দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরোঃ
স্ট্র্যান্ড রোড হাওড়া স্টেশনে যাওয়ার সময় বা এমনি হুগলি নদীর ধারে বেড়াতে গেলে আমরা বেশ কয়েকটি মনোরম ঘাট দেখতে পাই। পাড়ার বা বাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জনের সময়েও আমরা মূলত এই ঘাটগুলিতেই এসে থাকি। তবে এই ঘাটের ইতিহাস হয়তো আমাদের জানা নেই । প্রায় দুশো বছর ধরে এই ঘাটগুলি বহু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আসুন আজ একটু হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত এই ঘাটগুলিতে ঘুরে আসি ।
১ : প্রিন্সেপ ঘাট –
জেমস্ প্রিন্সেপ ছিলেন একজন বিখ্যাত অ্যাংলো -ইন্ডিয়ান পন্ডিত । ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন তিনি। এসিয়াটিক সোসাইটির সাময়িক পত্রের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। সম্রাট অশোকের ব্রাহ্মি লিপির সংকেতের অর্থ উদ্ধার করেছিলেন তিনি। এই ঘাটটি ১৮৪১ সালে এই তৈরি করে ব্রিটিশ সরকার। ১৮৪৩ সালে জেমস্ প্রিন্সেপের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই ঘাটের প্যালাডিয়ান বারান্দাটি নির্মাণ করেন ক্যাপ্টেন ডাব্লু. ফিট্সগেরাল্ড।গথিক ও গ্ৰীক কারুকার্যে পরিপূর্ণ এই বারান্দাটি। দেখলে অনেকটা বার্লিনের ব্র্যান্ডেনবার্গ গেটের মতো মনে হয়। রাতের আলোয় দারুণ লাগে দেখতে। ফোর্ট উইলিয়ামের ওয়াটার গেট এবং সেন্ট জর্জেস গেটের মাঝখানে এই ঘাটটি অবস্থিত। তবে সময়ের সাথে সাথে ঘাটের ধাপগুলি মাটির তলায় চলে গিয়েছে নদী হাওড়ার অপসৃত হওয়াতে। তাই আজ বারান্দাটি নদীর থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে। এই ঘাট আজ কলকাতা শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন।


২: জাজেস ঘাট –
স্যার ইলাইজা ইম্পে ফোর্ট উইলিয়ামের সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি ছিলেন। মহারাজা নন্দকুমারের বিরুদ্ধে ১৭৭৫ সালে এই ইম্পে রায় দিয়েছিলেন। তাই নন্দকুমারের সঙ্গে তিনিও ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছেন । ইম্পের অনুরোধে হুগলি নদীর পূর্ব দিকে এবং প্রিন্সেপ ঘাটের উত্তর দিকে কিছু গজ দূরে একটি নতুন ঘাট তৈরি করা হয়। এটি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল শুধুমাত্র সম্মানিত ব্রিটিশ আধিকারিকদের ব্যবহারের জন্য। বিচারকরাই এটি বেশি ব্যবহার করতেন। তাই এর নাম হয় জাজেস ঘাট। গোয়ালিয়র স্মৃতিস্তম্ভ কাছে থাকার জন্য এটিকে অনেকে গোয়ালিয়র ঘাটও বলে থাকে।
৩: উট্রাম ঘাট –
