অ-মানুষ

0
74

ফারহান নূর শারিক সাংবাদিক ও লেখক

জায়গাটা মুক্তচিন্তার। লেখার মান, চিন্তার পরিধি ও তার বিস্তার সব কিছু সমালোচিত হতে পারে কিন্তু অবজ্ঞেয় নয়। গ্রহণ কিংবা বর্জন ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর নির্ভর করছে সামগ্রিক ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। তারপরও প্রথার প্রচার হলে প্রথাবিরোধী প্রচারও হবে। কেবল প্রথার প্রচারণাই চলবে প্রথাবিরোধী কোনো যুক্তি চলবে না তা তো নয়। কিন্তু বর্তমানে যে সমাজ ব্যবস্থা চলছে, তা কেবল প্রথার প্রচারণাকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে। মুক্ত চিন্তার জায়গাটা প্রথা বা প্রথাবিরোধী কোনো বিষয় নয়। যেকোনো বিষয় নিয়ে জ্ঞান ও ভাবনার বহিঃপ্রকাশ, তা বাস্তবিকও হতে পারে, হতে পারে নানা তত্ত্বের । যুক্তির মাধ্যমে আত্ম উপলব্ধি। তার প্রকাশ ঘটতেও পারে। কিন্তু, সে প্রকাশিত মতবাদ যে ধারণ করতে হবে এমন কোনো বাধকতা আছে কি? সমাজতো তাই চাপিয়ে দিচ্ছে। নতুন প্রাণ জন্মানোর সাথে সাথে পারিবারিক ঐতিহ্য কিংবা সামাজিক রীতি অনুসারে তাকে গোষ্ঠীভুক্ত করে দিচ্ছে। যদি সে গোষ্ঠীভুক্ত না হয়ে স্বতন্ত্র মানুষ হতো? যদি সে নিজ থেকেই নির্নয় করতো সে কি চায়? গোষ্ঠীভুক্ত হওয়া যেমন দোষের কিছু না তেমনি গোষ্ঠীর বাইরে থেকে নিজেকে মানুষ ভাবা অন্যায় না। অথচ, যুগ যুগ ধরে প্রথা ব্যবহৃত হয়ে আসছে রাজনৈতিক স্বার্থে, রাজ্য দখল, সিংহাসনের মসনদ হরণ কিংবা জিইয়ে রাখার কারণে। প্রথাবিরোধী অবস্থানও আজ তার শিকার। সমাজ হত্যাকারীকে লালন করছে, তাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, সময়মতো ব্যবহার করছে আবার তাকে আড়ালও করে ফেলছে। কিন্তু, তার বাহ্যিক রূপ কতটা ভয়ংকর তা কি দেখতে পারছে না? আসিরিয়ান বা ‘আসু’ শব্দ থেকে এশিয়ার নামকরণ করা হয়েছে। রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের নাম ছিল আসিরিয়ান, আর সেই নাম থেকেই এই মহাদেশের নাম হয়েছে ‘এশিয়া। আর সে প্রদেশের সম্রাট ছিলেন নমরুদ। প্রাচীন গ্রন্থে দেয়া ইতিহাস অনুসারে নূহরে বংশধর ‘নমরুদ। বাইবেলের বুকস অফ জেনেসিস ও বুকস অফ ক্রোনিকেলস অনুসারে নমরুদ ছিলেন কুশের পুত্র, হামের পৌত্র এবং নূহের প্রোপৌত্র। ইহুদি ধর্মে তাকে বলা হয়েছে “As a man of power in the earth, and a mighty hunter.” আকাশে পৌঁছানো জন্য তিনি সে সময় সুইচ্চ বিল্ডিং তৈরি করেন। যার নাম Tower of Babel. এমনকি স্বর্গের খোজেঁ তিনি শকুন নিয়ে আকাশেও উড়েছিলেন। বিজ্ঞান মনস্ক সাংস্কৃতিক এই রাষ্ট্র প্রধানকে পরবর্তীতে উপস্থাপন করা হয়েছে নীচ ভাবে। কারণ তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন না। আর নমরুদের সময়ই খোদার প্রতিনিধিত্বকারী ছিলেন ইব্রাহিম নবী। প্রাচীন গ্রন্থে বলা হয়েছে মশার আকৃতির, আকারে আরও ক্ষুদ্র মাংসাশী প্রাণী নাক দিয়ে মাথায় ঢুকে