32 C
Kolkata
Monday, May 29, 2023
More

    তুষারপাতের রেশমপথ – বিপ্রনাথ মজুমদার

    জনহীন এক ফাঁকা পথ, পথের পরতে পরতে সাদা বরফের চিত্রমালা। যেন কিছুটা একঘেয়ে। শুধু পথ নয়, পাইন গাছের চূড়ো, সবুজ গাছের পাতা, সেনাব্যারাকের ঢালু চাল, আর অনাদরে পড়ে থাকা পাথরের মুখও ঢেকে গেছে দুধ সাদা বরফে । ঘোলাটে অন্ধকারেও তা বোঝা যাচ্ছিল বেশ। হিম ঠান্ডায় জীপের জানলায় গড়িয়ে পড়া জলবিন্দু আর ঘোলাটে কুয়াশার মিহি চাদরকে গ্লাভস বন্দি হাত দিয়ে মুছে দিতেই বাইরের অস্পষ্ট কিন্তু অসাধারণ প্রকৃতি ধরা দিচ্ছিল রহস্যময় ভাবে। আমরা চলেছি এক সুন্দর সূর্যোদয়ের সাক্ষী হতে সময় ভোর পৌনে চারটে।

    থমকে থাকা পৃথিবীর শেষ প্রান্তে শীতল মরুভূমিতে আমরা চারটি প্রানী আর আমাদের গাড়ীর চালক রিনজে শেরপা।আমরা দাড়িয়ে রয়েছি স্থানুবত। মানসিক উত্তেজনার পারদ যেন হিমাঙ্কের নীচে চলে যাওয়া আবহাওয়াকে পাত্তা না দিয়েই উর্ধ্বমূখী। ‘ হাড়হিম করা ’ মার্কা কাগুজে কথার ঠাণ্ডার ছোবল আমাদের সমস্ত শরীরকে অসাড় করে দিচ্ছে বেশ বুঝতে পারছিলাম। মন কিন্তু আমাদের  অন্য জগতে। অবশেষে হার মানল অসহ্য শীত-কামড়। মনের জানলা গুলোকে হাট খোলা করে, লুংথুং ভিউপয়েন্ট থেকে আমরা অনতিকাল পরেই প্রত্যক্ষ করলাম এক দুরন্ত সূর্যোদয়ের সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘার হোলি খেলা। ছুরির তীক্ষ্ণ ফলার মত ঠান্ডা হাওয়ার কামড়কে উপেক্ষা করে, ১২৬০০ ফুট উচ্চতায় জনবিরল এক পাহাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠতে থাকা ভোরের সূর্যের কিরণে রাঙ্গিয়ে দেওয়া পাহাড় চুড়োকে রূপবতী হয়ে ওঠা দেখতে দেখতে আমরা বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়লাম সকলেই।

    পূব আকাশ একটু পরিষ্কার হতেই অনুভব করলাম আমরা প্রবেশ করেছি এক অপার্থিব রঙ্গিন জগতে। আমাদের চোখ একবার পাহাড়ের নীচের দিকে তো পরক্ষনেই ওপরে। নীচের দিকে পায়ের তলায় জমে রয়েছে সূর্যের ছটায় প্রতিফলিত রঙ্গীন মেঘের ভেলা আর উপরের আকাশে তখন রঙের হোলি খেলা। যেন আরব্য রজনীর যাদু কার্পেটে ভাসছি আমরা। চোখের সমান্তরালে তখন উদিত হচ্ছে ভোরের সূর্য আর দ্রুত পাল্টাচ্ছে আকাশের রঙ। কখন আগুনে কমলা, তো কখনও রক্তলাল। রক্তিম রঙ সরে গিয়ে এবার আকাশের রঙ স্বর্ণালী। দৃষ্টি সরালাম পূব আকাশ থেকে পশ্চিমে। সেখানে নবোদিত সূর্যের কিরণ আঘাত হেনেছে সুউচ্চ কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রতিটা মুকুটে। আরও রূপবতী হল প্রকৃতি। আঁকাবাঁকা রাস্তায় তখন পড়ে থাকা বরফের উপর গলানো-সোনার রঙ্গীন করুনা। নিমেষে চোখের সামনে ভোরের আলোয় ফুটে উঠলো কুম্ভকর্ণ, কাবুরু আর কোকতাং। সাথে সুবিস্তৃত আর গর্বোদ্ধত কাঞ্চনজঙ্ঘা।  দেখলাম এক অসাধারণ সূর্যোদয়। পূব সিকিমের আঁকাবাঁকা এক পথকে সাক্ষী রেখে। এ পথ অতীতের বাণিজ্য পথ বা সিল্ক রুট।

