স্থাপত্যে বিশেষ করে শহরের প্রতীকচিহ্ন একটা দেশকে বা একটা শহরকে মনে করিয়ে দেয়। তাই প্রতীকচিহ্ন স্থাপত্যের ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। পিরামিড যেমন ঈজিপ্টকে মনে করায় তেমনি আইফেল টাওয়ার প্যারিসকে অথবা কুতুবমিনার দিল্লিকে আর তাজমহল ভারতবর্ষকে চিনিয়ে দেয়। আবার লন্ডন শহরের প্রতীক হলো বিগবেন, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং ছিল নিউইয়র্ক শহরের। তেমনই ইব্রাহিম রৌজা ও গোলগম্বুজ হলো বিজাপুর শহরের প্রতীক।
বৈশাখের কোনো ঝড়ের দিনে, যখন ধুলোর ঢেউ তুলে সে ছুটে আসে, আগে আগে হাসির ছটার মতো বিদ্যুৎ যখন তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসবে, দুন্দুভি বাজিয়ে যখন বাজ তেড়ে আসবে তার পেছন পেছন অথবা ঐ বৈশাখেই যখন কোনো একদিন আগুন জ্বালানো আকাশে রক্তজবার রঙে রাঙানো রোদের চাঁপাকলিতে শিউরে উঠবে বন, ভুবনজুড়ে ছড়িয়ে থাকবে চঞ্চলতা, অনুরোধ রাখলাম, বৈশাখের ঐ দুই রূপের সময়েই এসে বসবেন গোলগম্বুজে…কথা দিলাম আপনি মুসাফির হয়ে উঠবেন তুরীয় মনোভাবের সুস্নিগ্ধ এক প্রেমিক, সেখানে থাকবেনা চিন্তার দৈন্য, চেতনার দীনতা অথবা কোলাহলের মোহ।
অনেকক্ষন গাড়ির মধ্যে বসে বসে হাত-পায়ে কেমন জড়তা এসে গেছে। মোড়ামুড়ি ছেড়ে একবার চাঙ্গা হবার চেষ্টা করলাম। সামনেই ছোট একটা দোকান। দেখি গোল গোল আখের খন্ড বিক্রি করছে। গোলগম্বুজ সামনেই দেখা যাচ্ছে। ছবির মতো বিরাট কম্পাউন্ড।চারদিকে নানারকম ফুলের গাছ। গোলগম্বুজের পুরো কম্পাউন্ডটা উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মূল কবরকক্ষে উঠতে সিঁড়ি ভাঙতে হয়। উঠতেই একজন গার্ড এগিয়ে এলেন, জুতো খুলতে হবে এবং তাঁরাই জুতো পাহারা দেন।


গোলগম্বুজের কবরকক্ষে প্রেমিকা রম্ভার জন্য উন্মাদ সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহ শুয়ে আছেন।প্রেমের উত্তাপ মৃত্যুর অতল শীতলতার রাজ্যে পৌঁছাতে পারে না,সুলতানের নশ্বর দেহ আজ সেই রাজ্যে বন্দি।সুলতানের প্রেমকাতর দেহ আজ সামান্য ধুলোয় পরিণত।গোলগম্বুজের বিশালতা ও আড়ম্বর সুলতানের মৃত্যুর অন্ধকারকে ঢাকতে ব্যর্থ বলেই মনে হলো।ইতিহাসের গতি স্তব্ধ ভেবে যাঁরা জনসাধারণের জীবনের উপর খবরদারি করেছেন অথবা তাঁদের নিচু হয়ে থাকবার শর্তে উঁচুতে বসে বাদশাহী চাল চেলেছেন।সুরমা লাগানো চটুল আঁখিকে রঙিন সুরে রাঙিয়েছেন, তাঁরা ভাবতেও পারেন-নি ইতিহাস এমন নিষ্করুণ ভাবে মকবরার মাটিতে তাঁদের টেনে নামিয়ে দেবে।আজ গোলগম্বুজে সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহ মহাকালের হাতে বন্দি। ইতিহাস পড়েছি, কিন্তু ইতিহাসের মর্মবাণী এমন কাছ থেকে কখনো অনুভব করিনি।
