29 C
Kolkata
Sunday, June 11, 2023
More

    সাতকোশিয়ার সাতকাহন -বিপ্রনাথ মজুমদার

    তখন সবেমাত্র কোভিডের প্রথম ঢেউ নিম্নমুখী। আর তাই সে সময়টাকেই আমরা পাখির চোখ করলাম। বন্ধুরা মিলে উঠে পড়লাম রাতের ট্রেনে। চেন্নাই মেল , এখন চলছে কোভিড স্পেশাল তকমা নিয়ে। যদিও বেশ রাতের ট্রেন, তবুও টিফিনবক্সের এদিক ওদিক থেকে বের হয় ছোট করে ভাজা পরোটা, কষা আলুর দম, চিকেনকষা আর ঘি এর সনপাপড়ি। আড্ডা আর গল্প গড়ায় মাঝরাতে। অনুভব করি দমবন্ধ জীবনে মুক্তির স্বাদের লাগামহীন আনন্দকে। আর কয়েক ঘন্টা পরে কাকভোরে ঘুমচোখ খুলে নেমে পড়ি ভুবনেশ্বরে। স্টেশনের বাইরে গরম চায়ে চুমুক দিতে না দিতেই হাজির আমাদের জাইলোর সারথি রমেশ। ছটফটে ছোকরা নিমিষে হাসিমুখে আলাপ জমায় আমাদের সাথে। ছটা চা বেড়ে হয় সাতটা, আর রমেশ হয়ে ওঠে আমাদেরকেই একজন।

    গাড়ি ছুটে চলে ভোরের হাইওয়ে ধরে। মসৃণ রাস্তার বুক ছুঁয়ে গাড়ি প্রথম দাঁড়ায় এক ড্যামের বুকের ওপর । এটা মুন্ডলি ড্যাম। মহানদীর বিস্তৃত জল ভোরের মনকে তরতাজা করে দেয়। মহানদীর অসাধারণ সৌন্দর্যে ভোরের সূর্য তার পেলবতার পরশ মাখায় ধীরে ধীরে। উপভোগ করি প্রকৃতি। বাঁধের জলে নিশ্চিত ভেসে থাকা চখাচখির মত মনও হয়ে যায় হাল্কা। সেল্ফি আর ছবি ওঠে দেদার। মাস্ককে পকেটে রেখেই। ফের বিরতি রোডসাইড ধাবায়। সেখানে কেউ মাসালা ধোসা বা বিড়ি বড়া উইথ সম্বর। কেউ বা পুরি সব্জি। সব গরম গরম। তবে কিং সাইজের জিলিপিতে ছিল সবাই কমন। রমেশ ও। গরমমশলার ফ্লেভারের মত , সকালবেলা থেকেই সমস্ত ব্যাপারটাতেই ছড়িয়ে পড়ছিল বোহেমিয়ানার গন্ধ । গাড়ি গড়াল আবার। যেতে হবে অনেক দুর।

    গাড়ি এবার থামল অঙ্গুলে। এখান থেকে গাড়িতে বোঝাই হল কোল্ড ড্রিঙ্কস, চিপস আর হরেক শুকনো খাবার। সিগারেটের প্যাকেট। আরো কিছু টুকিটাকি। কারণ আগামী তিরিশ কিলোমিটারের মধ্যে মিলবে আর কিছুই। আর গোটা পথটাই জঙ্গলের। এলিফ্যান্ট করিডর। বেশ ছমছমে। শান্ত আর নিঝুম। শাল সেগূনে মোড়া এই পথে দিনের বেলাতেও বনরোমাঞ্চ। ভালোবাসতে ইচ্ছা করে গোটা সফরটাকেই। বদলাতে থাকে শহুরে মন। বাঁধা পড়ে জঙ্গলের আদিম গন্ধর বেড়াজালে। সময় চুরি হয়ে যায় দ্রুত। বারবার গাড়ি থেকে নেমে পড়ে আমরা ঘ্রাণ নি আদিমতার। ফ্রেমবন্দি থাকে টুকরো মুহুর্তরা। আমাদের দেখে ছোকরা যুবক- রমেশের সরল হাসি মুহুর্তে শিখিয়ে দিয়ে যায় ভালোবাসাতে গেলে টাকাপয়সা নয়, দরকার একটা দরাজ মনের।