জেমস্ উট্রাম ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সেনার এক প্রধান ব্যক্তি। তাঁর নেতৃত্বে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের কাছ থেকে তাঁর স্বাধের লখনউকে নিয়ে নেয়ে। সত্যজিৎ রায়ের “সত্রঞ্জ কি খিলাড়ি” চলচ্চিত্রে এই ঘটনা আমরা দেখতে পারি। উনিশ শতকের শেষদিকে জেনারেল উট্রামের স্মৃতির উদ্দেশ্যে হুগলি নদীর পূবদিকে একটি ঘাট তৈরি হয়। এককালে এটি একটি প্রধান বন্দর ছিল। পূর্ববঙ্গ ও বর্মার জাহাজগুলির নোঙর ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা ছিল এই ঘাট। আজ ঘাটের ধার দিয়ে সুন্দর বাঁধানো রাস্তা রয়েছে। সেখানে গিয়ে বেঞ্চিতে বসলে হুগলি নদীর এক অপূর্ব ছবি দেখা যায়।
৪: বাবুঘাট ( বাজে কদমতলা ঘাট) –
১৮৩০ সালে জানবাজারের রাণী রাসমণি তাঁর স্বর্গত স্বামী বাবু রাজচন্দ্র দাসের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই ঘাটটি নির্মাণ করেন। কর্নেল মার্ক উডের ম্যাপ অনুযায়ী এটি ডিহি কলকাতার দক্ষিণ সীমানাকে নির্দিষ্ট করে। সেখান থেকে ডিহি গোবিন্দপুর শুরু হয়ে টালিগঞ্জের আদি গঙ্গা পর্যন্ত বিস্তারিত। ডরিক ও গ্ৰীক স্টাইলে তৈরি এটি। বড় বড় স্তম্ভের সাহায্যে এই ঘাটের পটমন্ডপটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। মহালয়ার দিনে পিতৃতর্পন থেকে শুরু করে প্রতিমা নিরঞ্জন মূলত এই ঘাটেই হয়ে থাকে।


৫: আর্মেনিয়ান ঘাট –
ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশদের সাথে সাথে আর্মেনিয়ানরাও এই শহরের উন্নতির জন্য অনেক কাজ করেছে। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মানভেল হাজার মালিয়া যাকে হুজুরি মল বলে অনেকে। তিনি মূলত মশলাপাতি ও দামী পাথরের ব্যবসা করতেন। ১৭৩৪ সালে তিনি এই ঘাটটি তৈরি করেছিলেন। মূলত বানিজ্যিক জাহাজের জন্য এই ঘাট ব্যবহার করা হতো। এই ঘাটে ঢালাই লোহার কারুকার্যের নিদর্শন পাওয়া যায়। ১৮৫৪ সালের ১৫ই আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানী হুগলি থেকে হাওড়া পর্যন্ত একটি ফেরি সার্ভিস শুরু করে। এটি ছিল তার টিকিট কাউন্টার। এখান থেকে টিকিট কেটে যাত্রীরা লঞ্চে করে হাওড়ায় যেত । পরে অবশ্য হাওড়ার পন্টুন ব্রিজ তৈরি হওয়ায় এই পরিসেবা বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ।
৬: মতিলাল শীল ঘাট –
এই মতিলাল শীল উনিশ শতকের ধনী ও বিখ্যাত বনীকদের মধ্যে অন্যতম। ব্যবসার সাথে সাথে সমাজের উন্নয়নের জন্য তিনি বেশ কিছু কাজ করেছেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ তৈরি করার জন্য তিনি তৎকালীন সরকারকে কিছু জমি দান করেছিলেন। সেখানে আজও তাঁর নামে একটি ওয়ার্ড রয়েছে। ১৮৪২ সালে তিনি তাঁর বাড়িতেই মতিলাল শীল ফ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি উনি হুগলি নদীর ধারে একটি স্নানঘাট নির্মাণ করেন। ক্লাসিক্যাল স্টাইলে এটি নির্মিত। কোরিন্থীয় স্তম্ভ এর প্যারাপেটের ভার বহন করছে।
৭: রামচন্দ্র গোয়েঙ্কা জেনানা ঘাট-
