29 C
Kolkata
Saturday, September 23, 2023
More

    ভারতের এক বিস্মৃত টেবিল টেনিস তারকা জ্যোতির্ময় ব্যানার্জি – নির্মলকুমার সাহা

    তাঁর জন্ম ও মৃত্যু একই তারিখে ১ আগস্ট, যথাক্রমে‌ ১৯৩৫ ও ১৯৯২ সালে। তিনি জ্যোতির্ময় ব্যানার্জি। গত শতাব্দির পাঁচ ও ছয়ের দশকে বাংলা ও ভারতের টেবিল টেনিসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সিনিয়র সিঙ্গলসে রাজ্য ও জাতীয় চ্যাম্পিয়ন না হয়েও যিনি ওই সময় দাপট দেখিয়েছেন ভারত জুড়ে। সুদর্শন জ্যোতির্ময়ের খেলায় ছিল সৌন্দর্য্যের ছোঁয়া। ছিলেন উচ্চ পর্যায়ের স্ট্রোক প্লেয়ার। তাঁর খেলার টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে বিলেতেও।

    ১৯৫২ সালে ইন্দোরে জুনিয়র ন্যাশনালে সিঙ্গলসে চ্যাম্পিয়ন। পরের বছরই, ১৯৫৩ সালে সিনিয়র ন্যাশনালে সিঙ্গলসে উঠেছিলেন সেমিফাইনালে। কিন্তু হেরে যান থিরুভেঙ্গাদমের কাছে। প্রথম দু’‌টি গেম জেতেন জ্যোতির্ময়। তৃতীয় গেমে ২০-‌১৭ পয়েন্টে এগিয়ে। সবাই ধরে নিয়েছেন ফাইনালে পৌঁছে যাবেন। দরকার মাত্র একটি পয়েন্ট। জ্যোতির্ময়ের একটি শট টেবিলের কোণা ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। জয়ের জন্য জ্যোতির্ময়কে অভিনন্দন জানাতে হাত বাড়িয়ে দেন থিরুভেঙ্গাদম। এমন সময়ই আম্পায়ার জানিয়ে দেন বল টেবিল স্পর্শ করেনি। ওই গেমটি আর জিততে পারেননি। পরে বাকি দু’‌টি গেমও হেরে যান। ফাইনালে ওঠাও আর হয়নি। পরে আরও একবার সিনিয়র ন্যাশনালে সিঙ্গলসের সেমিফাইনালে উঠেছিলেন, ১৯৬০ সালে। 

    সিনিয়র ন্যাশনালে বাংলার হয়ে প্রথম খেলেন ১৯৫৩ সালে, ত্রিবান্দ্রমে। ভারতের হয়েও প্রথম খেলা ওই বছরই টোকিওয় এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে। পরের বছর, ১৯৫৪ সালে খেলেন বিশ্ব টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে। সেবার খেলা ছিল লন্ডনে। তখন অধিকাংশ খেলাতেই দেশের হয়ে খেলতে গেলেও টাকা দিতে হত খেলোয়াড়দেরই। জ্যোতির্ময়কে টাকা দিয়ে দিয়ে খেলতে যেতে সহযোগিতা করেছিলেন ভবানীপুর ক্লাবের প্রাণপুরুষ নলিনীনাথ মিত্র। ময়দানে যিনি পরিচিত ছিলেন নানী মিত্র নামে। ভারতের হয়ে খেলতে গিয়ে লন্ডন থেকে দেশে ফেরেননি। জ্যোতির্ময়ের বাবা জিতেন্দ্রমোহন ব্যানার্জি ছিলেন আইনজীবী। তিনি ছেলেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন লন্ডনেই উচ্চ শিক্ষার জন্য থেকে যেতে। বাবার পরামর্শ মেনে ভারতীয় দলের সঙ্গে দেশে না ফিরে লন্ডনে থেকে গেলেও লেখাপড়া আর বেশি করা হয়ে ওঠেনি। কারণ টেবিল টেনিস। বিদেশে থাকার খরচ যোগাড় করতে একটা কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলেন। সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজ। শনি-‌রবি টেবিল টেনিস খেলা। কখনও একদিনের, আবার কখনও দু’‌দিনের টুর্নামেন্ট। খেলতে খেলতে ওখানে রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। অনেক বছর পরও কোনও ভারতীয় ওখানে খেলতে গেলে প্রবীণ লোকেরা জ্যোতির্ময়ের খেলার গল্প শোনাতেন।

    ১৯৫৭ সালে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসেন। ইস্টার্ন রেলে চাকরিতে যোগ দেন। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরই ছিল সারা ভারত আন্তঃ রেলওয়ে টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতা। সেখানে জ্যোতির্ময়ের রেজাল্ট ভালো হয়নি। ফলে সুযোগ হয়নি জাতীয় প্রতিযোগিতায় রেলওয়েজ দলে। সেবার জাতীয় প্রতিযোগিতা ছিল কলম্বোয়। রেলওয়েজ ওঁকে দলে না নেওয়ায় খেলতে গিয়েছিলেন বাংলার হয়ে। ফাইনাল রাউন্ডে উঠেছিল বোম্বাই, রেলওয়েজ ও বাংলা। রেল দলে না নেওয়ায় কিছুটা ‘‌অপমানিত’‌ হয়েছিলেন জ্যোতির্ময়। সেই অপমানের জবাব দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল রেল-‌বাংলা ম্যাচে। বাংলা হারিয়েছিল রেলকে। জ্যোতির্ময় হারিয়েছিলেন বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা ভারতের একমাত্র খেলোয়াড় কে নাগরাজকে।