নমরুদের। এরপর এক করুণ পরিনতির মধ্য দিয়ে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু তার সময়ের যে শিল্পকলা, বিজ্ঞানের ব্যবহার ও স্থাপত্য সবই উহ্য থেকেছে। ধর্মান্ধ রাষ্ট্র প্রধানরা তা আড়াল করেছে। যুগে যুগে তার বদলে উঠে এসেছে নমরুদের মৃত্যুর করুণ কাহিনী । প্রাচীন ভারতে নমস্কার কথাটা এসেছে দুটো প্রাণ বা সত্তা বা আত্মাকে সম্মান জানানোর প্রেক্ষাপটে। নমস্কারের অর্থ- আপনি একটা প্রাণ, আপনার প্রাণকেই শ্রদ্ধার করে আমি নমন্বিত হয়েছি। সক্রেটিস কোনো ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করে না এবং তাদের পুর্বপুরুষের ধর্মেও বিশ্বাসী নয়, এবং তিনি তার জ্ঞানের মাধ্যমে তরুণদের বিভ্রান্ত করছে এই অভিযোগ এনে রাষ্ট্রপরিচালনাকারীরা সক্রেটিসকে হেমলক পান করায়। কিন্তু, তিনি যে সত্যের হেমলাক রেখে গেছেন তা কি শেষ হয়েছে? নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে প্রায় ৩৭ কি.মি.বিস্তৃত সমুদ্র সৈকতের প্রান্ত ছুঁয়ে ঘন উপকুলীয় বন আর পর্বত মালার প্রেমভূমি সীতাকুণ্ডে মানুষের বসবাস শুরু হয়। সীতাকুণ্ডের অধিবাসি তথা বাঙালিদের মাঝে এ ধারনা প্রচলিত আছে যে প্রাচীনকালে এ স্থানে মহামুনি ভার্গব বসবাস করতেন। তাছাড়া, অযোদ্ধার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র তার বনবাসের সময় এখানে এসেছিলেন। আর সে সময় মহামুণি ভার্গব রাম-সীতা আসবেন জানতে পেরে তাঁদের স্নানের জন্য তিনটি কুণ্ড সৃষ্টি করেন । রামচন্দ্রের বনবাসকালে কালে তাঁর স্ত্রী সীতা এই কুণ্ডে স্নান করেন। আর সেই স্নান এতটাই বিখ্যাত হয়ে যায় যে এই স্থানের নাম হয়ে যায় সীতাকুণ্ড। আবার অনেকের মতে রাম স্বয়ং তার পত্নীর নামেই সীতাকুণ্ড নাম করণ করেন। আবার অনেকের মতে দক্ষরাজার মহাযজ্ঞের সময় ক্ষিপ্ত উম্মত্ত শিব তার পত্নী সতীর শবদেহ খণ্ড বিখণ্ড করেন এবং তার নামানুসারে সতীকুণ্ড কালের বির্বতনে বিকৃত হয়ে সীতাকুণ্ড হয় । হিন্দু ধর্মের পুরাণিক উপাখ্যানে নারদ মুনির ভূমিকা থেকে স্পষ্ট হয় যে দক্ষরাজার কন্যা পার্বতী মা বাবার অগোচরে ভালবেসে বিয়ে করেন শিবকে । এতে রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে এিভূবনের সবাইকে আমন্ত্রন জানালেন। সেখানে শিবকে অপদস্ত করার জন্য তার মূর্তি বানিয়ে রাজপ্রাসাদের তোরণের বাইরে প্রহরী হিসাবে রাখা হলো।নারদ মুনি থেকে পার্বতী একথা জানতে পেরে নিজেই প্রত্যক্ষ করলেন এবং লজ্জায় অপমান আত্যহত্যা করলেন। পার্বতী বেচে নেই জেনে উম্মত্তপ্রায় শিব পার্বতীর মৃতদেহ মাথায় নিয়ে প্রলয় নাচন শুরু করলেন। এক পর্যায়ে ৫২ খণ্ডে খণ্ডিত পার্বতীর দেহ ৫২ স্থানে নিক্ষিপ্ত হয়ে ৫২ তীর্থ কেন্দ্রের উদ্ভব হয়। তারমধ্যে সীতাকুন্ডও একটি। সতী পার্বতীর উরুসন্ধীর অংশ এখানে নিক্ষিপ্ত হয়েছে বলে প্রচলন আছে। খুব বেশিদূর যাওয়ার প্রয়েজন নেই। চর্যাপদ পড়লেইতো আমি যোগীদের দেখি। তাদের মধ্য দিয়ে এ ভূখণ্ডের প্রেম অনুভব করি, ক্ষুধা অনুভব করি। স্বপ্ন দেখি। বুঝি আমার সমাজকে। সেখানে পদগুলো এরকম- “চা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী। মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।। উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি। ণিঅ ঘরণী ণামে সহজ সুন্দারী।। ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী। একেলী সবরী এ বণ হিণ্ডই কর্ণ কুণ্ডলবজ্রধারী।।” “উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা। নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। শবর-শবরীর প্রেমে পাগল হলো। কামনার রঙে তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম। শয্যা পাতা হলো। শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাত্রিযাপন করলো।? কিন্তু, এই মুহূর্তে আমরা একটা বিকারগ্রস্ত সমাজে বসবাস করছি। যেখানে আমি আমার নিজের তথা সঙ্গিনীর নিরাপত্তা দিতে পারছি না, সঙ্গীনী কথাটা এড়িয়ে সঙ্গী বলতে পারলে আরও তৃপ্ত হতাম যদিনা এই লিঙ্গ পরিবর্তনের ব্যকরনের ধারাটা না থাকতো। যদিনা, শাড়ি, চুড়ি, টিপ আমার সঙ্গীনীর পরিচিতি না হয়ে কেবল অলংকার হতো। সমাজে পোশাক একটি বড় ধারক। কিন্তু এই প্রথাটাও ভাঙতে চেয়ছিলেন এসএম সুলতান। যিনি একসময় এই নগরীতে শাড়ি পড়ে ঘুরতেন। সমাজ তাকে পাগল বোধ করলেও তাতে কিছু যায় আসেনি। কারণ তিনি না খেয়ে থাকলেও সমাজ কিংবা মানুষ এসে তাকে খাইয়ে দিয়ে যায়নি। বরং তার শিল্প সৃষ্টি ও স্বত্ত্বাকে পুঁজি করেছে। আহমদ ছফার মতে- সুলতান বেঁচে থাকার সময় তৎকালীন সমাজ ও শিল্পীরা তাকে ”নিরব উপেক্ষা” করেছিলো। পোশাক সবসময়ই আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও, যুগ যুগ ধরে যারা বাংলার এ অঞ্চলে এসেছেন, তারা আসার সময় নানা বানী, প্রথা বা ধর্ম, রাষ্ট্র ধারনা নিয়ে এসেছেন, বাণিজ্য করেছেন। তার সাথে তারা যে সংস্কৃতির বিস্তার ঘটাতে চেয়েছেন তার অন্যতম ধারক পোশাক। প্রথা মানা না মানা যেমন ব্যক্তিগত, তেমনি পোশাকটাও। লুঙ্গি বা ধুতি পড়ে বিলেত যাওয়া যেমন দৃষ্টিকটু না তেমন ঢাকার রাস্তায় শর্টস পড়ে চলাটাও মোটেও উত্তেজক না। আমি যেটায় স্বাচ্ছন্দ বোধ করি তাই আমার পরিধেয় হওয়া উচিত । কিন্তু, এক্ষেত্রে আমরা কতটা সাবলীল।? যতদিন সামাজিক প্রথা বা ব্যবস্থার পরিবর্তন না হবে, মুক্তিচিন্তার বিকাশ না ঘটবে এবং সাবলীল না হওয়া যাবে, ততদিন সমস্যাগুলো আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাবে। এই উত্তর আধুনিক যুগেও আমরা পায়ে শেকল জড়িয়ে স্থবির হয়ে বসে আছি। অবস্থাটা এমন দাঁড়াচ্ছে যে, রাঁধাকে খুজতে কৃষ্ণ আর জঙ্গলে যাচ্ছে না। পার্বতীকে হারিয়ে শিব পাগল নৃত্য আর নাচছে না। রাম আর সীতা এক সাথে আর স্নানও করতে পারছে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here