    আসলে জানুয়ারী মাসের গোড়ার দিকে কলকাতাবাসীর সঙ্গে শীত যখন পড়ব পড়ব বলে লুকোচুরি খেলে, সেই সময় আমরা চারবন্ধু গন্তব্য হিসাবে বেছে নিয়েছিলাম পূর্ব সিকিমের এক প্রত্যন্ত গ্রাম বলে পরিচিত জুলুককে। শীতে এখানকার তাপমাত্রা নামে শূন্য থেকে পাঁচ – ছ ধাপ নীচে, সেটা জেনেও। সেই মত প্রথম দিন আমরা এনজেপি থেকে প্রায় ১১৫ কিলোমিটার দূরে আরিতারে চলে এলাম প্রথম রাতটা কাটানোর জন্য। ঠাণ্ডা এখানেও কম নয়। পরদিন ভোরবেলা মানখিম হিলটপ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, আরিতার গুম্ফা আর আরিতার লেক দেখে প্রাথমিক  ওয়ার্ম-আপটা সেরে নিলাম। আজ আমাদের গন্তব্য জুলুক। কিন্তু তার আগে নিতে হবে অনুমতি পত্র। সিল্করুট বেড়াতে গেলে স্থানীয় এস ডি পি ও অফিস থেকে নিতে হয় অনুমতি, যার জন্য লাগে দু-কপি পাসপোর্ট ছবি আর সচিত্র পরিচয় পত্র। রংলি বলে আর এক জনপদ থেকে করিয়ে নিতে হয় এই অনুমতি পত্র। নতুবা প্রবেশ-নিষেধ। ড্রাইভার নিজেই সব ব্যবস্থা করল আর সেই ফাঁকে আমরা একটু ঘুরে ফিরে দেখে নিলাম রংলি শহরের আশপাশকে।রংলিতে আমরা যে জায়গাতে থামলাম তার কিছুটা দূরেই লোহার ব্রীজের নীচ থেকে বয়ে যাচ্ছে রংলি খোলা বা নদী।  এর উচ্চতা প্রায় ৪০০০ ফুট। আর জীপস্ট্যান্ডের উল্টোদিকেই এক জমজমাট বাজার-বিক্রি হচ্ছে দেশী আর বিদেশী পণ্য। চলছে অবাধ বানিজ্য। আর সামনে যে পথ দিয়ে  আমরা আরো এগিয়ে যাব, সে পথও অতীতের এক বানিজ্য পথ। দূর্গম রেশম পথ বা সিল্করুটেরই এক ভগ্নাংশ। সে পথেও বানিজ্য চলত ঠিক এখনকার মত করেই। তিব্বতী,চীনা,আর ভারতীয়রা পাহাড়ি রুক্ষ পথ দিয়ে দূর্গম রাস্তা পেরিয়ে চমরিগাই-এর পিঠে বেঁধে নিয়ে  আসত পশম আর বীজ। আর ফেরার পথে নিয়ে যেতেন ছাতু, শস্য আর ফল। তৈরী হয় বানিজ্য পথ, এ পথ পায়ে হাঁটা, নাম হয় সিল্করুট। এই পথগুলো শস্য বা রেশম পরিবহনের হাত ধরে একসুতোয় গেঁথে  ফেলে ভারতবর্ষ, তিব্বত, চীন,মায়ানমার, বার্মা,ইরান,মিশর আর পারস্যকেও। আর এ ব্যবসার উৎসমুখ আরও বৃহত্তর হয়ে  ছড়িয়ে  পড়ে ইউরোপের অভিমুখে। শুধু ব্যবসাজাত কাঁচা মালই না- গণিতশাস্ত্র, দর্শন, বাস্তুশাস্ত্র আর বয়ন শিল্পেরও আদান প্রদান হতো এ পথে। যদিও ভারতে কিছুদিন আগে পর্যন্ত এ পথ সাধারন মানুষের কাছে অধরাই ছিল। কিন্তু অনুমতি সাপেক্ষে এ পথ এখন মুক্ত পথ। এ পথ গেছে জুলুক হয়ে  নাথাং ভ্যালি। সেখান থেকে  পথ গেছে কুকুপ হয়ে টুকলা  ভ্যালি।  আরও এগলে আদি বাবার মন্দির। সেখান থেকে আরও ওপরে সমগো লেক যা বাঙ্গালির কাছে অতিপ্রিয়-ছাংগু লেক। এপথ ধরেই আমাদের এগিয়ে  চলা। যদিও এপথে অতিরিক্ত তুষারপাতের জন্য অবরুদ্ধ  থাকে মাঝেমাঝেই।

