30 C
Kolkata
Monday, September 25, 2023
More

    নিরুদ্দেশের ঠিকানা গোবর্ধনপুর – প্রদ্যুৎ কুমার দে

    করোনা আবহে অধৈর্য মন কুরে কুরে খাচ্ছিলো, দিন যাপনের ক্লান্তি চেপে বসে। মন যে পালাই পালাই করে। কজনে মিলে বেড়িয়ে পড়ি এমন কোথায় যেখানে শুধুই বেপোরোয়া স্বপ্ন দেখবো , যেখানে মন হবে খামখেয়ালীপনা, বেরিয়ে পড়ি দৃষ্টির নাগালে এক অজানা দ্বীপে ঠেক মারতে। একদিন ভোর ভোর বেরিয়ে পড়লুম অচেনা অজানা দ্বীপের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে কাকদ্বীপ হয়ে গঙ্গাধরপুর সেখান থেকে পাথরপ্রতিমা। ওখানে একজনের ব্যবস্থাপনায় তার বাড়িতে গাড়ি রেখে সোজা পাথরবাজার খেয়াঘাটে। খেয়াঘাট ভিড়ে ঠাসা সপ্তাহের্ শেষে যাত্রীর সমাগম একটু বেশি থাকে। আমাদের গন্তব্য সুন্দরবনের একদম শেষ প্রান্তে জি প্লট দ্বীপের গোবর্ধনপুরে।

    চাঁদমারী ঘাটের ভুটভুটির ভিড় সন্ধান করে চাঁদমারির ভুটভুটিতে উঠলাম। আসলে ভ্রমণার্থী হিসাবে খুবই কম মানুষের আসা এই দ্বীপে। করোনা আবহে আমরাই পর্যটক হিসাবে হয়তো প্রথম যাচ্ছি। যদিও ওখানে দেখলাম করোনার ঝড় ঝাপ্টা যায় নি। বেশির ভাগ যাত্রী ভুটভুটির পেটে গিয়ে বসলো আমরা ওপরেই থাকলাম , দুচোখ ভোরে শুধু নদী দেখবো, দেখবো সবুজের সমাহার। শুনলাম দিনে দুটো কি তিনটে ভুটভুটির যায়। নদীর বুকে তখন জোয়ারের ঢেউ কাটছে, ভেঁপু বাজিয়ে ভুটভুটি ছাড়লো কাঁটায় কাঁটায় ১০টা ৩০।

    আমরা হেতানিয়া দোয়ানিয়া বুকে ভেসে চলেছি উত্তর থেকে দক্ষিণ বরাবর। পাথরপ্রতিমার ঠিক উলটো দিকেই রামগঙ্গা খেয়ে ঘাট। ওখানে থেকে ছেড়ে আমরা হেতানিয়া দোয়ানিয়া ছাড়িয়ে যখন চালতাদুনিয়া নদীতে পড়লাম তখন চারিদিক দিকশূন্য, টই টুম্বুর জলরাশি। আরো দুটো নাম না জানা নদী এসে মিশেছে। এখানে নদী কথা বলে প্রতিটা বাঁকে বাঁকে সে সে তার জীবন কাহিনী আঁকে। বর্ষার জলে নদীর রূপ আরো মোহময় হয়ে উঠেছে সে যেন এক ভয়ঙ্কর সুন্দরী। যত এগোই ততই ঢেউ বাড়তে থাকে। বুকের ভিতর তখন চেনা অচেনা ফিরিস্তি গুলো জেগে উঠছে। ভয়ে ভরসায় সময় কে জাপটে ধরি যে কখন তীরে তরী ভিড়বে।

    এই সামনেই এক ভদ্রলোক আনন্দবাজার পড়তে পড়তে চশমার ফাঁকে আমাদের অচেনা মুখের পরিনাম দেখে নিজেই আলাপ করতে এগিয়ে এলেন। আলাপে সংলাপে জানলুম উনি জি প্লটের বুড়াবুড়ির তটের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমাদের এই অপরিচিত ভ্রমনের ব্যাপারে উনি খুব খুশিও যেমন ,তেমন খুব উৎসুক, ইনি হলেন শ্রদ্ধেয় বিমান বাবু মহাশয়। ওনার মুখে এই সুন্দরবনের জীবনযাপনের কথা শুনলাম। এই জি প্লট দ্বীপ টা হলো শেষ জনবসতির দ্বীপ এই চালতাদুনিয়া নদী আরো কিছুটা যাবার পর জগদ্দল নদীতে মিশেছে এরপর কলস নদী হয়ে ঠাকুরানি নদী নাম নিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। আমরা ভেসে চলেছি মাঝে বনশ্যাম নগর, রাক্ষস খালি ও জয়শ্রী কলোনী হয়ে প্রায় ৭০ মিনিট পর অবশেষে ভুটভুটি তীরে এসে ঠেকলো চাঁদমারী ঘাটে। তখনো দুলোনি ভাব কাটেনি, সরু কাঠের পাটাতন দিয়ে অস্থায়ী বাঁশের হাতল ধরে চাঁদমারী খেয়াঘাটে পা ফেললুম।

