অসুস্থ। কথা বলার ক্ষমতা নেই। মাথা নেড়ে জানিয়েছেন, ভাল আছেন। কখনও সেটুকু ক্ষমতাও ছিল না। আর ২০০৮-এর সেই রাতে তাঁর তো কথা বলার উপায় ছিল না। থাকলে, অতটা উপেক্ষার পরও, প্রেমজিৎ লাল হয়ত বলতেন, ‘আমি ভাল আছি। জীবনটা উপভোগ করছি।’ আসলে প্রেমজিৎ লাল ছিলেন ওরকমই এক মানুষ, হাজার উপেক্ষাতেও যাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন না। হাজার কষ্টেও যাঁরা হাসি মুখে বলতে পারেন, ‘ভাল আছি।’


সারা জীবন ভাল থাকতে চেয়েছিলেন যে মানুষটি, তাঁর টেনিস জীবন ছিল ঊজ্জ্বল। নিজের টেনিস প্রতিভায় খুব অল্প বয়সেই চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে। রমানাথন কৃষ্ণান জুনিয়র উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন ১৯৫৪ সালে। রানার-আপ ১৯৫৩-তে। রমানাথনের পর প্রেমজিৎ হলেন দ্বিতীয় ভারতীয়, যিনি উইম্বলডনের জুনিয়র সিঙ্গলসের ফাইনালে ওঠেন, ১৯৫৮ সালে। ফাইনালে অবশ্য হেরে গিয়েছিলেন আমেরিকার ই বুকহলজের কাছে। ১৯৬০-এ ফাইনালে উঠেছিলেন জয়দীপ মুখার্জি। ওই রমানাথন-প্রেমজিৎ-জয়দীপকে পরে বলা হত ভারতীয় টেনিসের ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’। ওই তিনজনের হাত ধরেই ১৯৬৬ সালে ডেভিস কাপের চ্যালেঞ্জ রাউন্ড বা ফাইনালে পৌঁছেছিল ভারতীয় দল। সেই প্রথম ভারতের ডেভিস কাপের ফাইনালে ওঠা। মেলবোর্নে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারলেও (১-৪) সে বছর রমানাথন-প্রেমজিৎ-জয়দীপরা বিস্তর প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন টেনিস-বিশ্বের। ফাইনালে অবশ্য খেলার সুযোগ হয়নি প্রেমজিতের। দু’টি করে সিঙ্গলস খেলেছিলেন রমানাথন ও জয়দীপ। ডাবলসে জয়দীপ-রমানাথন।
সেবার ফাইনালে খেলার সুযোগ না হলেও ডেভিস কাপে চুটিয়ে খেলেছেন ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৩। যার মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু স্মরণীয় ম্যাচ। ডেভিস কাপে ভারত প্রথম অস্ট্রেলিয়াকে হারায় ১৯৭০ সালে বেঙ্গালুরুতে। যাতে দুটি সিঙ্গলসেই জিতেছিলেন প্রেমজিৎ। ডেভিস কাপে সিঙ্গলসে প্রেমজিৎ খেলেছেন ৫৪ টি ম্যাচ। জয় ৩৪ টিতে। ডাবলসে ৩৬ টি ম্যাচ খেলে জিতেছেন ২০ টিতে।
উইম্বলডনেও কয়েকটি স্মরণীয় ম্যাচ খেলেছেন প্রেমজিৎ। যেমন ১৯৬৯ সালে কিংবদন্তি রড লেভারের বিরুদ্ধে প্রেমজিতের লড়াই তো লোকগাথা হয়ে আছে। দ্বিতীয় রাউন্ডের ওই ম্যাচে ২-০ এগিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত অবশ্য হেরে গিয়েছিলেন (৬-৩, ৬-৪, ৩-৬, ০-৬, ০-৬) প্রেমজিৎ। নানা সময়ে রড লেভার নিজের জীবনের অন্যতম সেরা ম্যাচ হিসেবে ওটাকে চিহ্নিত করেছেন। দীর্ঘদিন দেশের হয়ে একসঙ্গে খেলা রমানাথনের মুখে শুনেছি, ‘প্রেম দুর্দান্ত সার্ভিস করত। ছিল আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়। ওর সেরা খেলাটা বেরিয়ে এসেছিল লেভারের বিরুদ্ধে উইম্বলডনের ওই ম্যাচটিতেই। শুধু প্রথম দুটি সেট জেতাই নয়, তৃতীয় সেটেও একসময় প্রেম ৩-০ গেমে এগিয়ে গিয়েছিল। শেষ রক্ষা না হলেও প্রেমের সেই দুর্দান্ত লড়াই ভোলা যাবে না। ভুলতে পারব না।’
‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’-এর সোনার সময় পেরিয়ে এসে ডেভিস কাপে বিজয় অমৃতরাজের সঙ্গেও ডাবলসে খেলেছেন প্রেমজিৎ। ডেভিস কাপের কোনও ম্যাচ নয়, প্রেমজিতের প্রসঙ্গ উঠলে বিজয়ও উইম্বলডনের ওই ম্যাচটার কথাই বলেন, ‘এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে খেলাটি ছিল চার নম্বর কোর্টে। পুরো ম্যাচটাই আমি দেখেছিলাম। এখনও চোখের সামনে ভাসে। মনে হয়, প্রেমজিৎ-লেভার খেলছে, আর আমি দর্শক আসনে বসে!’


