24 C
Kolkata
Tuesday, March 21, 2023
More

    চলুন ঘুরে আসি, হিমালয়ের স্বর্গোদ্যান বাগিনী -প্রদ্যুৎ কুমার দে

    দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরোঃ আমার প্রথম ভালোবাসা হলো পাহাড়। মধ্যবয়সী সংসারী হয়েও শত বাধা অতিক্রম করেও ভবঘুরে মনটাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি হিমালয়ের পথে পথে। যেখানে নিজেকে নিজে চিনে নেবার সুযোগ থাকে। তাই এবারেও বেড়িয়ে পড়লাম উত্তরাখণ্ডের বাগিনীর কোলে।
    আমাদের হোটেলের একবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জিপটা। স্যাকগুলো বাঁধাছেঁদা চলছে। কুকভাই কৈলাশের হাঁকডাক , আমরাও প্রস্তুত। যোশীমঠ থেকে ৪৫ কিমি দূরে জুমা যাবো। ঘড়ঘড়ানি শব্দে জিপ উঠে চলেছে, বাঁ দিকে রাস্তাটা গোবিন্দঘাট হয়ে বদ্রীনাথ গেছে, আমরা ডানদিকে বাঁক নিয়ে ম্যালোরীর দিকে চলেছি। পথের বাঁকে এক ঝলক নন্দাদেবীর দর্শন আমাদের যাত্রাকে আরো পবিত্র করে দিলো। পথে পড়লো ঢাক, এখান থেকে কুঁয়ারি পাস্ ট্রেক করতে হয়। আরো কিছুটা গিয়ে তপোবনে ক্ষনিকের চায়ের বিশ্রাম।


    বাঁ দিকে ধৌলীগঙ্গা বয়ে চলেছ, এই ধৌলীগঙ্গা বিষ্ণুপ্রয়াগে গিয়ে অলকানন্দার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।মাঝপথে সালদার কাছে রাস্তায় ধস নামার জন্য গাড়ি যেতে দেরি হবে , সারাইয়ের কাজ চলছে। অগত্যা নেমে একটু ইতি উতি, পাশেই একটা জং চাপা টিনের গায়ে লেখা আছে শুভাই গ্রাম হয়ে ভবিষ্যবদ্রির যাবার পথ। এটা হলো সপ্তবদ্রীর এক বদ্রী। প্রায় ঘন্টা খানেক পর রাস্তা খুললো। আমাদের অনেকটা পথ যেতে হবে। লতা, সুরাইথোটা , ফাগতি হয়ে দোলমা গ্রামের কাছে ধৌলীগঙ্গা পার হয়ে কিছুটা যাবার পর যখন জিপটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলছে তখনি বুঝলাম জুমা এসে গেছে। আর সোজা রাস্তাটা ম্যালারী হয়ে লাপথেল থেকে তিব্বতের সীমানা রিমখিম পর্যন্ত্য চলে গেছে। এখানে কোনো জনবসতি নেই, শুধু একটা রাস্তা নিচে নেমে গেছে ধৌলীগঙ্গার কোলে , তারপর একটা তারের ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে ওপাড়ে গিয়ে আমাদের ট্রেক শুরু বাগিনী হিমবাহ।


    এখান থেকে বাগিনী ২৮ কিমির মতো তবে আমাদের আজ গন্তব্য ৩ কিমি দূরে রুইঙ গ্রাম পর্যন্ত্য ওখানেই প্রথম দিন তাঁবু খাটাবো। ধৌলীগঙ্গা কে বাঁ দিকে রেখে জুনিপার,বুনো গোলাপ ঝোপ জঙ্গল পেরিয়ে চড়াই ভাঙা শুরু। রুইঙ গ্রাম থেকে ডানদিকে আরো ২ কিমি গেলে কাগা গ্রাম। ঘন্টা খানেক হাঁটার পর রুইঙ গ্রামে (৯১৮০ ফুট) পৌঁছে গেলাম। খানিকটা সমতল জায়গায় সবুজ ঘাসের গালিচায় আমাদের তাঁবু খাটানো হলো। পাশে পড়ে আছে কত অজানা সব ফুল, এখানে গাছে গাছে পাখিদের গান শোনা যায় এবং দূরে বরফ পাহাড়ের হাতছানি এক স্বপ্নের উঠানে হাজির করায়। কৈলাশ ভাইয়ের হাতে গরম গরম চা খেয়ে, সুন্দর ছোটো রুইঙ গ্রাম দেখতে বেরোলাম।