    চারিদিকে জলরাশির মাঝে টুকরো সবুজ দ্বীপ এই জি প্লট। লম্বায় ১৭ কিমি আর চওড়া ১৮ কিমির মতো এই দ্বীপ। যার উত্তরে কৃষ্ণদাস পুর মাঝখানে ইন্দ্রপুর পূর্বে সীতারামপুর পশ্চিমে বুড়াবুড়ির তট আর দক্ষিণে গোবর্ধনপুর। আমাদের গন্তব্য এই গোবর্ধনপুরে ঝাউমন কুঠিরে। সবুজ গাছগাছালি মাঝে পিচ রাস্তা বরাবর চলেছি ভুটভুটি ভ্যানে । পাখিদের স্বাগতমের সুর ,ছায়া পড়া শান্ত পুকুরে হাঁসের দলের ডুব দিয়ে গুগলি খাওয়া আর অন্য দিকে ধানের খেত, মাটির বাড়ির, আর কিছু কিছু মিষ্টি জলের ভেড়ি। এখানে এই ভুটভুটি ভ্যান আর টোটোই ভরসা। প্রায় ৫০ মিনিট যাবার পর আমরা “ঝাউমন কুঠিরে” উঠলাম। ঘড়িতে তখন ১টা ছুঁই ছুঁই।

    একেবারে সামনের উঠান থেকে হলুদ সবুজে ধানজমি, হরেক রকম সবুজ গাছ গাছালির কোলের ভিতর এই ঝাউমন কুঠির। বারান্দা সহ দু কামরার ঘর। চারিদিকে নিরিবিলির মধ্যে অবকাশ যাপনের সঠিক ঠিকানা। আছে শুধু পাখির কোলাহল। আগে থেকে কুঠিরের পরিচালক জন্মেঞ্জয় দা কে বলা ছিল বলে আমাদের দুপুরের আহার তৈরী । সামনেই পুকুরে স্রান সেরে একবারে বাঙালির দুপুরের ভোজন মাছ ভাত। একটু গড়িয়ে বেরিয়ে পড়লুম পায়ে পায়ে সমুদ্রের ধারে। গ্রামের ভিতর দিয়ে নাক বরাবর রাস্তা সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। দুপাশে গেয়ো গরান শ্বাসমূল ঝাউ প্রভৃতি গাছের আধিক্য। গত আম্ফানে অনেক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে যেগুলো নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না সত্যি এরা কত কষ্ট করে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে আছে। তবে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে। সরকারী ভাবে হয়তো এই নিয়ে ভাবনা চিন্তা চলছে যে আরো কি করে এই সব জায়গার উন্নতি করা যায়। আমরা এখন নোনাবালির পটভূমিতে, দেখি আকাশের বাঁধন ছাড়া রঙ।

    মন নিয়ে আঁকতে বসি রঙিন মুহূর্ত গুলো চারিদিকে পাহারা দিচ্ছে নির্জনতা, বেলাশেষে আকাশের রঙ মিশে যায় দিগন্তে। এখন তো ভাঁটা চোখ থেকে সরে যায় ঢেউ গুলো অনেক দূরে, সন্ধ্যা নামে তীর বরাবর। জোয়ার আবার আসবে হয়তো ভোর রাতে। মেঘেরা ভিড় জমাতে শুরু করেছে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ তখন লুকোচুরি খেলছে মেঘের সঙ্গে, কিছু পর জোৎসনার লুটোপুটি সাগরের বুকে সে এক আলাদার অনুভূতি তরে তরে উপভোগ করছি। সত্যি মন মাতাল করা অনুভূতি । যেহেতু এখানে গুটি কয়েক পর্যটকের আগমন হয়েছে সেহেতু এটা অন্য বেলাভূমির থেকে একবারে ব্যতিক্রমী। আমরা তাঁবু নিয়েও গিয়েছিলাম যদি বেলাভূমিতে একরাত কাটানো যায় কিন্তু সাময়িক সমস্যার জন্য থাকতে পারিনি যাই হোক । এবার ফিরতে হবে “ঝাউমনে”।