মনে করা হয় শহরের কোনো জৈন মন্দিরের নকশা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে গোলগম্বুজের নকশা করা হয়েছিল।আলঙ্কারিক ক্ষেত্রে বিজাপুর স্থাপত্যে ইব্রাহিম রৌজা যদি সবচেয়ে সূক্ষ্ণতম ইমারত হয়ে থাকে তবে সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহের মকবরা গোলগম্বুজ হলো অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও মহীয়ান অট্টালিকা।মকবরাটি বিজাপুর শহরের পূর্বদিকে অবস্থিত। সুলতান দ্বিতীয় ইব্রাহিম আদিলশাহের মকবরা ইব্রাহিম রৌজা ছিল আদিলশাহীদের স্থাপত্যিক উদ্যোগের মধ্যে নান্দনিকভাবে সবচেয়ে সেরা। সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহ তাই তাঁর মকবরাকে স্মরণীয় করে রাখতে আলঙ্কারিক মোটিফ সহ রাজ্যের সবচেয়ে বৃহৎ আকারের ইমারত নির্মাণে উৎসাহী হয়েছিলেন।সম্ভবত সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহ বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষের করে যাওয়া রৌজার কারুকার্যপূর্ণ সজ্জায়ন ও অলঙ্করণের উৎকর্ষতাকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়।তাই তিনি স্থির করেছিলেন এমন একটি সৌধ গড়ে তুলবেন যার বৈশিষ্ট্য ভারতের স্থাপত্যিক ইতিহাসে একক বলে স্বীকৃত হবে।


ইব্রাহিম রৌজা যদি আদিলশাহীদের শৈল্পিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ হয়ে থাকে তাহলে গোলগম্বুজ হলো তাঁদের দাম্ভিক ব্যঞ্জনা।যেখানে ইব্রাহিম রৌজার স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যে নারী সুলভ কমনীয়তা ফুটে ওঠে সেখানে গোলগম্বুজে ফুটে ওঠে আদিলশাহীদের পুরুষতা।ইব্রাহিম রৌজার গীতিরস কঠিন মানুষের পাষান হৃদয়কেও গলিয়ে দেয় আবার গোলগম্বুজের ঋজু দেহ ও উন্নতশির অবয়ব দুর্বলজনকে সবল হয়ে দাঁড়াতে শেখায়…এই দুই রসই হলো বিজাপুরের স্থাপত্য সঙ্গীতের প্রাণ। স্থাপত্যিকভাবে গোলগম্বুজ হলো বিজাপুর স্থাপত্যের বিজয় উল্লাস।গোলগম্বুজের নির্মাণ উদ্দেশ্য শুধুমাত্র মনোরম সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টি করা ছিল না। নির্মাণের মূল কারণ ছিল দর্শকের মধ্যে বিস্ময়-বিহ্বলতা সৃষ্টি করা। যেন দর্শকের মধ্যে এই আজানুলম্বিত ইমারতের মাঝে শাসকের ক্ষমতাধর চেহারা প্রতিস্ফুট হয়। যা দেখে দর্শকদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চারণ ঘটে।ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, হু পেজ দি পাইপার, কলজ দি টোন … যে কড়ি ফেলে সেই তো হুকুম দেয় কোন সুরে গাইতে হবে।তাই গোলগম্বুজ দর্শণে মনে হয়, সুলতানের শিল্পসৃষ্টি আর বাহাদুরি দেখানোর পার্থক্য আছে।
