ইনার পার্টি স্ট্রাগলের রণনীতিতে ভুল করে ফেললেন রাজস্থানের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী ও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শচীন পায়লট। রাজনীতিতে ধৈর্য্যহীনতার কোনও ক্ষমা নেই। কালের কষ্টিপাথরের গায়ে কোনও রং লাগেনা। নির্মম, নির্মল, নির্মোহ, নির্বিকল্প কাল তাকে এতোটাই নিস্পৃহ করেছে। তাই কংগ্রেস রাজনীতির অন্দরমহলে উপদলীয় ভাইরাস যতই তীব্র হোক, শচীনের কুসুমাস্তীর্ণ কেরিয়ারে তা বিষদাঁত ফোটাতে পারে নি এতদিন। কিন্তু তাঁর প্রতিযোগী ও বিরোধীদের চাল শেষ টা ফলপ্রসূ হল। লম্বা রেসের ঘোড়া ও কংগ্রেসের যুব ব্রিগেডের কার্যত সেকেন্ড ইন কমান্ড এবং ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারের বিকল্প ব্যক্তিত্ব হিসেবে জনমানসে আসন পাতা শচীন পায়লট অবশ্যই গত তিনদিনে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন, তা সারাজীবন তাঁর কাজে লাগবে। ইতিমধ্যেই লেগেছে। নাহলে পদ ও প্রায় দল হারানোর পরেই ঘোর কেটেছে তাঁর। দুপা এগোতে গিয়ে তিন পা পিছিয়ে এসেছেন।
আসলে দলের ভেতরে লড়াই চালানোর কংগ্রেসি কৌশল নিয়েই এগোচ্ছিলেন শচীন। কিন্তু রাজস্থানের মত মেরুকরণের রাজনীতিতে এহয় ওঠেন নি রাজেশ পায়লটের পুত্র শচীন। এদিকে, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলোত মিকছরাজনীতিতে আসার আগে পেশায় ছিলেন জাদুকর। সবাই বলে, গেহলোতের রাজনীতির ম্যাজিকের সামনে সরকার বা বিরোধীপক্ষের কেউই দাঁড়াতে পারেনা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বুঝে সন্তানতুল্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে যেভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেন গেহলোত যে অবস্থায় পাল্টা প্রহার ছিল অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং জাদুকরের পেতে রাখা ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হন পায়লট। দলবিরোধী কার্যকলাপের দাগও লাগে তাঁর সাদা আস্তিনে। বিশেষ করে বিজেপির রাজনীতিতে কংগ্রেসকে দুর্যোগের মুখে ফেলার চেষ্টা অনেকটাই সফল হয়। আর তাতেই অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে গণতান্ত্রিকতার স্পেস কমে গিয়ে কোণঠাসা হন পায়লট। আহত শার্দুলের মতো তাঁর তখন পাল্টা আক্রমণের প্রবণতা বাড়ে। সমর্থক বিধায়কদের যখন হরিয়ানার হোটেলে তোলা হয় তখন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী ও সংঘসেবক মনোহরলাল খট্টরের চেলাচামুন্ডারা যে নেপথ্যে, তা টের না পাওয়ার কথা নয় পায়লটের। কিন্তু তখন রণনীতি বলে আর কিছুই নেই। শুধু একটাই ভাবনা, “এবার নয়তো নেভার ।” যে শ্লোগানে মুখরিত ছিল বাংলা ২০০৬ য়ের বিধানসভা ভোটের প্রচারে।
অধীর আহ্বানে ব্যাপক আবেগের উপকরণ ছিল। কারণ নেত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । কিন্তু বাসব প্রস্তুতির ফাঁক রয়ে গিয়েছিল বলেই সেবার লক্ষপূরণ হয়নি। যদিও কংগ্রেস বিরোধী শক্তির ইষ্টলাভ হয়েছে আগেই। কংগ্রেস দু টুকরো হয়েছে বাংলায় ১৯৯৯ তেই। তার পর এনডিএ সরকার চলেছে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পাঁচ বছরে, ২০০৪ পর্যন্ত। মৃতপ্রায় কংগ্রেসের পাশাপাশি শুরু হয়েছে বাম জমানার শেষের সেদিন আর তৃণমূলের নান্দীমুখ। সেটা ছিল মাটির নীচের ঘনঘটা। তৃণমূল স্তরের ওপরে সে লক্ষ্মণ ফুটে ওঠেনি তখনও ঘাসফুল হয়ে।
কংগ্রেসে সেই ভাঙনের আগে মুষলপর্বে কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও জমানায় শচীন পায়লটের বাবা রাজেশ ছিলেন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা মন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের একটি মূল শাখা। তখন মূল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শংকররাও চহ্বানের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের তুমুল সংঘাত ছিল রাজেশ পায়লটের। কিন্তু বাবার সেই কুশলী কূটনৈতিক রণনীতি রপ্ত করতে পারেননি শচীন। রাজেশের অকালে চলে যাওয়ার সময় তাঁর বয়স খুবই অপরিণত। সেসময় ও পরবর্তী সময়ে সীতারাম কেশরীর কালে বাংলার বিদ্রোহী মমতাকে নিরস্ত করতে এআইসিসির দূত হয়ে আসতেন তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত নেতা রাজেশ পায়লট বা কমলনাথ। ইতিহাসের চাকায় আজ সেই দুই নেতার রাজ্যেই পিষ্ট হচ্ছে কংগ্রেস। সেই সময় বাংলার রাজনীতি ছিল দ্বিপক্ষীয়। একদিকে বাম, অন্যদিকে কংগ্রেস। তৃণমূলের আবির্ভাবে বঙ্গ রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তির সৃষ্টি হয়।তারপর বিজেপির উত্থানে চতুস্পদ হয় বাংলার রাজনীতি। বাস্তবতা ভিন্ন হলেও উত্তর ও মধ্যভারতে সেই প্রক্রিয়াই শুরু হয়েছে। অবশ্য রাজস্থান আর মধ্যপ্রদেশ অনেকটাই আলাদা বাস্তবে। তাই কংগ্রেস হাইকমান্ডের জমিদারীপ্রথার অবসান না হলেও সংঘের সেবক বা শাবক হওয়া অত সোজা হবেনা শচীনের পক্ষে। কারণ জ্যোতিরাদিত্য ও শচীনের রাজনীতি আর জীবনের বাস্তবতা এক নয়। দুজনের রাজনীতির কার্যকারণ সম্পূর্ণ আলাদা। তবে দলতন্ত্রের অসাধ্য কিছু নেই। সবদলেই দলতন্ত্র গণতন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি।