দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরোঃ ইমারত, অট্টালিকা আর মানুষের প্রয়োজনের ভিড়ে ক্রমেই রঙ হারাচ্ছে প্রকৃতি! তবে সভ্য সমাজের রুক্ষ চেহারার আসে পাশে চোখ মেললেই এখনোও প্রচুর জায়গা রয়েছে, সে সব স্থানের প্রকৃতির রূপ নিমেষেই চোখ জুড়িয়ে দেয়। তাই প্রকৃতি প্রেমীরা বার বার সে সব স্থানে ছুটে যায় প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিতে। প্রকৃতির তেমনি এক দান ‘সেঞ্চাল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য’ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল।
কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে ভোরের চাদর সরিয়ে যখন সূর্যের প্রথম কিরণ পড়ে, পাহাড় সেজে ওঠে তার অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্যে! সে দৃশ্যের স্বাদ নিতে প্রকৃতি প্রেমীরা টাইগার হিলে ছুটে যায় বারবার। আর এই টাইগার হিলে যাওয়ার পথেই রয়েছে প্রকৃতি আরএক অপরূপ স্থান। সেঞ্চালের অপূর্ব প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করেই আপনি হারিয়ে যেতে পারেন প্রকৃতির কোলে। পাখিদের দেশে।


পেশায় আলোকচিত্রী ‘কৃষ্ণা রায়’ নেশায় একজন পাখি প্রেমী। প্রকৃতির আনাচে কানাচে ঘুরে পাখি দেখা, তাদেরকে ক্যামেরা বন্দী করা, পাখিদের স্বাধীনতার জন্য আমানবিকদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা, প্রায় অবসরে ঢলে পড়া প্রানবন্ত প্রকৃতি প্রেমী মানবী। কাজের ফাঁকে তার অবসর কাটে পাখিদের নিয়ে। তার কথায়,পাখি দেখার জন্য মাঠে মাঠে ছুটে বেড়ানো তাকে অক্সিজেন যোগায়।


আরও পড়ুন : শীতের শুরুতেই নিউটাউনে দেখা মিলেছে বিরলতম পরিযায়ী পাখির, যা এবারের শীতকালে পাখিপ্রেমী কাছে বাড়তি পাওনা
কিছুদিন আগেই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন ‘সেঞ্চাল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে’ উদ্দেশ্য ছিল লুপ্তপ্রায় ‘পাহাড়ি তিতির’ (Hill partridge)- কে একবার চাক্ষুষ করা। বহু বছর পর সন্ধান মিলেছে এই পাখির। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ‘পাখি ভালোবাসা’ মানুষ গুলি ভিড় জমাচ্ছেন এই জায়গায়। দেশের ২০০০ এর বেশি আলোকচিত্রী ইতিমধ্যেই এই সেঞ্চালে ছুটে এসেছেন এই লুপ্ত প্রায়, অপরূপ সুন্দর পাখিটিকে ক্যামেরা বন্দী করার উদ্দেশ্যে।


পাহাড়ি তিতির দেখতে অনেকটা কোয়েলের মতো। পিঠ হলদে সবুজাভ ধূসর। পিঠের দিকে হালকা লালচে আভা যুক্ত। পেট ও দুই পাশ ধূসর। লালচে বর্ণের চোখ ও পা।
শক্ত আঁশের মত পালক দিয়ে ঢাকা শরীর। ডানার পালকে দু’টি সাদা ও কালো গোলাকার ফোঁটার ডোরা আছে। ডানা সাদা রঙের ছোট ছোট ফোঁটা যুক্ত। গলার কালো অংশে লাল ছোট ছোট ফোঁটা থাকে। চোখ কালো। চোখের চারপাশে হালকা সাদা রঙের মোটা দাগ আছে। এদের দৈর্ঘ্য ২৭ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৩৫০ গ্রামের মতো হয়।


এই অরণ্যে বিভিন্ন ধরনের পাখির বাস। তবে তা এতদিন প্রচারের আলোয় ছিলোনা সেভাবে। এই অভয়ারণ্যের পাশে ছোট্ট এক খাবারের দোকানের মালিক নষ্ট হওয়া বা বেচে থাকা খাবার জঙ্গলের পাশে ফেলতেন। সেই খাবার খেতে আসতো পাখিরা। একদিন হঠাৎ তারা নতুন এক জোড়া পাখি দেখতে পেলেন। তার পর সে খবর ছড়িয়ে পড়তে এই সুন্দরী পাখিদের কে দেখতে ভিড় জমতে শুরু করে।