    কিউখোলা ঝর্নার ধারে পাখীর ছবি তুলে বেশ কিচ্ছুক্ষণ সময় কাটিয়ে দুপুর দুপুর আমরা চলে এলাম জুলুকে। এখানে মোবাইল ফোনের সংযোগ পাওয়া বেশ সমস্যার। কাঠের তৈরী ছিমছাম এক ছোট্ট বাড়িতে আজ রাত্রিবাস। কটেজের নাম-গ্রীন কটেজ। বিদ্যুৎ ব্যাবস্থা আছে আবার  সৌরবিদ্যুতের ব্যাবস্থাও আছে। আছে ঠান্ডার সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট লেপ তোষক আর আগুন পোয়ানোর জন্য স্থানীয় চুলা-‘বুখারী’। বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইছে বাইরে। কাঁপুনিও লাগছে বেশ।  দ্রুত তাপমাত্রা নামছে বেশ বুঝতে পারছি। জুলুকের উচ্চতা ৯৪০০ ফুট। অদ্ভুত এখানকার প্রকৃতি। পশ্চিমদিকে তাকালে নজরে আসে বিস্তৃত পাহাড় শ্রেনী।  আর পূর্বদিকে তাকালে চোখে পড়ছে  সার্পিল পথ আষ্টেপৃষ্টে যেন বেঁধে রেখেছে  পাহাড়কে। চোখের আড়ালে হারিয়ে গিয়ে তা যেন আরও রহস্যময়। পূর্বদিকের খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম  ওপরে শুরু হয়েছে তুষারপাত। সাদা বরফের চিহ্ন এখান থেকেই খালি চোখে দেখা যাচ্ছে। হোমস্টের ছেলেটি বেশ ছটফটে আর আলাপি। সে জানালো,  কমবেশী স্নো ফল এখানে প্রায় প্রতিদিনই হচ্ছে আর দ্রূত রাস্তাও পরিষ্কার করে দিচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। তবে অতিরিক্ত তুষারপাতে বন্ধ হতে  পারে রাস্তা । দূরে কাছে মাঝেমাঝেই চোখে পড়ছে জলপাই রংএর সেনা বারাক আর সেনাথানের আনাগোনা। ঠান্ডা বাড়তে থাকায় আমরা সবাই ফিরে এলাম কটেজে। মনে চাপা উত্তেজনা, কাল ভোরবেলা- সানরাইজ।