    তবে বেশির ভাগ বাড়ি ভাঙাচোরা অবস্থাতে আছে। পুরো গ্রামটাই একটা থমথমে ধ্বংসপুরী মনে হবে। প্রায় প্রত্যেক বাড়ির দেওয়াল পাথর মাটির আর কাঠের পাটাতন দিয়ে ছাদ , কারুকার্য করা কাঠের দরজা তার ওপর কুকরি বাকরি ফুল আর গোবর দিয়ে আল্পনা দেওয়া। এখনো গ্রামের লোক আসেনি। শঙ্কার সিং রাউত এর সঙ্গে পরিচয় হয়ে জানলাম এখানকার মানুষজন সব শীতের সময় চামোলি চলে যায় আবার গরম অর্থাৎ মে – জুন মাসে ফিরে এসে ভাঙাচোরা বাড়িঘর নতুন ভাবে সাজিয়ে তোলে। এরা চাষবাস ও ভেড়ার উল দিয়ে কাঁথাই করে জীবন যাপন করে। একদম শেষে এক মন্দির দেখে এগিয়ে গেলাম, যদিও মন্দির বন্ধ ছিলো এখানে পূজিত দেবতা হলো ভৈরব। আষাঢ় শ্রাবণ মাসে এই দেবতার উপলক্ষে ঘর ঘর উৎসব হয়।


    আজ ৮ কিমি যাবো দ্রোনাগিরি গ্রামে ওটাই এই পথের শেষ গ্রাম। ঘন পাইন জঙ্গল চিরে সরু রাস্তা উপরে উঠে গেছে এঁকে বেঁকে , চড়াই উৎরাই পেরিয়ে হেঁটে চলেছি। কিছুটা যাবার পর একটা রাস্তা অনেক অনেক নিচে চলে গিয়ে ছোট কাঠের পুল পেরিয়ে আবার বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে সামনের পাহাড়টাকে বেড় দিয়ে গড়পক গ্রামে গিয়েছে ওখান থেকে কানারি খাল হয়ে দ্রোনাগিরি যাওয়া যায় তবে আমরা সহজ পথ ধরলাম ডানদিকে। ধীরে ধীরে পাইন ছেড়ে ভুজ গাছের জঙ্গলে প্রবেশ। পায়ে তে শুকনো পাতার খসখসানি আওয়াজ মাথার ওপর রঙ বেরঙের পাতা আর ফুলে ফুলে ভরা , সঙ্গ দিয়েছে পাখিদের গানের মহড়া, তার ওপর ভেজা ভেজা জঙ্গলের সোঁদা গন্ধ যেন আমাকে মাতাল করে দিচ্ছে। প্রায় ৬ কিমি যাবার পর একটা ছোট সমতল জায়গা, গোলাপী রোনডেনড্রন ঝোপের আড়ালে হালকা বিশ্রাম। ঠিক দ্রোনাগিরির আগেই একটা বড়ো ধস নেমেছে, শুনলাম এখানেই প্রতিবছর ই ধস নামে কারণ নন্দীকুন্ড এলাকার হিমবাহ এসে এই জায়গায় বাগিনী নদীতে মেশে।

    যাইহোক আমাদের পেরোতেই হবে। যেখানেই পা ফেলি পায়ের তলার ঝুরো মাটি সরে যাচ্ছে , খুব সাবধানে গাইড ভাইয়ের সাহায্যে পার হলাম। এবার একটা খাড়া পাহাড় টপকে বাঁদিকে ঘুরতেই এক নতুন দিগন্ত। পিছনেই তুষারাবৃত পর্বতের সমাহার ডানদিকে দ্রোনাগিরি পর্বত আর হলুদ সবুজ ঢালে ঢালে কাঠ পাথরের ঘর আর উপরে ছোট ভুমিয়াল দেবতার মন্দির নিয়ে দ্রোনগিরি গ্রাম (১১৮৪০ ফুট)। রুইঙ এর মতো প্রতিটা বাড়ি নকশা করা কাঠের দরজা, দেখে মনে হয় এক কালে বর্ধিঞ্চু গ্রাম ছিলো, শুনলাম অতীতে তিব্বতের সঙ্গে ব্যবসা জন্য এই গ্রাম গুলি গড়ে উঠেছিলো তবে এখন ধংসপুরী মনে হবে। এখানে মূলতঃ রাউত কুঁয়ার ঠাকুর সম্প্রদায় লোকের বসবাস। চাষবাস ও পশুপালন ই এদের প্রধান জীবিকা। সারা গ্রামে শুধু একটাই পরিবার আছে সুন্দর সিং ঠাকুর গরম চা এর আমন্ত্রণে পায়ে পায়ে তার বাড়ির উঠানে হাজির। দূরে পঞ্চায়েত এর ঘর ও গাড়োয়াল মন্ডলের ঘর থাকলেও কেউ না থাকার জন্য বন্ধ আছে। তবে তাঁবু খাটাবার সমতল জায়গা কিছুটা আছে তাই আজ এখানে রাত্রিযাপন।