ওই স্থানের পুলিশ দফতরের আই.সি. মিংমা লেপচা দায়িত্ব নিয়ে পাখি দুটির খেয়াল রাখতে শুরু করেন। কারণ এই পাখি তার সুস্বাদু মাংসের কারণে শিকারিদের খুব প্রিয়। এবং এদের বিলুপ্তির কারণ অনেকাংশে এটাই। মিঃ লেপচা ওই স্থানে একটি পার্চ (পাখিদের বসার জন্য দাঁড়) বানিয়ে দিয়েছেন। হিল প্যাট্রিজের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির লাফিং থ্রাশ, বিভিন্ন প্রজাতির ম্যাগপাই, চেস্টনাট হেডেড টেসিয়া, প্যারটবিল, লিওথ্রিক্স, ফুলভেটা, দার্জিলিং কাঠঠোকরা, বাদামী রঙের পেঁচা, সবুজ ফিঞ্চ, রোজ ফিঞ্চ ইত্যাদি পাখি দেখতে পাওয়া যায়।


এছাড়া এখানের আরও একটি উল্লেখ্য বিষয়, ব্রিটিশ প্রিয়ডের থেকেও বহু পুরনো গুহা-মন্দির। এটি একটি দুর্গা মন্দির। স্থানীয় জনগণ যাকে সেঞ্চাল মন্দির বলে। স্থানীয় ভাষায় সেঞ্চাল কথার অর্থ দুর্গা। এই কারণেই সম্ভবত ওই স্থানের নাম সেঞ্চাল। স্থানীয় মানুষদের কাছে পরম ভক্তির স্থান এই মন্দির। যেকোনো শুভ কাজের আগে তারা এই মন্দিরে গিয়ে পুজো দেয়। অনেকে এই মন্দিরে বিবাহ করতেও আসে। তারা এখনও এই গুহার ভেতরের মন্দিরটির সাবেকিয়ানা বজায় রেখেছে। মাটির প্রদীপের আলোতেই আলোকিত হয় দুর্গা মূর্তিটি।


এই যাত্রায় আলোকচিত্রী কৃষ্ণা রায়, প্রীতম দে নামের একজন গাইডকে পাশে পেয়েছিলেন। যিনি নিজেও একজন পেশাদার ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার। পাশাপাশি তিনি মহানন্দা ইকো ট্যুরিজম অ্যান্ড কনজারভেশন সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও সদস্য। তিনিও এই সেঞ্চাল অভয়ারণ্যটির দেখা-শোনার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন। যাতে পাখিরা হারিয়ে না যায় তার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।


তাই যারা প্রকৃতির কোলে কিছুটা সময় কাটাতে চাইছেন। সুন্দর সুন্দর পাখি দেখতে চাইছেন তারা কলকাতা থেকে দার্জিলিং গামী ট্রেনে করে এনজিপি নেমে সেখান থেকে গাড়িতে করে পৌঁছে যেতে পারেন সেঞ্চাল। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল সব থেকে ভালো সময় যাওয়ার জন্য। শীতের সময় নানা পাখির আনাগোনা হয়। মাত্র ৫০ টাকার টিকিট কেটে আপনাকে প্রবেশ করতে হবে এই অভয়ারণ্যে।


তবে এখানে যেতে হলে কিছু জিনিস আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রকৃতি ও পাখিরা যেমন আপনাকে আনন্দ দেবে। ঠিক তেমনি তাদেরকে ভালো রাখা, ঠিক ভাবে বাঁচতে দেওয়া আপনার কর্তব্য। তাই অভয়ারণ্যে প্রবেশের পর জোরে হর্ণ বাজানো, চেঁচামেচি করা, শিকার করা, দাহ্য বস্তু নিয়ে প্রবেশ করা, বনভূমির মধ্যে রান্না করা, জোরে মিউজিক সিস্টেম বাজানোর উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আছে। যত্রতত্র প্লাস্টিক, খাবারের প্যাকেট ফেলে পরিবেশ নোংরা করা চলবে না। নিয়ম ভঙ্গ করলে আপনাকে আইন অনুযায়ী শাস্তির মুখেও পড়তে হতে পারে।
লেখা – তানিয়া তুস সাবা।