    বাংলা অবশ্য চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। হয়েছিল রানার্স। হেরে গিয়েছিল বোম্বাইয়ের কাছে। কিন্তু সেই খেলাতেও দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন জ্যোতির্ময়। তিনি জিতেছিলেন তিনটি সিঙ্গলসেই। যার মধ্যে হারিয়েছিলেন তখনকার এশিয়ার একনম্বর সুধীর থ্যাকার্সে, গৌতম দিওয়ানের মতো তারকাকে। জ্যোতির্ময়ের খেলা দেখে রেলের কর্তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। পরের বছরই অবশ্য আমেদাবাদের জাতীয় প্রতিযোগিতায় রেল দলে ঢুকেছিলেন জ্যোতির্ময়।

    লন্ডন থেকে ফেরার পর ভারতীয় দলে আবার ফেরেন ১৯৬০ সালে, বোম্বাইয়ে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে। ১৯৬১ সালে চীনের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের জন্যও ভারতীয় দলে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ভারতীয় দলকে সেবার চীনে যেতে দেয়নি। কারণ ১৯৬২-‌র ভারত-‌চীন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট আগে থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বিকল্প হিসেবে সরকার ব্যবস্থা করেছিল ভারতীয় দলের ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড সফরের। সেই সফরে গিয়েছিলেন জ্যোতির্ময়।

    জাতীয় প্রতিযোগিতায় শেষ খেলেছেন একটু বেশি বয়সেই, ১৯৭০ সালে। সেবার কলকাতায় ন্যাশনালে ছিলেন বাংলার অধিনায়ক।

    বড় মাপের খেলোয়াড়, নানা সাফল্যের পরও রাজ্য চ্যাম্পিয়নশিপের পুরুষ সিঙ্গলসের খেতাব তাঁর অধরাই থেকে গিয়েছে। ১৯৬৩ সালে খুব কাছাকাছি এসেও রাজ্য চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি। ফাইনালে জ্যোতির্ময়ের সামনে ছিলেন দীপক ঘোষ। সেদিন লড়তেই পারেননি জ্যোতির্ময়। বোর্ডে ঝড় তুলে মাত্র ১১ মিনিটেই ম্যাচটি জিতে নিয়েছিলেন দীপক।

    ওই বছরই ওয়াই এম সি এ-‌তে এক টুর্নামেন্টের ফাইনালে জ্যোতির্ময় মুখোমুখি হয়েছিলেন কে নাগরাজের। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। ফাইনাল সেটে ২০-‌১৯ এগিয়ে নাগরাজ। ওই সময় একটি শট নিতে গিয়ে ফ্লোরে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন জ্যোতির্ময়। ওই শট ফেরাতে গিয়ে একই অবস্থা হয় নাগরাজেরও। দু’‌জনকেই তুলে নিয়ে আসা হয় বাইরে। শুশ্রূষার পর দু’‌জন আবার খেলা শুরু করেন। জেতেন নাগরাজ।

    জাতীয় র‌্যাঙ্কিংয়ে সবচেয়ে উপরে উঠেছিলেন ২ নম্বরে। ন্যাশনালে পুরুষ ডাবলস, মিক্সড ডাবলস, প্রবীণদের সিঙ্গলসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। বাড়িতে টেবিল টেনিস খেলার চমৎকার পরিবেশ ছিল। ওঁর ভাই জহর ব্যানার্জিও নামী টেবিল টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন। চুনী গোস্বামীর সঙ্গে তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে একই ক্লাসে পড়তেন। জড়িত ছিলেন দেশপ্রিয় পার্কের দক্ষিণ কলকাতা সংসদ এবং ওয়াই এম সি এ এ-‌র (‌চৌরঙ্গী)‌ সঙ্গে। মৃত্যুর পর বেঙ্গল টেবিল টেনিস অ্যাসোসিয়েশন তাঁর স্মৃতিতে টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতা শুরু করে। ২০১৮ পর্যন্ত টানা সেই প্রতিযোগিতা হয়েছে। করোনার জন্য এবছর হতে পারেনি।

    আজ জন্ম ও মৃত্যুদিনে বাংলা ও ভারতের এই বিস্মৃত টেবিল টেনিস তারকাকে স্মরণ।

    জন্ম:‌ ১ আগস্ট, ১৯৩৫

    মৃত্যু:‌ ১ আগস্ট, ১৯৯২‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌

    Related Posts

    Comments

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    সেরা পছন্দ

    কতদিন বৃষ্টি চলবে দক্ষিণবঙ্গে ? জানাল আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : ঝাড়খণ্ডের উপর তৈরি হওয়া নিম্নচাপের জেরে বিগত ক’দিন ধরে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে...

    ‘‌ফেলো কড়ি , পাও পঞ্চায়েতের পদ’‌ ! বিস্ফোরক দাবি তৃণমূল বিধায়কের

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : এবার বিস্ফোরক অভিযোগ তুললেন তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক ইদ্রিশ আলি। পঞ্চায়েত নির্বাচন মিটে গেলেও...

    বড় সিদ্ধান্ত মোদী সরকারের ! গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হতে চলেছে ‘বার্থ সার্টিফিকেট’

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : এবার থেকে বার্থ সার্টিফিকেটই হতে চলেছে সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট। কারণ ১ অক্টোবর থেকেই...

    চিনের কাছে ৫-১ গোলে হারল ভারত !

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : পেনাল্টি বাঁচালেন ভারতের (Indian Football Team) গোলকিপার গুরমীত। দুর্দান্ত গোল করে ভারতের হয়ে...

    বিশ্ব বাজারে রেকর্ড অস্ত্র বিক্রি করল ভারত !

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : আমদানি নয়, বিশ্ববাজারে অস্ত্র বিক্রির আশা শুনিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভারতীয় "প্রতিভা ও...