মুঘলদের সাথে নিজামশাহী রাজ্য ভাগাভাগি, সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহকে দাক্ষিণাত্যের শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসক রূপে সমকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।তাই গোলগম্বুজের স্থপতি মকবরার মাধ্যমে প্রজা ও দর্শকদের স্মৃতিতে তাঁকে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিলেন। গোলগম্বুজের নির্মাণ প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক কে ছিলেন তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে দ্বন্ধ আছে, কেউ বলেন মালিক সান্দাল এই সৌধের তত্ত্বাবধায়ক স্থপতি ছিলেন আবার অন্যমতে মালিক ইয়াকুত দাবলি ছিলেন এই প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থপতি-প্রধান।গোলগম্বুজের নির্মাণপ্রকল্প সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহের জীবিত অবস্থায় তাঁর রাজত্বের শেষ সময়ে নেওয়া হয়েছিল।সম্ভবত তাঁর মৃত্যু সময়ে আস্তরের অলঙ্করণের কাজ অসম্পূর্ণই ছিল। গোলগম্বুজের নির্মাণকার্য সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যসময়ে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত অসম্পূর্ণই থেকে যায়।এমনকি মকবরার ইমারত অংশটিও অসম্পূর্ণ ছিল।তাই গোলগম্বুজের গৃহীত নকশা পরিকল্পনার অনেকাংশই আজও অসমাপ্তই রয়েছে।গোলগম্বুজের দক্ষিনদিকে দরজার লেখমালা থেকে জানা যায় যে, সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহের মৃত্যু ১৬৫৬ সালে হয়েছিল।সম্ভবত ওই সময় থেকেই গোলগম্বুজের নির্মাণ কাজ স্থগিত হয়ে যায়। অতীতে এই লেখমালা নীল রঙের লাপিস লাজুলি পাথর দিয়ে সজ্জিত ছিল।


গোলগম্বুজ হলো বিশ্বের একমাত্র সৌধ যেখানে এক কক্ষের বৃহত্তম পরিধিকে একটি মাত্র গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত করা হয়েছে।বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এক কক্ষ বিশিষ্ট পরিধির উপর আচ্ছাদিত গম্বুজটি বর্তমানে ইতালির রোমে প্যানথিয়নে দেখতে পাওয়া যায়।গবেষকেরা গোলগম্বুজের অভ্যন্তরে স্থাপত্যিক গাম্ভীর্যতায় যেমন রোমের প্যান্থিয়নের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন তেমনই ইস্তাম্বুলের সান্টা সোফিয়া চার্চের সাদৃশ্য দেখতে পেয়েছেন।এক কক্ষ বিশিষ্ট ইমারত রূপে বিশালতায় গোলগম্বুজ ভারতবর্ষে প্রথমস্থান অধিকার করে আছে।গোলগম্বুজে কবরকক্ষের অভ্যন্তরে স্থাপত্যিক সুরে একান্ত অনাড়ম্বর অথচ কঠোর আত্মসংযমী ভাব সৌধের পৃষ্ঠপোষকের চারুশিল্পের সম্বন্ধে জ্ঞান ও ভালবাসার স্বরকেই উচ্চারণ করেছে। গোলগম্বুজে গম্বুজ নির্মাণে পেন্ডেন্টিভ কৌশল ব্যবহার করবার ফলে, অন্তর্ভাগে চতুষ্কোনাকার আবদ্ধ কক্ষে শব্দের কুজন তৈরী করে। যা কবরকক্ষের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে শব্দের অনুনাদ সৃষ্টি করে। তাই গোলগম্বুজের কবরকক্ষের ভিতর একজন দর্শকের পায়ের আওয়াজও স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যায়। সে জন্যই গাইডরা গোলগম্বুজের কবরকক্ষকে হুইস্পারিং গ্যালারি বলে থাকেন।