    মোবাইল অ্যালার্মে ঘুম ভাঙ্গল প্রায় মাঝরাতেই। প্রচণ্ড ঠান্ডায় শরীর অসাড়। মাথাতেও অসহ্য যন্ত্রণা। তবু শরীর টেনে তুললাম। শীত পোষাক চাপাতে না চাপাতেই রিনজে হাজির। কিছুটা সময় গেল গাড়ি চালু করতে। বাইরে রহস্যময় আবছা অন্ধকারে সবুজ সেনাযানগুলো সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে থমকে। আকাশে উজ্জ্বল হীরের কুচির মতো ছড়িয়ে আছে রাত তারারা। গাড়ির জানালায় শিশিরের হিম-ছাপ। ঘোলাটে হলদে আলোতে জনপদ শীতঘুমে মজে। রাতের নির্জনতা খানখান হয় ইঞ্জিনের গোঙ্গানিতে। অন্ধকার কেটে জ্বলে উঠল উজ্জ্বল হলুদ ফগ্ লাইট। থামতে হল মিলিটারী চেকপোস্টে। প্রয়োজনীয় কাগজ দেখিয়ে আবার ওঠা ওপরে। সমস্ত কাঁচ তোলা থাকলেও অসহ্য ঠান্ডার কামড়ে আমরা কাঁপছি ঠকঠক করে। আধো অন্ধকারে পিছলে গেল থাম্বি। রাস্তার দুধারে জমে থাকা পুরু বরফের আস্তরণ বাড়তে বাড়তে তা দখল নিচ্ছে রাস্তারও। পাহাড়ের গায়েও প্রচুর বরফ। অবশেষে গাড়ি থামল লুং থুং ভিউ পয়েন্টে। আর এখান থেকেই দেখলাম এক অসাধারণ সূর্যোদয় যার বর্ণণা গোড়াতেই দিয়েছি।

    আজ ঝকঝকে সকাল। দিনের উজ্জ্বল আলো গায়ে মেখে আমরা নেমে এলাম জুলুকে। খোলা আকাশের নীচে, গ্রীন কটেজের উঠোনে কাঁচা রোদ মেখে সেরে নিলাম ব্রেকফাস্ট।  গরম পুরি,সবজি আর কফি। তরতাজা হয়ে এবার আমরা তৈরী পরবর্তী সফরের জন্য। গন্তব্য থাম্বি ভিউ পয়েন্ট। যেখান থেকে দেখে নেওয়া যায় জিগজ্যাগ রোড বা স্থানীয় ভাষায় ভুলভুলাইয়া। এখান থেকে দেখা যায় গোটা জুলুক গ্রামটিকেও। রিনজে গাড়িটাকে দাঁড় করালো এক পাহাড়ের খাঁজে। মিশকালো রাস্তার দুপাশে দেখে নিচ্ছি দুধসাদা বরফের আলপনা।  উল্টো দিকে নিথর হয়ে বসে আছে চমরিগাই-এর চোট দল। নিশ্চিন্তে বসে জাবর কাটছে আর গলায় বাঁধা ঘন্টার রিনরিন শব্দ পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে টুকরৌ টুকরো হয়ে ভেঙে হারিয়ে যাচ্ছে হিম বরফের চাদরে। আর আমরা আটকে আছি আশ্চর্য এক জ্যামিতির ফাঁকে- ভুলভুলাইয়াতে।  জুলুক থেকে যে আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে আমরা ১৬ কিলোমিটার উপরে উঠে এসেছি তার পুরোটাই এখান থেকে দৃশ্যমান। উপর থেকে দেখতে পাওয়া যায় এরকম অসংখ্য পাহাড়ী পথের বৃত্তচাপ বোধহয় পৃথিবীর অন্যকোনো দেশে বিরল। প্রায় ৯৫ টি ফেলে আসা বরফ মাখানো পাহাড়ী  পথের আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্যতে আমরা সম্মোহিত।  দশ মিনিট অপেক্ষা আর দেদার বরফ খেলার পর আবার আমরা জীপের উপর। গন্তব্য এবার নাথাং ভ্যালি পার করে হরভজন সিং-এর আদিমন্দির।