    পাখির ডাকে খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো আমরা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে হাঁটা শুরু করে দিলাম। গ্রাম ছাড়িয়ে একটা ঢাল ধরে বরাবর উপরে উঠতে থাকলাম , শুরুতেই দমফাটা চড়াই চারিদিকে বুনো গোলাপের জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা চলে গিয়েছে। গাছে গাছে কত রকমের পাখি এতোই কাছে আসছে যেন মনে হবে আমাদের সঙ্গে কতদিনের বন্ধুত্ব। আমরা এখন অনেকটা ওপরে উঠে এসেছি , পাখির চোখে দ্রোনাগিরি যেন এক পাল্টে যাওয়া ল্যান্ডস্কেপ, ঢালটা টপকে এবার আমরা গোলাপী সাদা রনডেনড্রনের রাজত্বে ঢুকে পড়েছি। সামনেই মেঘের আড়ালে ঋষি আর সাফমিনাল পর্বতের লুকোচুরি খেলা চলছে। অনেক নিচে দিয়ে সুতোর মতো বাগিনী নদী কে দেখছি যেন এক নক্সা কাঁথার বুনোন। নদীর ও পাড় থেকে এই বিরাট দৈত্যকায় পাহাড় দাঁড়িয়ে ওটার মাথার ওপর কানারি খাল। এবার আমাদের নামার পালা নিচে একটা ছোট সিমেন্টের সেতু পেরিয়ে চলেছি এটা প্রায় প্রতি বছর ভেঙে যায় , বাগিনী এখানে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে চলেছে। মাথার উপর মেঘের মেঘেদের জটলা শুরু আর পায়ের তলায় হলুদ ঘাসে বেগুনির ফুলের ছটা পাশেই বড়ো বড়ো নুড়ি পাথর পেরিয়ে এবার বিপদ সঙ্কুল পথ বেয়ে আবার ওঠা। পাহাড়ে এই ওঠা নামার মধ্যে আলাদা আনন্দ আছে , এখন আমরা সেমখড়ক প্রায় ৪ কিমি এসে গেছি। আজ আমরা যাবো লাঙ্গাতোলি।


    ঘন কালো মেঘ আমাদের পিছু নিয়েছে। আমরাও যত সম্ভব তাড়াতাড়ি এগোতে থাকলাম ,আমরা এখন মেঘে মাখামাখি , কিছুই দেখা যাচ্ছে না শুধু আবছা আবছা গাইড পোর্টার রা এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের শুধু অনুসরণ করছি। শুরু হলো বরফ বৃষ্টি , আর এই বৃষ্টি মেখে হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করতে করতে লাঙ্গাতুলিতে(১৪১৭৭ ফুট ) পৌঁছালাম ঘড়িতে তখন বেলা ১২টা , আজ আমরা নয় নয় করে ৬ কিমি এসে গেছি। গাইড ভাই বললো মৌসুম খারাপ হ্যা তাই আজ এখানেই তাঁবু খাটানো হোক।অসাধারণ জায়গা এই লাঙ্গাতোলি,অনেকটা সমতল , এঁকে বেঁকে এসে বাগিনী যেনো তার কোলে হলুদ বেগুনি ফুলের আঁচল পেতে রেখেছে যার পাড় লাল জুনিপারের জঙ্গল। আমরা পুরো এখন মেঘ মুলকে যা কিছু দেখি শুধুই সাদা আর সাদা আর তার মধ্যে তাবু আর মানুষ জন সিলুট। বৃষ্টির জন্য দলবেঁধে বাড়ী ফেরার তাড়া ভোরালদের। আহা মন ভরিয়ে তোলে প্রকৃতির রূপে।


