সকলেই দারিংবাড়িকেই ওড়িশার কাশ্মীর নামে চেনেন । তাই যারা সেখানে যান তারা দু একটা ছোটো ওয়াটার ফলস আর পাইন বন দেখেই চলে আসেন বেশির ভাগ সময়। কিন্তু এখানকার আসল সৌন্দর্য্য লুকিয়ে আছে ছোটো ছোটো পাহাড়ি গ্রামে যেমন ডোনিংবাড়ি (Don’t confuse with Daringbari), জাকেসি, সাল্কিবাড়ি , রানিপাঙ্গা প্রভৃতি জায়গায় ,সেখানকার না বোঝা সহজ সরল মানুষের মুখের ভাষায় আর পাখিদের কলরবে !


এখানকার মাটি প্রধানত লাল আর পাথুরে। লাল মাটি বর্ষায় খুবই বিপজ্জনক, বার বার গাড়ির চাকা বসে গেল ,! পাথর জোগাড় করে চাকার তলায় দিয়ে তবেই উদ্ধার প্রাপ্তি ! লাল মাটি খুব আঠালো হয়, কিন্তু তা যে এত বিপজ্জনক সেটা জানা ছিলো না। স্করপিওর পিছনের চাকা মাটিতে বসে যাওয়ায় পাথর সংগ্রহ করতে গিয়ে হাইকিং সু’তে আটকে গেল প্রায় কেজি দুয়েক কাদা। এদিকে মাথার উপর অঝোর বৃষ্টি আর পায়ের নিচে লাল কাদার ভার, কয়েক বার তো মনে হলো সমূহ বিপদ আসন্ন ।
জনমামবহীন এই ধু-ধু প্রান্তরেই জীবন কাটাতে হবে। হাতে দুদিনের খাবার , গাড়িতে কন্টেনারে অতিরিক্ত ১৫ লিটার ডিজেল (কারন জনমানবহীন পাহাড়ে পেট্রোলপাম্প নেই) আর পানীয় জল সঙ্গে থাকায় ভয় ছিলো না। কিন্তু সমস্যা একটাই মোবইল নেটওয়ার্ক ও জিপিএস না থাকা ।চারিদিকে শুধুই প্রকৃতির অপার অপার্থিব সৌন্দর্য ,পাখিদের ডাক আর আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজ পাহাড়ে চোঁখ আটকে থাকে । এই জায়গার সৌন্দর্য্য চাক্ষুস করতে আসতে হবে বর্ষা কালেই । বর্ষার পাহাড় আর সবুজ বনানী সবুজতর হয়ে হাতছানি দিচ্ছে,। শীর্ণ কায়া নদী পাহাড়ের প্রতিটি বাঁকে উঁচু পাথরের বেষ্টনীকে অগ্রাহ্য করে ঝাঁপ দিচ্ছে সমতলের দুর্নিবার আকর্ষণে। যদি পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক নির্ভুল ভাবে গন্তব্যে পৌছে যান জায়গাটার মাহাত্ম্য উপভোগে বঞ্চিত হবেন সে কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা ।পাহাড়ের প্রতিটা চড়াই উৎরাইয়ে থমকে দাঁড়াতেই হয় অপার্থিব সৌন্দর্য্য দর্শনে । একাধিকবার দারিংবাড়ি যাওয়ার সুবাদে আলাদা করে বলার মতো কিছুই মনে হয়নি। ভাবছেন গুগল ম্যাপে ডেস্টিনেশন সেট করে নিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়, কিন্তু এই সাময়িক হারিয়ে যাওয়াতেই আমার আনন্দ । তবে জিপিএস নেভিগেশন সেট করিনি তা নয়, কিন্তু গন্ডগোল বাধল মাঝ পথে ।জাকেসি যাওয়ার পথে একটি ছোট নদী পড়ে। সেই নদীর উপর একটি নির্মীয়মান ব্রীজকে গাড়ি নিয়ে অতিক্রম করা গেলনা আর তখনই জিপিএস হাল ছেড়ে দিলো। গাড়ি নিয়ে ব্রিজের দিকে একটু এগিয়েই বিপদ বুঝেই ব্রেক করলাম, কিন্তু আঠালো কাঁদা মাটির টান আর ঢালু জায়গা দিয়ে নদীর দিকে হরকাতে হরকাতে কিছুটা নেমে আঠালো মাটিতে আটকে গেল । আমরা নাস্তিক মনে ভয় থেকে ভক্তির উদ্রেক হলো। জয় বজরংবলী বলে ব্যাক গিয়ার দিতে দেখি পেছনের চাকাটাই শুধু ঘুরছে একটা গর্তের মধ্যে ! কোনো উপায় না দেখে গাড়ি থেকে নেমে এলাম । নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষন । তারপর বানর সেনার মতো পাথর সংগ্রহে মনোনিবেশ করলাম। চাকার নীচে পাথর সাজানো যখন সম্পূর্ণ তখন দেবদূতের মতো দুটি স্থানীয় মানুষকে দেখতে পেলাম। অনুরোধ করায় তারা আর আমার এক সহযাত্রী গাড়ির পেছনের বাম্পারে দাঁড়ালো, আর আমি প্রাণপণ ব্যাক গিয়ারে অ্যাক্সেলারেট করতে গাড়ি প্রায় ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে কিছুটা স্বস্তিকর জায়গায় চলে এলো। সে যাত্রায় উদ্ধার পেলাম । এরপর শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টিতে জনমানবহীন প্রান্তরে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগের পালা। দুই দিন পথ হারানোই


শাপে বর হলো! হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং তাই অনেক ছবি তোলার সুযোগ হাতছাড়া হল বিশেষত হরিণ ।কিন্তু লাগামহীন ঘোরা আর স্থানীয় মানুষের আতিথ্য সে অসম্পূর্ণতা পূরণ করে দিলো।
আসলে দারিংবাড়ি বাজারের রাস্তার ধারে বিক্রি হওয়া পকোড়া আর সুজি দিয়ে তৈরি একটা স্থানীয় খাবার ‘ টাকরা’ খেতে খেতে গাড়ি নিয়ে সাইলেন্ট ভ্যালির রাস্তা ধরে ঢুকে গিয়েছিলাম ।দিকভ্রান্তের ন্যায় পাহাড় থেকে পাহাড়ে দুই রাত গাড়িতে কাটিয়ে ফিরে এলাম । দারিংবাড়িতে অনেক হোমস্টে ,হোটেল বা রিসোর্ট আছে চাইলেই সেখানে আরাম করে কাটিয়ে দেওয়া যায় । কিন্তু আমি চেয়েছিলাম নির্জন পাহাড়ে একটু হারিয়ে যেতে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য । নাম না জানা সব পাহাড় , ছোট ছোট গ্রাম , হরিনের দল ,পাখিদের কলতান, সরল মানুষজন আর তাদের দুর্বোধ্য ভাষা ,এক নতুন আত্মপোলব্ধি । ডোনিংবাড়ি ।