আদিলশাহী স্থাপত্যে মকবরার ফ্লোরে সৌন্দখ বা জারিহ নির্মান করা হলেও মৃতদেহের মূল কবর ভূগর্ভস্থ কক্ষে অর্থাৎ হুজরাহতে স্থাপন করা হতো।সৌন্দখ নির্মাণের ক্ষেত্রে গোলগম্বুজের স্থাপত্যেও একই রীতি গ্রহণ করা হয়েছে।গোলগম্বুজের ক্ষেত্রে স্থপতি হুজরাহতে কক্ষের পরিধি মূল কক্ষের সমান করেই নির্মাণ করেছেন।পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখী অক্ষ বরাবর গোলগম্বুজের সৌন্দখে প্রথমে সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহের নাতি(সুলতান দ্বিতীয় আলী আদিলশাহের পুত্র)ও তাঁর ছোট বেগম আরুস বিবি,সুলতান স্বয়ং, তাঁর প্রণয়িনী বা মুতাহ বেগম রম্ভা,সুলতানের কন্যা, বড় বেগম(খাদিজা সুলতানা) এই ক্রমান্বয়েই শুয়ে আছেন।এঁদের মূল কবর হুজরাহতে রাখা আছে। গোলগম্বুজের অভ্যন্তরে পশ্চিমদিকে অবস্থিত সিঁড়ি দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে যাওয়া যায়। যদিও বর্তমানে পুরাতাত্ত্বিক দপ্তর থেকে ওই সিঁড়িপথকে দর্শকদের জন্য বন্ধ করেই রেখেছেন। সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহ শিয়া ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, তাই সুলতানের মৃত্যুর পর, বেগম খাদিজা সুলতানার ইচ্ছাতেই গোলগম্বুজ অর্থাৎ স্বামীর মকবরার জন্য কারবালা থেকে মাটি নিয়ে আসা হয়েছিল।
রম্ভাবতী ছিলেন জন্মসূত্রে হিন্দু, তিনি ছিলেন নর্তকী।গজল, কসীদা ও সঙ্গীতে তিনি পারদর্শী ছিলেন।সুলতান আদর করে নাম দিয়েছিলেন রম্ভা।কথিত আছে শিয়া ধর্মীয় সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহ প্রেমে পড়েছিলেন রম্ভার, মুতাহ মতে তিনি বিবাহ করেছিলেন রম্ভাকে। তাই রম্ভার মৃত্যুর পর, সুলতানের ইচ্ছাতেই তাঁকে গোলগম্বুজে সুলতানের পাশে সমাহিত করা হয়।শাহী বিজাপুরের দরবারকে কেন্দ্র করে অনেক গল্প-কাহিনী ছড়িয়ে আছে।কিন্তু জনপ্রিয়তায় মুহাম্মদ আদিলশাহ ও রম্ভাবতীর প্রেমকাহিনী বোধহয় সবাইকেই ছাড়িয়ে যায়।
গোলগম্বুজের নির্মাণ কাজ যখন প্রায় শেষের মুখে, বিশালকায় কক্ষের অভ্যন্তরে কারিগরেরা ভারায় তাঁদের কাজের শেষ অধ্যায়কে আরও সূক্ষ্ণ রূপ দিতে ব্যস্ত,আস্তরের প্রলেপ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।এই রকম একদিন মুহাম্মদ আদিলশাহ তাঁর প্রেমিকা রম্ভার সাথে গোলগম্বুজের প্রধানকক্ষে অবসরকালীন মুহুর্তে প্রনয়লীলায় ব্যস্ত ছিলেন।আতরের গন্ধে বাতাস ম-ম। আজ সুলতান পরিদর্শনে এসেছেন তাই মখমল মসলিনে ঝলমল করছে গোলগম্বুজের প্রধান কক্ষ।রম্ভাবতীর সৌন্দর্যতো যেন জমাটবাঁধা এক টুকরো জ্যোৎস্না।যেমন সুন্দর চোখ তেমনই ভ্রূযুগল।অধরে চিবুকে ওষ্ঠে কপোলে আশ্চর্য এক বিভা। গলা যেন মৃদু সুরের লহর।ভরা বর্ষার মতো তাঁর শরীরে টলমল করছে যৌবন,সুলতানতো সেই বর্ষায় ভেসেই যাবেন।