    এখন আমরা থমকে দাঁড়িয়ে আছি ১৪২০০ ফুট উচ্চতায়। যেদিকে চোখ মেলা যায়, ধরা দেয় আদিগন্ত বিস্তৃত বরফের সাম্রাজ্য।  সময়ের সাথে সাথে তা বাড়ছেও অতি বিপজ্জনক ভাবে। হ্যাঁ, শুরু হয়েছে প্রবল তুষারপাত। গুঁড়িগুঁড়ি মিহিদানা বরফ বেগ বাড়িয়ে ঝরে পড়ছে ঝুপঝাপ করে।  ছবি তোলার উত্তেজনায় নিচে নামলেও নিজেকে আর ক্যামেরাকে বাঁচাতে বারবার ঢুকে পড়তে হচ্ছিল গাড়ীর ভেতর। বুঝতে পারলাম ‘মর্ণিং শোজ দ্য ডে’ প্রবাদ আজ বৃথা। খারাপ হতে শুরু করেছে আবহাওয়া। এমুহুর্তে তাই গাড়ী গতি কমিয়ে আমাদের দাঁড় করিয়েছে নাথাং ভ্যালির এক বিস্তৃত বরফমোড়া উপত্যকায়। পূর্ব সিকিমের জনহীন বরফমোড়া বাণিজ্যপথে আমরা একলা। ক্রমশঃ চোখের সামনে বদলে গেল প্রকৃতি। চোখের সামনেই গাছের সবুজ পাতা ঢেকে গেল সাদা বরফের মিহি চাদরে। কানে শুনছি ঝুপঝুপ শব্দ। চেয়ে দেখি ভারী হয়ে যাওয়া বরফ মাটিতে ঝরছে পাইন পাতার উপর থেকে। রিণজের কথায় বুঝতে পারি আরও উপরে তুষারপাতের পরিমাণ বিপজ্জনক ভাবে বেশী। আকাশও যেন অতিরিক্ত ঘোলাটে। উল্টো দিক থেকেও

    আসা সেনাবাহিনীর ট্রাকের ড্রাইভার মারফত জানা গেল ওপরে প্রবল তুষারপাত শুরু হয়েছে। সে তুষার সরিয়ে পথ পরিষ্কার করার সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ। তাই আমাদের পরিকল্পনা মাফিক গন্তব্যে পৌঁছানো শুধু দুষ্করই নয়, অসম্ভবও।

    আর একবার শেষ চেষ্টা করা হল। যাত্রা শুরু হল অতি ধীর গতিতে। তুষার সরণি বেয়ে আমরা শুরু করলাম এক ঝুঁকির যাত্রা। আর এই পরিক্রমায় প্রকৃতির যে ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ দেখলাম এক কথায় তা অনবদ্য। ধু ধু তুষারপ্রান্তরে আমরা একদম একা। যেদিকে চোখ যায় শুধু দুধসাদা বরফের চাদর মেলা। দূরের সেনা ব্যারাকের মাথায় জেগে আছে শুধু অল্প সবুজের রং-ছোঁয়া। হেলে থাকা চালে মোটা বরফের আস্তরণ। অনেক নিচে পিঠে বরফের দানা নিয়ে পিঁপড়ের সারির মত গোটা বিশেক ইয়াকের মৃদু চলনে ধরা দেয় জীবনের অস্তিত্ব। আরও কিছুদূর এগিয়ে চোখে পড়ল চীন সীমান্তে থাকা এক নজরমিনার। বুঝতে পারলাম আমরা আন্তর্জাতিক সীমানার খুব কাছেই রয়েছি। রাস্তা কিন্তু ক্রমশঃ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। পিছলে যাচ্ছে গাড়ির চাকা। গাড়ীর ভার কমানোর জন্য প্রায় বার দশেক নামতে হয়েছে গাড়ী থেকে আর প্রতিবারই গোড়ালি পার করে পা ঢুকেছে ঝুরো বরফের স্তুপে।পায়ের জুতো, পরণের প্যান্ট সব কিছুই ভিজে উঠেছে। পায়ের আঙ্গুলও যেন অসার হয়ে আসছে ঠান্ডায়। এর মধ্যেই রিণজে জানালো কোন উপায়েই আজ টুকলা ভ্যালির রাস্তায় যাওয়া যাবে না। অতিরিক্ত তুষারপাতে রাস্তা পুরো বন্ধ।