এটি এককালের সবচেয়ে সুন্দর স্নানঘাটের মধ্যে অন্যতম ছিল। মল্লিক ঘাটের পাশেই এটি অবস্থিত ।এই ঘাটের অপূর্ব গম্বুজগুলিকে হাওড়া ব্রিজে যাতায়াত করার সময় দেখা যায় । এটি শুধুমাত্র মহিলাদের স্নানঘাট ছিল। ১৮৮০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে এই ঘাটটি তৈরি করেছিলেন শ্রী রামচন্দ্র গোয়েঙ্কা।
৮: জগন্নাথ ঘাট –
হাওড়া ব্রিজের উত্তরে অবস্থিত এই ঘাটটিকে ১৭৬০ সালের কাছাকাছি কোনো এক সময় শোভারাম বসাক নামে এক ধনী ব্যবসায়ী তৈরি করেছিলেন। প্রথমে এর নাম ছিল শোভারাম বসাকের ঘাট। কিন্তু যেহেতু এই ঘাট সংলগ্ন একটি জগন্নাথ মন্দির রয়েছে তাই পরবর্তী সময় এর নাম হয় জগন্নাথ ঘাট। মন্দিরটিও শোভারাম বসাক তৈরি করেছিলেন কোনো এক সময়। ক্লাসিক্যাল ইউরোপীয় স্টাইলে এটি নির্মিত।
৯: ছটুলাল ঘাট –
জগন্নাথ ঘাটের পাশেই রয়েছে এই ঘাটটি। নির্মাতা হলেন ছোটেলাল দুর্গা প্রসাদ যিনি সেই সময় কলকাতা হাইকোর্টের একজন স্বনামধন্য উকিল ছিলেন। এই ঘাট তৈরির পিছনে একটি অদ্ভুত কাহিনী রয়েছে। লোকমুখে শোনা যায় যে ছোটেলাল বহুদিন নিঃসন্তান ছিলেন। একদিন এই নদীর পাড়ে একজন ফকিরের সাথে তাঁর দেখা হয়। সেই ফকির তাঁকে বলেছিল যে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর এই দুঃখ মিটে যাবে এবং তাঁকে এই নদীর তীরে একটি ঘাট তৈরি করতে হবে। সত্যি সত্যিই কিছুকাল পরে ছোটেলাল একটি পুত্রসন্তান লাভ করেন। ফকিরকে দেওয়া কথা অনুযায়ী তিনি তখন এই ঘাট তৈরি করেছিলেন।হিন্দু ও ইসলামী স্থাপত্যের মেলবন্ধন দেখা যায় এই ঘাটে। এর পাশে অবস্থিত মল্লিক ঘাট কলকাতার বড় ফুলের আরতের মধ্যে একটি।
১০: চাঁদপাল ঘাট –
সাধারণত কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা দেব দেবীর নামে একটি ঘাট তৈরি করা হয়। মল্লিক ঘাট যেমন রামমোহন মল্লিক তাঁর পিতা নিমাই মল্লিকের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি করেছিলেন। কিন্তু চাঁদপাল এরকম মানুষ ছিলেন না। ঘাটের ধারে তাঁর একটি ক্ষুদ্র দোকান ছিল। তবে লোকমুখে তাঁর নাম ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে ঘাটের সাথে তাঁর নাম যুক্ত হয়ে গেল। ফেরিঘাট হিসেবে এককালে এটি খুব ব্যস্ত ছিল। ১৭৭৪ সালে স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস ও তাঁর সহ কাউন্সিলররা এই ঘাটেই তাঁদের জাহাজ থেকে নেমেছিলেন। ১৭৮৬ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিস এই ঘাটেই নেমেছিলেন। চাঁদপাল ফেরিঘাট আজও ব্যবহৃত হয়।
এই ঘাটগুলি না থাকলে আমরা এই ৩৫০ বছর পুরাতন শহরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি বিশাল অংশ ধরতেই পারতাম না। ক্ষণি থেকে উদ্ধার হওয়ার পরে অনেক কিছু করে সোনা বা হীরাকে চমকাতে হয়। ঘাটগুলির ইতিহাস ঘাটলে আমরাও এই শহরের চমৎকার কিছু স্মৃতি আরো একবার উপলব্ধি করতে পারব।