সুলতান রম্ভাকে একটি পাথরের উপর বসতে বলে নিজে দ্রুতগামী পায়ে ঘুরে ঘুরে নির্মাণকাজ পরিদর্শন করছিলেন।কক্ষের মধ্যে আধ চক্কর দেওয়ার পর সুলতান রম্ভার থেকে কিছু দুরে প্রায় বিপরীত দিকে একটি পাথরে বিশ্রাম নিতে বসলেন। সুলতান যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকে রম্ভাকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছিলো না। সুলতান তো তখন প্রেমে মত্ত, দেয়ালের পিছনে নিজেকে লুকিয়ে রম্ভার উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে আদর অনুরাগের কথা বলা শুরু করলেন।রম্ভাও প্রত্যুত্তরে তাঁর প্রেমাবেগকে ফিসফিস করে সুলতানের কাছে পৌঁছে দিলেন।
রম্ভার হাসিতে গোলগম্বুজের মধ্যে জলতরঙ্গ খেলে ওঠে।তাঁদের প্রেম উষ্ণতা ও আরমান, শব্দের কুজনে ও অনুরণনে প্রধানকক্ষ বেহেস্ত হয়ে উঠলো।কোকিলের কুহুকুহু মন তাঁদের দুজনকেই উদাস করে তুলেছিল।বসন্তের উদ্দাম মাতামাতিতে গোলগম্বুজের প্রাঙ্গনে তখন প্রবাহিত হয়ে চলেছে মলয় বাতাস।পাখির কুজনে চারদিক হয়ে উঠেছে নন্দিত।বাতাসে ভাসছে ফুলের গন্ধ।জীবনের আনন্দ ও আনন্দময় আলফাজ গম্বুজের কোণায় কোণায় প্রতিধ্বনিত হয়ে এক আজায়েবখানার (অলৌকিক জাদুঘর) রূপ নিল। সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহ কৌতুকভরে ফিসফিস করে রম্ভাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
-হে প্রিয়া পৃথিবীর অন্য কিছুর থেকেও কি,তুমি আমাকে ভালোবাসো?অস্পষ্টভাবে রম্ভার কাছ থেকে উত্তর ভেসে এসেছিল,
-হে আমার প্রনয়দেবতা, জন্নতের সব কিছুর মধ্যে, তোমার সোহাগ আমার কাছে সবসময়েই দামী। সুলতান জানতে চাইলেন,
-তুমি কি তোমার জীবনের থেকেও আমাকে বেশি ভালোবাসো?
-হ্যাঁ, সত্যিই আমার প্রভু। গ্যালারীর অপর প্রান্ত থেকে রম্ভা ফিসফিস করে উত্তর দিলেন।সুলতান বললেন,
-এখন যদি তোমাকে আমি ওই উঁচু গম্বুজের অলিন্দ থেকে নিচে ঝাঁপ দিতে বলি, তুমি তা করবে?দৃঢ়তার সাথে রম্ভাবতী উত্তর দিয়েছিলেন,
-তুমি কি আমার ভালোবাসাকে সন্দেহ করো!প্রেমিক সুলতান হেসে বলেছিলেন,
-কই করে দেখাও তো-দেখি!
প্র্রধানকক্ষের অন্যদিক থেকে পোশাকের খসখস আর নুপুরের ঝুনঝুন ঝংকার ভেসে এলো।সুলতান কিছু বলবার ও দেখার আগেই রম্ভা মুহুর্তের মধ্যে ওই উচু গম্বুজের অলিন্দ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নিচে।প্রচন্ড শব্দ শুনে, সুলতান ছুটে এলেন… অচৈতন্য রম্ভা তখন উঁচুতে বাঁধা মাচানে ঝুলছেন। জোরে চিৎকার করে উঠলেন সুলতান,
-হে আল্লা! আমার রম্ভাকে বাঁচাও!