    পরদিন খুব ভোরে বেরিয়ে পড়লাম পুব দিকের সমুদ্রের পাড়ে যাতে সূর্য উদয় দেখতে পাই। কিন্তু বাধ সাধলো সেই মেঘবৃষ্টি। তবে ঘন কালো মেঘ আকাশের সঙ্গে সমুদ্রের রূপ মিলেমিশে এক ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ যা আমার এই প্রথম দেখা । শুরু হলো মেঘবৃষ্টির সঙ্গে সমুদ্র ঢেউয়ের উদ্দাম প্রেম, সেই লাগামছাড়া প্রেম ছাপিয়ে যায় তীর ভূমিতে ………………না এই প্রেম সন্মন্ধে আমার দ্বারা লেখা সম্ভব নয়। তখন আমি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির পেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র দেখছি। বৃষ্টি আসে ঝম ঝম করে,খুব একজনের ডাকে তার মাটির সংসারে ঢুকে পড়লাম বৃষ্টিভেজা বাঁচতে। ওদের সুখ দুঃখ নিয়ে আছে বেশ।

    এখানে মনে হয় সবাই যেন সবার আত্মীয়। যখন বৃষ্টি থামলো আমি বাঁধ বরাবর ফিরে আসি ঝাউমনে। ফেরার সময় রামকৃষ্ণ মিশন দেখলাম। ঐ সংস্থা বিপদ আপদে সুখ দুঃখে এই গোবর্ধনপুরের মানুষজনের পাশে থাকে। গরম গরম লুচি তরকারি সহ প্রাতঃরাশ সেরে এবার আমরা যাবো গ্রামের পশ্চিম দিকে সমুদ্রের ধারে। পড়ে থাকা এক অজানা সোনালী সৈকতে গায়ে কাশফুলের সমাহার, জোয়ারে ঢেউ গুলো আছড়ে পরে একের পর এক। নোনা জলে পা ভিজিয়ে ঢেউ গুনতে থাকি। রঙ বেরঙ ঝিনুকের ঝিকিমিকি । স্থানীয় কিছু ছোট ছেলে মেয়েরা ঝাঁপাই ঝুড়ে। তবে আম্ফানে বেশীর ভাগ ঝাউ গাছে ভেঙে পড়ে আছে। দূরে ধনচি দ্বীপের রেখাপাত যেখানের রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিশ্ব বিখ্যাত।

    আজ দুপুর আড়াইটার সময় ফেরার ভুটভুটি পাথর বাজার যাওয়ার , এটাই শেষ ভুটভুটি । তাই দুপুর দুপুর টোটো করে খেয়া ঘাটে । এবার যে ফিরতে হবে এই স্বপ্নের দ্বীপ ছেড়ে । ভুটভুটি ছেড়ে দিলো ফিরে তাকাই সেই মায়ার জগৎ টা কে । দুদিনের জন্যও করানো মুক্ত দ্বীপে এসে বুকভরে অক্সিজেন নিয়ে ফিরছি । আবার সেই কংক্রিট জগৎ আবার সেই ১০-৬ অফিস ।



    Related Posts

    Comments

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    সেরা পছন্দ

    কতদিন বৃষ্টি চলবে দক্ষিণবঙ্গে ? জানাল আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : ঝাড়খণ্ডের উপর তৈরি হওয়া নিম্নচাপের জেরে বিগত ক’দিন ধরে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে...

    ‘‌ফেলো কড়ি , পাও পঞ্চায়েতের পদ’‌ ! বিস্ফোরক দাবি তৃণমূল বিধায়কের

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : এবার বিস্ফোরক অভিযোগ তুললেন তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক ইদ্রিশ আলি। পঞ্চায়েত নির্বাচন মিটে গেলেও...

    বড় সিদ্ধান্ত মোদী সরকারের ! গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হতে চলেছে ‘বার্থ সার্টিফিকেট’

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : এবার থেকে বার্থ সার্টিফিকেটই হতে চলেছে সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট। কারণ ১ অক্টোবর থেকেই...

    চিনের কাছে ৫-১ গোলে হারল ভারত !

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : পেনাল্টি বাঁচালেন ভারতের (Indian Football Team) গোলকিপার গুরমীত। দুর্দান্ত গোল করে ভারতের হয়ে...

    বিশ্ব বাজারে রেকর্ড অস্ত্র বিক্রি করল ভারত !

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : আমদানি নয়, বিশ্ববাজারে অস্ত্র বিক্রির আশা শুনিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভারতীয় "প্রতিভা ও...