প্রেমজিতের আরেকটি স্মরণীয় লড়াই ১৯৭৩-এর উইম্বলডনে প্রথম রাউন্ডে বিয়র্ন বর্গের বিরুদ্ধে। প্রথম দুই সেট হেরেও (৩-৬, ৪-৬) তৃতীয় সেটে দুর্দান্ত লড়াই করেছিলেন প্রেমজিৎ। শেষ রক্ষা অবশ্য হয়নি (৮-৯)। শেষ জীবনে ওই উইম্বলডনও তাঁকে আকর্ষণ করত না। জীবনাবসানের আগের বছর (২০০৭) উইম্বলডন চলাকালীন গিয়েছিলাম ওঁর কাছে। ১০ দিন নার্সিং হোমে কাটিয়ে একসপ্তাহ আগে বাড়ি ফিরেছেন। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। মাঝেমধ্যেই শুনতে পাচ্ছিলাম ঘরের ভেতর বিকট চিৎকার। ওঁর সেই সঙ্গী নরেন্দ্র দাস একবার বেরিয়ে এসে বলে যান, ‘গত কয়েকদিন ধরে এরকমই করছেন। শুধু চিৎকার আর চিৎকার!’ জানা গেল, মানসিক সমস্যা। ডাক্তার বলেছেন, ঠিক মতো ওষুধ খেলে সপ্তাহ তিনেকে ঠিক হয়ে যাবে। নরেন্দ্রই জানিয়েছিলেন, ‘উইম্বলডন চললেও এখন আর টিভি দেখেন না। খোঁজও রাখেন না।’ আসলে টিভি দেখা বা উইম্বলডনের খোঁজ রাখার মতো অবস্থাতেই তখন প্রেমজিৎ ছিলেন না।
মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন হৃদয়বান। তাঁর শেষ জীবনের সঙ্গী নরেন্দ্র দাসের মুখেই শুনেছি, ‘যখন গুরুতর অসুস্থ, তখনও মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞেস করতেন, আমার কোনও সমস্যা হচ্ছে কিনা?’ রমানাথন কৃষ্ণানের কথায়, ‘হৃদয়বান মানুষ ছিল। বন্ধুবৎসল। যখন একসঙ্গে বাইরে খেলতে যেতাম, সব সময় আমাদের সবার দিকে নজর রাখত।’
সুদর্শন চেহারার প্রেমজিৎ লালকে অনেকে পাঞ্জাবি বলে ভুল করতেন। আসলে ওঁর বাবা-মা, দু’জনই ছিলেন বিহারের লোক। তবে ছোটবেলা থেকেই কলকাতার বাসিন্দা। প্রেমজিতের জন্মও কলকাতায়, ১৯৪০ সালের ২০ অক্টোবর। বেড়ে ওঠা, উত্থান, সাফল্য সবই কলকাতা থেকে। একসময় সাউথ ক্লাব ছিল প্রেমজিতের ঘরবাড়ি। ওখানেই দিলীপ বসুর কাছে টেনিসের শিক্ষা নেওয়া।


তাঁর জীবনের অনেক স্মৃতিমাখা শহরেই মৃত্যু ২০০৮-এর শেষ সন্ধ্যায়। চূড়ান্ত উপেক্ষা আর অবহেলায়। ‘আমি ভাল আছি’ বলতে ভালবাসতেন প্রেমজিৎ লাল। সত্যি কি তিনি ভাল ছিলেন? রমানাথন কৃষ্ণানের ‘হৃদয়বান মানুষ’ হয়ত নিজের কষ্টে থাকাটা প্রকাশ্যে বলতে চাননি। কিন্তু কষ্টেই তো ছিলেন। ক্ষোভ, হতাশাও নিশ্চয়ই ছিল। তা নাহলে কেন একবার মেট্রোর লাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করবেন? সব দিক দিয়ে ভাল থাকলে, হতাশা না থাকলে কেন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন?
আর যখন খেলতেন, তখনও কি কোনও ঘটনায় সত্যি হতাশ হতেন না? দুঃখ পেতেন না? অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ডেভিস কাপ ফাইনালে খেলতে না পেরে সত্যি কি তিনি দুঃখ পাননি? হতাশ হননি? প্রেমজিৎ এবং তাঁর স্ত্রী জর্জিনা মিলে একটি বই লিখেছিলেন, ‘ডাউন দ্য লাইন’। সেই বইয়ে ওই ফাইনাল প্রসঙ্গে জর্জিনা লিখেছেন, ‘ফাইনালে খেলার সুযোগ না পেয়ে হতাশ হয়েছিল প্রেম। আমি আগে বা পরে ওকে এরকম হতাশ হতে আর কখনও দেখিনি।’ অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ তিনিও তো ছিলেন রক্তমাংসের মানুষ।
জন্ম: ২০ অক্টোবর, ১৯৪০
মৃত্যু: ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৮