সুলতানের চিৎকার ও ভারী কিছু নিচে পড়ার আওয়াজে সম্বিৎ ফেরে কারিগরদের। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে শ্রমিকরা ভারা থেকে রম্ভাকে উদ্ধার করে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা হতভম্ব ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় সুলতানের হাতে তুলে দেয় সংজ্ঞাহীন তাঁর প্রানাধিকা রম্ভাকে।সুলতানের আদেশে তৎক্ষণাৎ তাঁর রাজকীয় পোশাকের সাহায্যে তৈরি করা অস্থায়ী বিছানায় অচেতন রম্ভাকে শুইয়ে দেওয়া হয়।শ্রমিকেরাও তাঁদের কাজে ফিরে যায়। সুলতানের পরিচারকের শুশ্রুষায় রম্ভা ধীরে ধীরে তাঁর জ্ঞান ফিরে পায়, সুগন্ধযুক্ত জলের ছিটায় রম্ভা আসতে আসতে তাঁর চোখ খোলে। সুলতান অধীর আগ্রহে তাঁর দিকেই তাকিয়ে ছিলেন, চোখাচোখি হলো দুজনের মধ্যে। সুলতান তাঁকে ফিসফিস করে বললেন,
-প্রিয় রম্ভা, এই দাসের কাছে তোমার ভালবাসার জন্য কি পুরষ্কার চাই! তুমি যদি চাও আমি আমার জীবন দিতেও প্রস্তুত।রম্ভা বলেছিলেন,
-আলমপনা, আপনি যদি অনুমতি দেন তবে এই মকবরায় আমি আপনার পাশে আশ্রয় পেতে চাই। কেয়ামতের দিনেও যেন আমরা পাশাপাশি থাকতে পারি।হতবুদ্ধি সুলতানের চোখে তখন জলের ধারা। কথা বলার শক্তি হারিয়েছেন তিনি। উত্তর দিলেন,
-তাই হবে, আমার ভালবাসা!
আজও সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহ ও তাঁর প্রেমিকা রম্ভা গোলগম্বুজের জাঁকালো অথচ নীরব খিলানকক্ষে পাশাপাশি শুয়ে আছেন। গোলগম্বুজ থেকে মাত্র দু কিলোমিটার দূরে শহরের আলী দরজার কাছে অবস্থিত রম্ভাপুর গঞ্জের(অতীতে নাম ছিল রামপুর) নাম সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহ তাঁর প্রেমিকার নামেই রেখেছিলেন। আজ রম্ভাপুরে আদিলশাহীদের আমলে নির্মিত একটি কুয়ো ছাড়া আর কোনোও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়-না।
গোলগম্বুজের প্রাঙ্গন চত্বরে পশ্চিমদিকে অবস্থিত মসজিদে কোনো ছাদপ্রাচীর চোখে পড়ে না।মসজিদের সম্মুখভাগে পাঁচটি খিলান দেখতে পাওয়া যায়।ইমারতের দুইপ্রান্তে গম্বুজ সহ দুটি তন্বী বুরুজ যুক্ত করা হয়েছে।ইংরেজদের আমলে মসজিদটি অথিতিদের বিশ্রামগৃহ হিসেবে ব্যবহার করা হতো।উদ্যানে শোভিত গোলগম্বুজ প্রাঙ্গনের দক্ষিণদিকে খিলানশোভিত ইমারতটি অতীতে ছিল নক্করখানা, এখান থেকে প্রহরে প্রহরে বাদ্যযন্র্র এবং সঙ্গীত পরিবেশন করা হতো। বর্তমানে বিজাপুর শহরে পুরাতাত্ত্বিক দপ্তরের সংগ্রহশালা এখানেই গড়ে উঠেছে।আধুনিক মধ্যযুগের অনেক কামান এই সংগ্রহশালার সামনে রাখা আছে।হয়তো-বা এই নহবতখানা থেকে একদিন যে সুর ভেসে আসতো, তা ছিল সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহ ও রম্ভার হৃদয়ের কথা। আজও হয়তো-বা কোনো চন্দ্রালোকিত রাতে দুজনার ভালোবাসার গানে গোলগম্বুজের খিলান, গবাক্ষ, অলিন্দ, গম্বুজকে ছুঁয়ে থাকে তাঁদের সুরের তরঙ্গ, বাতাস হয়ে ওঠে মদির।
আমার গাইড ইব্রাহিম বলে,
-স্যার আসুন একটু বাগানে গিয়ে বসি। চলুন, ভাবি গোলগম্বুজের সিঁড়ির কথা।
সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহ ও রম্ভার প্রেমকাহিনী মুখে মুখে তৈরী হয় আবার একদিন মিলিয়েও যায়। এনিয়ে আর ইব্রাহিমের সাথে কোনো তর্ক করিনা আমি।গোলগম্বুজের প্রশস্ত বাগানে এক কোণায় চুপ করে বসেছিলাম। কত পর্যটক আসছেন আবার চলেও যাচ্ছেন। ভাবছিলাম, আচ্ছা আমাদের তো একটাই জীবন, জীবনটাতো নিজের মতো, নিজের খুশির মতো অথবা নিজের তৈরী করা সুখ ও দুঃখ নিয়েই তো কাটানো উচিত।সুখেরই হোক অথবা দুঃখের, নিজের জীবনের নিজস্ব অভিজ্ঞতা বা মনের মধ্যে স্মৃতির ভাণ্ডারে যা থাকে তা তো দুঃখ ও সুখেরই স্মৃতি। যেদিকটায় নিক্তির ভার বেশি সেদিকটাই জ্বলজ্বল করে, মনে থাকে। অন্য দিকটার কথা মনে থাকে-না।
-আচ্ছা জীবন কি কিছু হওয়ার জন্য?