    কিছু দূর এগিয়ে বাবা হরভজন সিং এর আদি ধামে আমরা নেমে পড়লাম প্রচণ্ড ঠান্ডা আর বরফপাতের হাত থেকে বাঁচার জন্য। সেনা পরিবৃত হয়ে গরম চায়ে গলা ভিজিয়ে কিছুটা ধাতস্থ হলাম। বাবার প্রসাদ কাজু, কিসমিশ খেতে খেতে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অসীম সাহসী সেনানীর রহস্যময় গল্প শুনে নিলাম। আগুণে হাত-পা সেঁকে নিতে নিতে শুনলাম এই পাহাড়েই ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে তাঁর অপমৃত্যু হয়। তারপর তাঁকে ঘিরে শুরু হয় নানা অলৌকিক কাহিনী। মনে করা হয় আজও তিনি জীবিত। এই কারণে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সহায়তাতে তৈরী হয় তাঁর এক স্মৃতি মন্দির। বাবা হরভজন সিং এখানে পূজিত হয় অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে।

    এবার আমাদের ফেরার পালা। বরফ পথ ধরে নীচে নেমে আসা। আর তার সাথে সঙ্গে নিয়ে আসা এক অপরূপ ভ্রমণের স্মৃতিকথা যা বহুদিন মনের মধ্যে রয়ে যাবে সযত্নে। নানা অভিজ্ঞতার রেশ নিয়ে নামতে নামতে ভাবছি অনেক জায়গাই এবার অধরা রয়ে গেল আমাদের কাছে, প্রকৃতি রয়ে গেল অবগুণ্ঠিত, রহস্যময় প্রকৃতির অনেক রূপ রয়ে গেল অজানা। আর এই অজানা রূপ উন্মোচনের টানে আবার ফিরে আসতে হবে এই আঁকাবাঁকা বরফ জড়ানো জ্যামিতিক পথের গোলক ধাঁধায়। বরফের বাণিজ্য পথের বাঁকে জন্ম নেবে আর এক নতুন গল্প। পড়ে থাকবে শুধু ধূসর স্বপ্নের মত রিণজে শেরপার নিষ্পাপ হাসিমুখ, সন্ধ্যের মুখে জ্বলে ওঠা শুকনো পাইন ধুনোর ভারী গন্ধ অথবা আঁকাবাঁকা রাস্তার বাঁকে হারিয়ে যাওয়া মোনালের হালকা দ্যুতি।

    (সিল্ক রুট ভ্রমণে যেতে গেলে অবশ্যই যোগাযোগ করতে হবে ৯৮৭৪২১৬০৫৪ নম্বরে কলকাতা বা এন জে পি থেকে সিল্করুটে বেড়ানোর সমস্ত ব্যবস্থা হয়ে যাবে ।)

    Related Posts

    Comments

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    সেরা পছন্দ

    বাতিল হতে চলেছে ২০০০ টাকার নোট !

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : বাজার থেকে ২০০০ টাকার নোট তুলে নিচ্ছে RBI। এমনই বড় সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করল...

    শীঘ্রই আসছে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন ! চলছে শেষ পর্যায়ের ট্রায়াল

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : বর্ষার মরসুম শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। ফি বছরে বর্ষা মরসুম মানেই ডেঙ্গির...

    কেষ্ট গড়ে তৃণমূলে ধস ! বিজেপিতে যোগ দিল বহু মুসলিম পরিবার

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। জোরকদমে প্রচার চালাচ্ছে শাসক-বিরোধী। তার আগে ভাঙন অস্বস্তিতে বিপাকে পড়ছে...

    সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে বেশ কিছু দেশ ! জানুন সেই দেশ গুলি সম্পর্কে

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : উষ্ণায়নের কারণে গোটা বিশ্বজুড়ে অনেক সমস্যা দেখা যাচ্ছে। কোনও কোনও জায়গায় গ্রীষ্মকালে তুষারপাত হচ্ছে...

    শুরু থেকেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ , কি আছে বিতর্কিত ছবিতে ?

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : ইউটিউবে ছবির ট্রেলার দেখেই বিতর্কের মেঘ ঘনিয়েছিল। মুক্তির পর তোলপাড় ফেলে দিয়েছে পরিচালক সুদীপ্ত...