দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো: হাইনরিখ হেরার এর জন্ম হয় 1912 সালের 6ই জুলাই, অস্ট্রিয়ার ছোট্ট একটি শহর হুটনবার্গ-এ। তার পিতা ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মী। শৈশব থেকেই হেরার তার প্রতিভা তুলে ধরেন স্কিইং এ, ও শিরে ধিরে ধিরে পর্বতারোহণ তাকে আকৃষ্ট করে। হাইনরিখ হেরারই ছিলেন শেষ ইউরোপীয় তথা প্রথম বিশ্বের ব্যক্তি যিনি কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন স্বাধীন তিব্বতের শেষ দিন গুলি। তার লেখা “সেভেন ইয়ার্স ইন টিবেট” আজ ও পাঠক কুলের মাঝে সমান ভাবে সমাদৃত। তার লেখাতে বর্নণা মেলে স্বাধীন তিব্বতের সংস্কৃতি ওই ঐতিহ্যের।
1936 সালে আল্পসের কুখ্যাত শৃঙ্গ আইগার জয় করে, জার্মানী অধিকৃত অস্ট্রিয়াতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তাঁর কৃতিত্বের কথা। সময়টি ছিল ইউরোপে পর্বতারোহণ এর স্বর্ণযুগ। আল্পসে একের পর এক সফল অভিযান সম্পন্ন করে দুঃসাহসী ইউরোপীয় যুবকেরা পাড়ি দিতে শুরু করেছে ভারতীয় উপমহাদেশে, ওই সময় তেই শুরু ইউরোপীয়দের পৃথিবীর উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গ জয়ের পাগলামি।
1939 সালে হেরার ভারতবর্ষে আসেন নাঙ্গা পর্বত জয় করার অভিপ্রায় নিয়ে। ইতি মধ্যেই শুরু হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ… অভিযানটি ব্যর্থ হয় এবং নিজে জাতীতে অস্ট্রীয় হওয়ায় তিনি কারা বন্দি হন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে। প্রথমে বোম্বে তে ও সেখানথেকে স্থানান্তরিত হন দেহরাদুনের ব্রিটিশ যুদ্ধ বন্দি ক্যাম্পে। অজস্র বার পালানোর চেষ্টা করেন ও ব্যর্থ হন। অবশেষে এ 1944 সালে শ্রমিকের ছদ্মবেশে পালিয়ে যান সেখান থেকে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের থাবা থেকে বাঁচতে তিনি ঠিক করেন তিব্বত হয়ে জাপান অধিকৃত বার্মাতে পৌঁছাবেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী 1944 সালের 17ই মে তে তাসং চোখলা পাস অতিক্রম করে তিব্বতে প্রবেশ করেন। তিব্বত তথা তিব্বতের রাজধানী লাসা ছিল বিদেশিদের জন্য নিষিদ্ধ। তার পর্বতারহনের কৌশল কে কাজে লাগিয়ে দুই বছর যাবৎ নিজের প্রাণ হাতে করে পশ্চিম তিব্বতে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে থাকেন। ততদিনে তিনি অতিক্রম করেছেন কৈলাশ গিরি শৃঙ্গ, গাইরং প্রদেশ ও উত্তরে চ্যাংথ্যাং।
অবশেষে এ 1946 সালের 15ই জানুয়ারি এসে উপস্থিত হন লাসার দোরগোড়ায়। তার অসীম সাহস তথা বিগত দুই বছরের কঠোর পথ অতিক্রম করার কারণে তিব্বতীরা তাকে দূরে ঠেলে দেয়নি।
1948 সালে তিব্বত সরকার তাকে পাশ্চাত্য খবর অনুবাদক হিসেবে নিয়োগ করে। এবং পরে হেরার কে নিয়োগ করা হয় চতুর্দশতম এবং বর্তমান দলাইলামা তেনজিং ঘাস্ত-এর গৃহশিক্ষক হিসেবে। হেরার তাঁর বিজ্ঞান, ভূগোল এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতি শিক্ষার দায়িত্ব নেন। হেরার খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন সরল সাদাসিধা, অহিংস ওই মানুষ গুলিকে। তার লেখাতে সেই কথা ফুটে ওঠে বারবার।
কিন্তু ওই সুন্দর দিন গুলি স্থায়ী হয়নি। 1950 সাল থেকে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি ধীরে ধীরে গ্রাস করে তিব্বত কে, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরবর্তী বিশ্বের একটি কালো অধ্যায় সেটি। অজস্র নিষ্পাপ মানুষকে হত্যা করা হয় নির্বিচারে, পুড়িয়ে ফেলা হয় অজস্র পুঁথি এবং তার সাথে স্বাধীন তিব্বতের সংস্কৃতি।
1952 সালে হেরার তাঁর জন্ম ভূমি অস্ট্রিয়াতে ফেরেন। তার তিব্বতে কাটান সময় নিয়ে রচনা করেন সেভেন “ইয়ার্স ইন টিবেট”।
1965 সালে তাঁর রচিত বইটির ওপর ভিত্তি করে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়। 1997 সালে নির্মিত হয় একটি পূর্ন দৈর্ঘ্যের চলচিত্র। হেরার এর ভূমিকায় অভিনয় করেন বিখ্যাত অভিনেতা ব্রাড পিট।
হেরারের নানা রঙের জীবন তার পর্বতারোহণ তথা পরিব্রাজন বিগত সাতটি দশক ধরে অনুপ্রাণিত করে আসছে ভ্রমণপিপাসু, প্রকৃতি তথা সংস্কৃতি প্রেমী মানুষদের…
2006 সালে 93 বছর বয়সে এই প্রতিভাবান পাবতারোহী ও অভিযাত্রী শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন।
তিনি লিখেছেন…
“আমি যেখানেই থাকি না কেন, আমি তিব্বতের জন্য সহানুভূতি বোধ করব। আমি প্রায়শই মনে করি আমি এখনও বন্য রৌদ্র এবং সরষের কান্না এবং তাদের ডানাগুলি ঝাপটাতে শুনতে পাচ্ছি যখন তারা লাসার উপর দিয়ে পরিষ্কার ও ঠান্ডা আলোয় উড়ছে। আমার আন্তরিক ইচ্ছা এই যে আমার গল্পটি এমন একটি লোকের জন্য কিছুটা বোঝাপড়া তৈরি করতে পারে যার শান্তিতে ও স্বাধীনতায় বাঁচার ইচ্ছা উদাসীন বিশ্ব থেকে এতটা সহানুভূতি অর্জন করেছে।”