-না-কি জীবন শুধু যাপনের জন্য!
পৃথিবীতে সুখী মানুষতো সে, যে ‘দুঃখ’ নিয়ে আলাপ করতে পারে। আসলে দুঃখ নিয়ে বিলাস করবার পর্যাপ্ত সময়তো একজন সুখী মানুষেরই থাকে। জমকালো পোশাক, রত্ন বসানো তলোয়ার,দামি চুনি-মুক্তোর মালা, কাবুলের আঙ্গুর, কান্দাহারের চেরী, মজার-ই-শরীফের আখরোট, খোবানী … সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহতো সুখী মানুষই ছিলেন। টাকা পয়সা নিয়ে আমরা যতই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করি, সুখের উপকরণে টাকা পয়সার ভূমিকাতো বেশ বড়। মজার-ই-শরীফ থেকে কার্পেট, বদখশান থেকে লাল রুবি …সুলতানেরতো তো আর অভাব ছিলো না। সুলতান মানে তো এক আরব্য রজনীর রূপকথা, ঘোড়ায় চড়ে আসবেন বিদ্যুৎগতিতে, প্রিয়াকে একটানে তুলে নিয়ে কোলে বসিয়ে চলে যাবেন, দূর-দূরান্তে। তারপর কোনো প্রাসাদের নির্জন কক্ষে সুলতান মাথা পেতে দেবেন তাঁর প্রেমিকার মখমলের চটিতে। তাই হয়তো সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহ তাঁর মকবরায় দুঃখ নিয়ে বিলাস আর আলাপ করেছিলেন।
অত্যুচ্চ গোলগম্বুজের সামনে তার পুলক আর শিহরণভরা হৃদয় আকৃতি নিয়ে যে দর্শক দাঁড়াবেন,তাঁরও মনে হবে সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরব্য রজনীর এক চরিত্র। অনুভূতির স্তরে কল্পনা করতে করতে সে শুনতে পাবে রম্ভাবতী’র নূপুর ও ঘুঙরুর শব্দ। রাগ-রাগিণীর বোধ আর কল্পনায় ফিরোজা ও পারস্যের নীল রঙতো আর আপনি স্কুল থেকে শেখেন-নি, এ বোধ তো আপনি নিজেকে ঘষেমেজেই তৈরী করেছেন।গোলগম্বুজ একটা বর্ণমালা। বর্ণমালা তৈরী করতে অনেক সময় লাগে, কিন্তু তৈরী হয়ে গেলে আমাদের কাছে বানান শেখাটাও তো সহজ হয়ে যায় না-কি।আসলে মুসাফির তো সে, যে জীবনের অর্থ খুঁজতে বের হয়।যে জীবনকে নিয়ে এতো আয়োজন,তার অর্থ তো জানাই দরকার। জীবনের অর্থ কোথায় পাওয়া যায় কেউ জানে-না।আমিতো জানিই না, আপনিও কিন্তু জানেন-না। তাই একজন প্রকৃত মুসাফির পথকে নির্দিষ্ট করে বের হয়-না।সে একটা বড় গৃহের খোঁজে নিজের ছোট গৃহকে ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ে। যে গৃহে পৌঁছাতে পারলে সে জানতে পারবে … সে কে, সে কেন, সে কোথায়?
