“জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা”

0
78

ফারহান নূর শারিক – সাংবাদিক ও লেখক

সংবেদনশীল মানসিকতা ধারন করা এক রকম অধ্যাবসায়ের মতো। নির্দিষ্ট করে উল্লেখ না করলেও প্রত্যেকটা সময় স্মারকের মতো স্পষ্ট হয়ে থাকে। যদিও, সময় কখনো নিঃসঙ্গ হয় না। রাতে ঘুম না এলেও, বেলা বেড়ে গেলেও, মেঘে মেঘে আঁধার চার দেয়ালে বাঁধে নিজ মনের সাথেই কথপোকথন। সেখানে ঘুমন্ত শহরে জেগে ওঠা নক্ষত্র বাতি জ্বালায় নিভু নিভু শূন্যতার কাছাকাছি। আকাশ কোনে অবিরত ঝড় নেমে আসে মাঝে মাঝে, মন বাসনা তপ্ত মাটির মতো শোষন করে বৃষ্টির বারিধারা। তারপরও স্পর্ষের সীমান্ত ভেঙে নিঁখাদ চুমুর অতৃপ্তিটা শিশিরের বিষ পান করার মতোই অধরা থেকে যায়। সময় সেখানেও নিঃসঙ্গতাকে স্থান দেয় না। আমন্ত্রণ করে মনোলোভের জোয়ারকে। নয়ত শূন্যতার প্রেমাংশুর প্রেতাত্মাকে। সেখানে ’জীবনবোধ’ অধিকাংশ সময় বেঁচে থাকার অন্যতম কারণ। যদিও ’জীবন-বোধ’ বিষয়টা অনেকটা এলেবেলের মতো। কোথাও মন নিবিষ্ট করতে সংবেদনশীল হতে হয়। সময়টা এখন এমনই। আর আমরা সেই সময়ের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। কেউ কারো কথা শুনতে পারছে না। অস্তিত্ব রক্ষায় পথে নামা মানুষের আর্তনাদ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। মানুষের ব্যক্তিজীবন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এতটাই আষ্টে-পৃষ্টে জড়িত যে ব্যক্তিগত সুবিধাভোগ করার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। খুব অদ্ভুত লাগে আমাদের এই প্রজন্মের দ্বিধাহীনতা এবং বিক্ষিপ্ত সুযোগ সন্ধানী চিন্তা করার প্রক্রিয়া দেখে। আজ শহরের খেলার মাঠগুলো বিলিন হয়ে গেছে বলতে গেলে, কিন্তু সে বিষয়ে কারও তেমন কোনো মাথা ব্যথা নেই, বরং টেলিভিশনের খেলার প্রতি রয়েছে চরম উন্মাদনা। অবশ্য এই ব্যবস্থাও রাষ্ট্রের সূচিন্ত রাজনৈতিক পদক্ষেপের মধ্যে একটা। একটা নতুন স্বপ্ন নিয়ে এগুতে হলে সব থেকে প্রথমে প্রয়োজন প্রজন্ম গঠন। কিন্তু সেক্ষেত্রে আসল সমস্যা আমাদের প্রজন্ম গঠনেই। আসল সমস্যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়। আসল সমস্যা আমাদের চিন্তায়। আর সে সমস্যা সৃষ্টি করেছে খোদ রাষ্ট্র ও তার রাজনীতি। আমরা অপরিকল্পিতভাবে সন্তানের পর সন্তান জন্ম দিচ্ছি কিন্তু শিক্ষাটা দিতে পারছি না। পারিবারিক ভাবে সম্মান দেয়াটা যেমন শিখছি না তেমনি একটি শিশু জন্মের পর পর তার প্রথা ঠিক করে দেয়ার পাশাপাশি আমরা তাকে অন্তর্ভুক্ত করছি ৪টি শিক্ষা ব্যবস্থার যেকোনো একটিতে।আমরা যেমন ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষার্থীদের পাশ্চাত্বের শিক্ষাটাকে প্রধান করার পর বাংলা মিডিয়ামের শিক্ষার্থীদের সাথে বলছি পহেলা বৈশাখসহ দেশের ঐতিহ্য, উৎসব পালন করো। তেমনি মাদ্রাসায় পড়ানো হচ্ছে সব থেকে শ্রেষ্ঠ উৎসব ঈদে মিলাদুন্নবী। আর একদলকে খাঁকি পোশাকে গড়ে তুলছি একটি বাহিনীর অন্তুর্ভূক্ত করতে। সমস্যাটা দাঁড়িয়েছে যখন একদল বাংলার বর্ষবরণ উৎসব ‘পহেলা বৈশাখ’-কে বিধর্মীদের ধর্ম বলে আখ্যা দিয়ে এর বিরোধিতা করে। লেলিয়ে দেয় গোষ্ঠীভুক্ত ছাত্রদের।