    কোলকাতার বৃষ্টি মানেই তো এক হাঁটু জল জমা আর ফ্ল্যাটের জানলার বাইরে ঘোলাটে আকাশ। এখানে প্রকৃতির কোলে বসে প্রকৃতির আর এক রূপ বৃষ্টিকে দেখছি প্রাণভোরে যেখানে নদী আছে পাহাড় আছে আছে জঙ্গল না না আমি লিখে বোঝাতে পারবো না, বৃষ্টি বাড়তে আমরা তাঁবুর ভিতর আশ্রয় নিয়েছি কৈলাশ ভাই গরম চা আর চিড়েভাজা নিয়ে হাজির। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা এলো মেঘের কোলে বৃষ্টি তো আছেই ,রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি ও বাড়ছে জল জমে যাওয়ায় গাইড ভাই আমাদের তাঁবুর পাশে তার আইস এক্সে দিয়ে জল বেরোবার পথ করে দিচ্ছে , মেঘবৃষ্টির খেলা চলছে, মনে হয় আজ বর্ষা নেমেছে তাই আমাদের খিচুড়ি রান্না হয়েছে তাই খেয়ে স্লিপিং ব্যাগে। বাগিনীর কুলু কুলু আওয়াজ সময়ের তালে তালে বেড়ে চলেছে, যেন প্রকৃতির বাদ্যযন্ত্র বাজছে তাই শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমের দেশে চলে গেছি তা জানি না।


    আজ এক সুন্দর নির্মল সকাল, না ভোর বললেই ভালো হয়। কাল তো কিছুই লাঙ্গাতুলী রূপ দেখিনি শুধু অনুভব করেছি কিন্তু আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে সেটা হলুদ সবুজ চকচকে প্রকিতির উঠান যার সঙ্গে গাছ পাখি ফুল অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িয়ে সামনেই হরদেউল ঋষি সাফিনালের পর্বতের হাতছানি| ডানদিকে ঘন সবুজ জঙ্গলের উপরেই দ্রোনাগিরির পর্বত শুভ্র মুটুক পরে দাঁড়িয়ে। আর বাঁদিকে বুনো গোলাপের জঙ্গল। আজ আমরা যাবো ৫ কিমি দূরে লোয়ার বাগিনীতে। জুনিপার আর গোলাপের ক্যানভাস ছেড়ে আমরা এখন আমরা নুড়ি পাথরের দেশে। এবার শুধু ওঠার পালা শুধুই উঠে চলেছি সামনে একটা বড়ো নালা অতি সাবধানে পেরোলাম যেটা হলো গরুড় নালা। যতই ওপরে উঠছি পিঠের বোঝা যেন আরো ভারী মনে হচ্ছে তবে সব ক্লান্তি ধুয়ে মুছে যাচ্ছে তখনই যখন সাফমিনাল,ঋষি যেন হাতের মুঠোয়, বাঁদিকে কোনে হরদেউল উঁকি মারে পাশেই পূর্ব দ্রোনাগিরি সঙ্গ দেওয়া।


    হটাৎ দেখি সারা আকাশ জুড়ে পুব থেকে পশ্চিমে রামধনু দেখা দিয়েছে , সত্যি আমি কি দেখছি নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছি না আহা কি অনুভূতি। একবার পিছন তাকাতেই সবুজ কার্পেটের মোড়া লাঙ্গাতুলি আর দূরে হাতি,ঘোরী আরো কত অজানা পর্বতের দর্শনে যেন চোখ মন জুড়িয়ে যায়। আরো কিছুটা গিয়ে একটা বিশাল পাথরের গায়ে বিশ্রাম নিলুম। এখনো প্রায় ২ কিমির মতো যেতে হবে। অবশেষে দুপুর ১ টার সময় পৌঁছে গেলাম। মালবাহকেরা আগে এসে তাঁবু খাটিয়ে দুপুরের খাবার তৈরী করতে ব্যস্ত । একদম ছোট কয়েকটা তাঁবু খাটাবার জায়গা আছে। তবে আরো ২ কিমি এগিয়ে গেলে বাগিনী খালের কাছে তাঁবু করা যাবে সেক্ষেত্রে জলের অভাব হবে। প্রকৃতির রূপ বদলাতে শুরু করলো। কালো মেঘে ঢেকে যাওয়া বাগিনী তখন এক রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে। মেঘের মলাটে মন তখন নানান আঁকিবুকি এঁকে চলেছে শুরু হলো বৃষ্টি। প্রানভোরে হিমালয়ের এই মায়াবী রূপ অনুভব করছি। না কাল খুব তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে তাই আজ তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঠান্ডার প্রকোপে ঘুম আসে না। তাঁবুর বাইরে হওয়ার সোঁ সোঁ আওয়াজ যেন মনে হয় তাঁবু না উড়িয়ে নিয়ে যায় যদিও আমরা একটা পাথরের আড়ালে তাঁবু খাটিয়েছি। কিন্তু ঠান্ডার প্রকোপে ঘুম আসে না , কাল যাবো বাগিনী খাল হয়ে বাগিনী হিমবাহ যেটা অপার বাগিনী বলে।


    খুব ভোরে উঠে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তা খুব একটা চড়াই নয় হালকা চালে চলেছি। চ্যাঙব্যাঙ ও ত্রিশুলি পর্বত থেকে এক বিশাল আকারের হিমবাহ নেমে এসেছে যেটা বাগিনী নাম পরিচিত। তারপর পূর্ব দ্রোনাগিরি থেকে দ্রোনাগিরি হিমবাহ এসে মিশে বাগিনী নদী হয়ে ধৌলি-গঙ্গাতে মিশেছে। হ্যাঁ আমরা এখন বাগিনী হিমবাহের কাছে। এতো কাছ থেকে এইরকম ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ দেখবো স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। হরদেউল এর গা দিয়ে সূর্যোদয় হলো যার ছটা গিয়ে সাফমিনাল, দ্রোনাগিরিকে রাঙিয়ে দিলো আর সিলুটে হারদেউল এক অপরূপ দৃশ্য। আমরা তো এখন হিমালয়ের স্বর্গোদ্যানে। অনেকটা সমতল জায়গা একপাশে পাথর দিয়ে ছোট মন্দিরের মতন করা আছে সেখানে ধুপ আর কিশমিশ দিয়ে পুজো করা হলো। বাঁদিকে হরদেউল। একেবারে সামনে ঋষি (২২৯৪০ফুট ), সাফমিনাল(২২৬৭৫ ফুট), আর ডানদিকে বাগিনী ,পূর্ব দ্রোনাগিরি আরো সব কত নাম সব নাম না জানা শিখর। হিমালয়ের এই ধ্যানমগ্ন রূপ দেখে এক অসীমের অনুভব হলো। মন এখানে নির্মল হয় এখানেই আমার ঈশ্বর দর্শন। এই ঈশ্বরীয় আনন্দে আমার চোখে তখন জল।


    চারিদিকে নীরবতার মাঝে ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ যেন আমার বাকি জীবনের রসদ জোগাড় করে নিচ্ছি। নিস্তবতা ভেঙে গাইড ভাই বললো চলো আমরা আরো দু কিমি এগিয়ে সামনের ওই পাহাড়ের ওপরটায় যাবো। দমফাটা চড়াই পেরিয়ে চলেছি। যে পথ হাঁটায় প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা মিশ্রিত এক ভালোলাগা জড়িয়ে আছে। একসময় হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে গেলাম যেটা প্রায় ৮০ % ঢাল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে গায়ে কাঁটা দেবার অনুভূতি। সামনেই অনেক নিচে চলে গেছে ভয়ঙ্কর খাদের কিনারায়। এখান থেকে কলঙ্ক পর্বত আর চ্যাঙব্যাঙ পর্বত সুন্দর দৃশ্যমান। কি অসাধারন রূপ তা বলে বোঝাতে পারবো না। এই শিখরের এক বৈচিত্র আছে এক বৈশিষ্ট আছে তার গড়নের জন্য। একটা বই তে পড়েছিলাম অনেক চেষ্টার পর ইন্দো ব্রিট্রিসের এক দল ১৯৭৪ সালে এই ২২৫২০ ফুট চ্যাঙব্যাঙ শিখর অভিযানে সফল হয়েছিলো। আর কলঙ্ক (২২৭৪০ ফুট) প্রথম আরোহন করেন এক জাপানী দল ১৯৭৫ সালে। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এদের রূপ দর্শন করবো ।তাই তো হিমালয়ের এই রূপ দেখে মন ফিসফিস করে আমাকে বললো অনুভূতি আর উপলব্ধি কে নিয়ে এসে কথা বলাও।


    এই রূপের উপলব্ধি আমার ভাষায় নেই। এই হিমালয় শুধু আধ্যাত্মিক নয় ,মানসিক দিক থেকে অনেক অনেক দৃঢ় করে। সত্যি এটা আমার জীবনে চাওয়া পাওয়ার থেকে বেশী। যখন আমাদের সঙ্গে এই ৭১ বছরের বলবীর জি গাইড হিসাবে যোগ দিলো তখন আমাদের মনে একটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছিলো কিন্তু সে প্রশ্ন যে ভুল তা প্রতি পদে পদে বুঝেছি। যখন তার জন্যই আমরা এই স্বর্গউদ্দ্যানে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিই অনুভব করছি। হ্যাঁ তার জন্যই আমরা ভয়ঙ্কর ধস পেরিয়ে এসেছি, হ্যাঁ তার জন্যই আমাদের মনের ক্ষিদে মেটাতেই চ্যাঙব্যাঙ বেস ক্যাম্প গিয়েছি যদিও স্থানীয় চলতি কথায় এটাকে চ্যাঙব্যাঙ বেস ক্যাম্প বলে, আসলে যে দিক দিয়ে আরোহন করা হয়েছে সেটা নন্দাদেবী স্যাংচুয়ারির দিকে। আমাদের থেকে এখনো বলবীর সিং শতগুণ ফিট আছে শারীরিক ভাবে । পরে শুনেছিলাম উনি কামেট অভিযান করেছিলেন এ ছাড়া আরো বড় বড় শিখর অভিযানের সঙ্গী ছিলেন। বলবীরজী না থাকলে হয়তো আমাদের লোয়ার বাগিনী থেকে ফিরে আসতে হতো। দেখলাম তো অন্য ট্রেকার্স দল লোয়ার বাগিনী থেকেই ফিরে যাচ্ছে। যাই হোক এবার আমাদের ফেরার পালা। ৩ দিনের মাথায় যোশীমঠ হয়ে হরিদ্বার সেখান থেকে ট্রেনে আমার কংক্রিটের জঙ্গলে। সারা বছর ধরে কম্পিউটার স্ক্রিনে দেখে দেখে মনের ক্ষিদে বাড়িয়ে পরের বারের জন্য তৈরী হবো প্রকৃতির উঠানে আসবো বলে।

    Related Posts

    Comments

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    সেরা পছন্দ

    সরে গেল ‘এটিকে’ , পরের মরশুমে ঝড় তুলতে আসছে ‘মোহনবাগান সুপার জায়ান্টস’

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে বড় ঘোষণা করলেন সঞ্জীব গোয়েঙ্কা। মোহনবাগানের নামের শুরু থেকে সরে গেল...

    ভারতসেরা ‘মোহনবাগান’ ! বাঙালির গর্বের দিন

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : চাপ বনাম পাল্টা চাপ। পেনাল্টি বনাম পাল্টা পেনাল্টি। অফুরান দৌড় আর স্কিলের ফুলঝুরি দেখাতে...

    ISL চ্যাম্পিয়ন এটিকে মোহনবাগান

    দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : আই এস এল ফাইনালে রুদ্ধশ্বাস জয় ছিনিয়ে নিলো এটিকে মোহনবাগান । বেঙ্গালুরু এফসিকে টাইব্রেকারে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো...

    বাড়িতে আনুন বেশকিছু হোমিওপ্যাথি ঔষধ , পাবেন বহু সমস্যা মুক্তি

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : হোমিওপ্যাথি এক পুরনো চিকিৎসা পদ্ধতি। আয়ুর্বেদের সঙ্গেও এই চিকিৎসা পদ্ধতির বেশ কিছু মিল...

    বড় বড় মার্কিন ব্যাংকের পতন ! আসছে মহামন্দা ?

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক এবং সিগনেচার ব্যাঙ্ক – পর পর দুই বড় মাপের মার্কিন ব্যাঙ্কের...