    এবার আমরা ঢুকে পরি টিকরপাড়ার অন্দরে। মন থেকে বুদ্ধদেব গুহর চরিত্ররা উঁকি মেরে যেতে থাকে অহরহ। বাঘ্যমুন্ডা, টিকরপাড়া, লবঙ্গী ,বিনিকেই- বইয়ে পড়া জায়গার নামগুলো মনের মধ্যে ঘাই মেরে যেতে থাকে। রোমাঞ্চিত মন অহরহ ঘ্রাণ নিতে থাকে খোলামেলা প্রকৃতির। দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম টিকড়পাড়া ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারির খুব কাছে। বাফার জোনে। মাথার উপর সূর্য নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম শুনশান রাস্তায়। চোখে এল এলিফ্যান্ট করিডরের বিজ্ঞপ্তি।। হলুদে জমিতে কালো দিয়ে লেখা – এ পথ কিন্তু মহাকালের। সারা জঙ্গলের পথ থমথমে, আর রাস্তার দুপাশে ইলেকট্রিক ফেন্সিং। অসহ্য নীরবতার মাঝে চমকে উঠি উড়ে যাওয়া শুকনো শালপাতা শব্দে। আমরাও যেন কথা ভুলে ডুব দিয়ে যাই নিস্তরঙ্গ মৌনতায়। গাড়ি বাঁক নেয় এবার ইকো কটেজের চৌহদ্দি তে।

    টিকরপাড়া চেকপোস্টের খুব সামনেই রাত যাপন। এটা আমাদের ইকো কটেজ। এখানে এসির বিলাসিতা নেই। বরং চতুর্দিক।জুড়ে রয়েছে অসংখ্য গাছগাছালির নীরব বিস্তার। ভালোবেসে ফেলি প্রথম দর্শনেই। দুফুরেই হানা মারি থমথমে লবঙ্গীর জঙ্গলের অন্দরমহলে। চেকপোস্টে পার হয়ে কাছাকাছিই। সেখান থেকে দেখা হল বালাঙ্গা জলপ্রপাত। লোহা পাথরের ফাঁক গলে তিরতিরে জলের ধারা গড়িয়ে এসে হারিয়ে যায় জঙ্গলের বুকে। জঙ্গলের পরিবেশ পড়ন্ত রোদে নেশা লাগিয়ে দেয়। আর জঙ্গলের নিজস্ব গন্ধ, ঘরে ফেরা পাখিদের কলতান সাথে হাতিদের গল্পে গা ছমছম করে বৈকি। ফিরতি পথে মিষ্টি জলের পুখরিতে হাতির পায়ের টাটকা ছাপ বুকের কাঁপুনি বাড়িয়ে তোলে।রাতে রিসর্টের নিঝুম পরিবেশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে দেখতে আর রাতচরাদের নানা শব্দ শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিয়ে যায়।

    পরের দিন টিকরপাড়া কুমির প্রকল্প দেখা আর উত্তর সাতকোশিয়ায় মহানদীর গর্জে বোট বিহার। সেখানেও দেখা মিলল কুমির, কচ্ছপ আর নানা পরিযায়ী পাখির। সফর ছিল চমৎকার।সফর শেষে ঢুঁ মারা ছুটকেই আর বাঘ্যমুন্ডার জঙ্গলে। সফর শেষে রিসর্টে আড্ডা দিয়ে রাতে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়া। হঠকারিতা বা অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়।এলিফ্যান্ট করিডর গুলোতে আলো নিভিয়ে দাঁড়িয়ে হাতির জন্য অপেক্ষায় থাকা। কিন্তু আমরা হাতির দেখা পাইনি। বরং পেলাম চাঁদের রুপোলি আলোয় ধুয়ে যাওয়া জঙ্গলের অভূতপূর্ব রূপকথার আখ্যান , বনজোনাকির নরম নীলাভ আলোর খেলা, অসহ্য উত্তেজনায় নিজেদের হৃদপিন্ডের লাব- ডাব শব্দ আর ফিরে না আসা সব অবিস্মরণীয় মুহুর্তকনার যোগফল।