কিন্তু কথাছিলো সবাই একসাথে পালন করবো আমাদের নতুন বছর ‘পহেলা বৈশাখকে’ উৎসব বিষয়টি এই কারণে উল্লেখ করা হলো কারণ তা সংস্কৃতির ধারক। এই কারণে এটি একটি প্রথা। এখন বিষয়টা হলো এখানে খুব ভালোভাবে আঁকড়ে আছে পুঁজি। কেউ আর্থিকভাবে ভালোভাবে স্বচ্ছল হচ্ছেন বলেই তিনি তার সন্তানকে বিশ্বের সাথে তাল মেলানোর প্রয়াসে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন। যাদের অর্থ কিছুটা কম তারা পড়াচ্ছেন সরকারি স্কুল-কলেজ কিংবা বাংলা মিডিয়ামে। আর গ্রামের কৃষক। কিংবা আরও সাধারণ তারা ইহকাল পরকাল চিন্তা করে পড়াচ্ছেন মাদ্রাসায়। এখন যদি সবার সমান আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকতো তাহলে তো সবাই সবচেয়ে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থায় তাদের সন্তানকে পড়াতেন। সেক্ষেত্রে দেশে এক শিক্ষা ব্যবস্থা থাকতো। এ ক্ষেত্রে এক দেশের সব শিশুর কী অধিকার নেই এক দেশে সমান শিক্ষাটা নেয়া? সেক্ষেত্রে পুঁজি কে উহ্য করে রাষ্ট্র কী পারে না এই ৪ ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা বাদ দিয়ে কেবল এক শিক্ষা ব্যবস্থা কি করা যায় না? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও দেখা যাচ্ছে মুক্তচিন্তার জায়গা রুদ্ধ করে প্রশাসনের পক্ষে একটি গোষ্ঠী তৈরি করা হচ্ছে।রুদ্ধ করা হচ্ছে চিন্তার পথ। যে পথে ছফা সাহেব হাঁটতো, যে পথে রুদ্র হাঁটতো, যে পথে নভেরা হাঁটতো, যে পথে সুলতান নাচতো- সে পথেই এখন হাঁটে কিছু সরকারি চাকুরিলোভী কিংবা প্রশাসনের অধীনস্ত কিংবা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাদের নীচে আশ্রয় নেয়া ভ্রান্ত কিছু ছেলে-মেয়ে। হয়তো তাই এখন তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা না হওয়ার পাশাপাশি, কেউ কোনো বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা পর্যন্ত করছে না বা করতে পারছে না। শেষ আবিষ্কার হওয়া পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী এ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। যখন সমাজে প্রভাব বিস্তার করা প্রতিষ্ঠিত প্রথাগুলোর জন্ম হয়নি। নিজস্ব কৃষ্টি, শিল্প দ্বারা এ অঞ্চল ছিলো সমৃদ্ধ। পর সংস্কৃতির আভিজাত্য প্রদশর্নের পূর্বে একবার নিজেদের লোকশিল্পের দিকে তাকালে আমরা সেখানে দেখি ঐতিহ্যময় ও গৌরবমণ্ডিত ইতিহাস। নীল আকাশ, অসংখ্য নদনদী, খাল বিল, বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত জুড়ে সবুজের সমারোহ শুধু যে নৈসর্গিক ভুখন্ডকে উপস্থাপন করে না তা নয়। ঘরোয়া জীবনের বিয়ে বাড়ির মেঝেতে আঁকা আল্পনা, শাড়ি ও অন্যান্য পোশাকের নকশা, গয়নার বিচিত্র গড়ন, মাটি ও পিতল কাঁসার হাঁড়িতে খোদাই করা নানা কাজ। সেখানেই উঠে এসেছে কিভাবে একটি জাতি ঐতিহ্যে সমৃদ্ধশীল হয়েছে। টলেমির উল্লেখিত ‘সৌনাগড়া’ আমাদের এ অঞ্চল ‘বাংলা’। আমাদের ইতিহাস বলে, একসময় যখন সব ভাষাকে সুন্দর হিসেবে উপলব্ধি না করে, মা-মাটির ভাষাকে তুচ্ছ করে ৫২ তে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক বাঙালি উর্দুকে পবিত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু, বাংলা ভাষার যে আভিজাত্য, ঐতিহ্য এবং ভাষার যে প্রেম তা উপলব্ধি যারা করেছিলো তাদের ভাষা রক্ষার আন্দোলনে টেকেনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ও তাদের অনুগত নাগরিকদের সেই হঠকারী মনোভাব। বাংলা হয়েছে রাষ্ট্র ভাষা। তখন যদি সেই ভাষার প্রেম মানুষের উপলব্ধি না হতো তাহলে ৭১-এ দেশ প্রেম যেমন জাগ্রত হতো না, সংগ্রামও হতো না, স্বাধীনও হতো না বাংলাদেশ। শেষে একটা কথাই বলতে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম আমরা। আমাদের হাতেই দেশ। আমরাই পারি সব অসুন্দরকে সরিয়ে একটি সুন্দর দেশ গড়তে। সে ক্ষেত্রে একটি নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা অসম্ভব নয় যা প্রথার অন্ধকার হতে মুক্ত ও স্বাধীন। যা প্রস্তরকালীন বর্বরতা সমর্থন করে না বরং নিবেদিত প্রতিটি প্রাণের জন্য। আমাদের এ সমাজ একসময় তেমনটি ছিলো। সমাজ ছিলো কবিদের, মুক্ত চিন্তার ও বিস্তার ছিলো প্রেমের|

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here