গোলগম্বুজ দেখে বেড়িয়ে আসার সময়ে মনে হলো, যেদিন আমি থাকবো-না, সেদিনও এই নিঃশব্দ সমাধি মন্দির আগামী দিনের শিল্পী স্থপতিদের প্রেরণা হয়ে এমনি করেই দাঁড়িয়ে থাকবে।সেদিন হয়তো সেই অধিকারহীন মজুর চাষীর দল যাঁরা সুলতানের এই মহামূল্য অবদান থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন,এই শিল্প পিঠে আনাগোনা করবেন। গোলগম্বুজের সত্যিকারের সার্থকতাও সেদিনই!
ফিরে যাবার সময় মনে হয়েছিল, গোলগম্বুজের চারধারে যে অলীক কাটাতাঁরের বেড়া দিয়ে সুলতানেরা ঘিরে দিয়েছিলেন, অধিকাংশ মানুষদের যে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙাবার অধিকার ছিল-না, হয়তো-বা আগামীকালের কোনো ঝড় সেই বেড়াকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে যাবে। নাকে এসে লাগে শ্রমিকদের স্যাঁতস্যাঁতে ঘামের গন্ধ। পাথর নামিয়ে সে যখন বিশ্রাম নেয়,আমার মনে ভেসে ওঠে তাঁদের চোখের ভাষা।আর আমি… জীবন ও জীবনের বোধ অনুভূতিগুলোকে ছুঁয়ে দেখবার চেষ্টা করি।
প্রেম ও জীবনসৌধের এই মহিমাময় প্রতিকৃতির পায়ে কত জীবন দেউলে হয়ে গেছে।কত লক্ষ লক্ষ মানুষের ক্ষুধার আহার ছিনিয়ে নিয়ে এসে ব্যক্তিগত শিল্প খেয়ালকে সুলতান প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।এই মর্মর সৌধে যেন তাঁদেরই কঙ্কালের আভাস আমি খুঁজে পাই।কঙ্কালের কান্নায় নিঃশব্দ সমাধি দেউল যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে।যে হাজার হাজার শ্রমিক কারিগরদের পরিশ্রমে এই সমাধি মন্দির গড়ে উঠেছে…আজ আকাশ ছাওয়া সোনালী রোদ তাঁদের সেই অদৃশ্য অকিঞ্চনকে গোলগম্বুজের অলঙ্কারের মধ্যে ফুটিয়ে তোলে।চার্লস বোদলেয়ার বলেছিলেন, ‘….In order for the artist to have a world to express he must first be situated in this world oppressed or oppressing resigned or rebellious a man among men…একজন শিল্পীর নিজের সৃষ্টিকে পৃথিবীর সামনে ব্যক্ত করা তখনি সম্ভব যখন তিনি সেই বাস্তব বিশ্বের এক অংশীদার হতে পারেন, আর শিল্পীই তো এই পৃথিবীতে হয় শোষণকারী বা শোষিত অথবা নির্লিপ্ত কিংবা প্রতিবাদী হয়ে থাকেন।
দূর আকাশে গুড়গুড়িয়ে মেঘ ডাকে।ফজরের আজানের সুর ভেসে আসে।চোখ বুজে স্বপ্নে দেখি সুলতান মুহাম্মদ আদিলশাহ গোলগম্বুজের অলিন্দে দাঁড়িয়ে হাতে তালি বাজিয়ে কবুতর ওড়াচ্ছেন।ফুলের গন্ধ শুঁকছেন বাগানে ঘুরে ঘুরে।পাশে রয়েছেন রম্ভাবতী আর তাঁদেরকে ঘিরে রেখেছে খুবসুরত সব পাখপাখালি। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে মহাকবি ফেরদৌসীর বাণী …
– ‘তাঁর পবিত্র সমাধির ওপর করুনাধারা বর্ষিত হোক।মানুষ সুখে আনন্দে দিনানিপাত করে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু হয় দুঃখ বেদনার মধ্যে’।