    তৃতীয় দিনে আমরা দেখে নিলাম বিনিকেই মায়ের মন্দির আর বিনিকেই এ মহানদীর অপূর্ব রূপ। সাতকোশিয়া গর্জের শুরু এখানেই বলা চলে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই সাতকোশিয়া দুটি দিক থেকে যাওয়া যায় । উত্তর আর দক্ষিণ। মহানদীর দু পাড় ধরে। আমরা কিন্তু বেছে নিয়েছিলাম উত্তর দিকের অংশকে। দুফুরের খাওয়া ছিল বাক্সবন্দি। পিকনিকের মেজাজ ফিরল লাঞ্চে।
    ফিরতে ফিরতে আজ বিকেল গড়ালো। রাতে আজ শুধু আড্ডা আর জঙ্গলচর্চায় রাত হয়ে পড়ে গাঢ়। সম্বিত ভাঙে অনেক দুরে থমথমিয়ে ডেকে ওঠা কোটরে পেঁচার অস্থির ডাকে। কেয়ারটেকার জানায় এখানে রাতে সজারু চলে অহরহ। মন খারাপ হয় যখন মনে হয় কাল জঙ্গলের শেষ দিন।

    আজ আমাদের শেষ দিন। সাড়ে আটটায় ব্রেকফাস্ট করে নিয়ে বেড়িয়ে প্রথমে দেখে নেওয়া হল সপ্তসজ্জা, সাত মুনির পীঠস্থান। সাড়ে ভেঙে পাহাড়ের উপর মন্দির। এর পর আবার বেড়িয়ে সেখান থেকে ধবলেশ্বর। মহানদীর উপর ঝুলন্ত সেতু পেড়িয়ে দেবদর্শন। ঝুলন্ত সেতুর বিস্তারে হার মানে যেন লছমনঝোলা । মহানদীর স্বচ্ছ নীল জলে দেখা মেলে অসংখ্য কচ্ছপের । দুফুরের খাওয়া সারা হল ধবলেশ্বরের গোছানো রেস্তোরায়। ফিরতি পথে নন্দনকানন দেখে ভুবনেশ্বর । এবার রমেশকে ছেড়ে যাবার পালা। বিনিময় হয় ফোন নম্বর আর ভালোবাসা । হয়না শুধু কিছু না বলা কথা। মুসাফির আমরা সবাই। ভগবানের কারখানায়। ঠাসা সূচীতে ভরপুর সফর শেষ হল এখানেই। আলবিদা।

    Related Posts

    Comments

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    সেরা পছন্দ

    হেডের দুরন্ত সেঞ্চুরি WTC প্রথম দিনেই চালকের আসনে অস্ট্রেলিয়া।

    দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : হেডের দুরন্ত সেঞ্চুরি প্রথম দিনেই চালকের আসনে অস্ট্রেলিয়া। ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে টসে জিতে রোহিত শর্মা ফিল্ডিং...

    কোচ হতে চলেছেন ‘কলকাতার মহারাজ’ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : ১৪ ম্যাচে মাত্র পাঁচটি জয়। ১০ পয়েন্ট নিয়ে নয় নম্বরে শেষ করেছিল দিল্লি ক্যাপিটালস। তখনই দেওয়াল লিখন...

    ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের শ্রদ্ধা নিবেদন ভারতীয় ক্রিকেট দলের ।

    দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল শুরু হওয়ার আগে ভারতীয় ক্রিকেট দল বালেশ্বরে হওয়া ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ব্যাক্তিদের উদ্দেশে...

    অভিষেকের বিরুদ্ধে পোস্টার খোদ সিঙ্গুরেই ।

    দ্য কালকাটা মিরর ব্যুরো : এবার অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে পোস্টার পড়লো তৃণমূল কংগ্রেসের ভিত্তিভূমি খোদ সিঙ্গুরের । ' চোর ডাকাতের যুবরাজ নট...

    ১০০ দিনের কাজ নিয়ে কেন্দ্রকে তলব কোলকাতা হাইকোর্টের ।

    দ্য কালকাটা মিরর ব্যুরো : ১০০ দিনের কাজের টাকা নিয়ে কেন্দ্র রাজ্য তরজা লেগেই ছিলো । একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানির পর কোলকাতা...