তাহলে কী এবার করোনা জয় নিশ্চিত

0
66

এই মূহুর্তে সারা বিশ্বে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ করোনা আক্রান্ত। মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৬.২ লক্ষ মানুষের। আর এই সংখ্যা প্রতি ঘণ্টায় বেড়েই চলেছে। যখন সারা বিশ্বের তাবর তাবর দেশ নাস্তানাবুদ ঠিক সেই মূহুর্তে ‘বুলস আই’ হিট করলো অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি। ঠিক কী ঘটেছে সেখানে জেনে নেব বিস্তারে।

দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো:এই প্রতিবেদনটি শুরু করার আগে রবিদাদুর একটি গান খুব মনে পড়ে যাচ্ছে “আমি ভয় করব না ভয় করব না/ দু বেলা মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না”। হ্যাঁ যে মৃত্যুভয় আমাকে আপনাকে ছায়ার মত টপ টু বটম জড়িয়ে রয়েছে এবার সেই করাল ছায়া কে জোরালো আলো দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার নতুন ভোর খুব সন্নিকটে।

এই বছরের জুন মাসের ২৪ তারিখ পরীক্ষামূলক ভাবে ইংল্যান্ড এ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের গবেষণা লব্ধ করোনা ভ্যাকসিনের মানবশরীরে প্রয়োগ শুরু হয়েছিল। প্রায় ৩০০ জন স্বেচ্ছাসেবক তাদের শরীরে এই ভ্যাকসিনের প্রয়োগে রাজি হয় এবং দীর্ঘ ২৬ দিনের মাথায় খুশির খবর শোনালেন বিশেষজ্ঞরা। 

৩০০ জন দিয়ে শুরু করে প্রায় ১০৭৭ জনের শরীরে ভ্যাক্সিনের প্রয়োগ  জনিত পরীক্ষাগুলি দেখিয়েছিল যে এই ইনজেকশনটি তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করেছিল এবং সেই টি-কোষ তৈরি করে যা করোনভাইরাসের সাথে  লড়াই করতে পারে ও তাকে কাবু করতে পারে।

গবেষকদের এই অনুসন্ধানগুলি বিপুল পরিমাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তবে এটি এখনো সঠিক সুরক্ষা দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট কিনা তা খুব শীঘ্রই জানা যাবে এবং বৃহত্তর প্রয়োগের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা চলছে।

গবেষকদের এই সাফল্য নিরীক্ষণ করে যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে এই ভ্যাকসিনের ১০০ মিলিয়ন ডোজ অর্ডার করেছে।

এবার জেনে নেওয়া যাক ভ্যাকসিন কীভাবে কাজ করে?

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৈরি এই ভ্যাক্সিনের জেনেরিক নাম ChAdOx1 nCoV-19। এবং একেই অভূতপূর্ব গতিতে তৈরি করা হচ্ছে বাজার জাত করার জন্যে।

এটি জিনগতভাবে ইঞ্জিনিয়ারড মানে জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড একটি ভাইরাস থেকে তৈরি করা হয়েছে যা শিম্পাঞ্জির শরীরে সাধারণ সর্দিগর্মী সৃষ্টি করে।

ভ্যাকসিন তৈরির আগে এটি বিশদভাবে এবং বৃহত্তর ভাবে সংশোধন করা হয়েছে যাতে এটি মানুষের শরীরে কোণভাবেই সংক্রমণ ছড়াতে না পারে  এবং এটিকে দেখতে অনেকটাই করোনা ভাইরাসের মতই।

বিজ্ঞানীরা করোনভাইরাসের মানব শরীরের কোষগুলিকে আক্রমণ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহৃত “স্পাইক প্রোটিন” এ প্রবাহিত জিনগত নির্দেশগুলিকে স্থানান্তর করেই এই ভ্যাক্সিনে রূপান্তরিত করেছেন।

যার আক্ষরিক অর্থ এই ভ্যাকসিনটি করোনাভাইরাসের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং করোনা ভাইরাস কিভাবে মানব ইমিউন সিস্টেম কে আক্রমণ করতে পারে তা শিখতে পারে অতি সহজেই।

এবার আসা যাক অ্যান্টিবডি এবং টি-সেল গুলি কী সেই বিষয়ে। এখন পর্যন্ত করোনা প্রতিরোধে অ্যান্টীবডিই হিল আমাদের চর্চার মূল বিষয়। কিন্তু আদতে এটি আমাদের শরীরের প্রতিরোধ প্রতিরক্ষার মাত্র একটি অংশ।

অ্যান্টিবডিগুলি আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা দ্বারা তৈরি ছোট প্রোটিন যা ভাইরাসের পিঠের উপরে লেগে থাকে।

গবেষকরা দেখিয়েছেন যে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডিগুলি করোনভাইরাসকে অক্ষম করতে পারে।

টি-কোষগুলি এক ধরণের শ্বেত রক্ত কণিকা যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সমন্বিত করতে সহায়তা করে এবং দেহের কোন কোষ সংক্রামিত হয়েছে তা চিহ্নিত করতে এবং তাদের ধ্বংস করতে সক্ষম হয়।

প্রায় সমস্ত কার্যকর ভ্যাকসিন অ্যান্টিবডি এবং একটি টি-সেল প্রতিক্রিয়া এই উভয়কেই প্ররোচিত করে থাকে।

টিকা দেওয়ার ১৪ দিন পরে টি-কোষের স্তরগুলি শীর্ষে অবস্থান করে এবং ২৮ দিনের পরে অ্যান্টিবডি তার শীর্ষ স্তরে যায়। তবে ল্যানসেটের গবেষণায় এই দুই এর শীর্ষে থাকা কত দিন স্থায়ী হতে পারে তা বোঝার জন্য অধ্যয়ন করা হয় নি।

অক্সফোর্ড গবেষণা গ্রুপের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পোলার্ড এই বিষয়ে বলেছেন: “আজ আমরা প্রকাশিত ফলাফল দেখে সত্যিই সন্তুষ্ট হচ্ছি কারণ আমরা করোনার অ্যান্টিবডি এবং টি-কোষ উভয়কেই নিষ্ক্রিয় হতে দেখছি।

“তারা অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিশীল এবং আমরা বিশ্বাস করি যে এই প্রকারের প্রতিক্রিয়াটি সুরক্ষার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে”।

“তবে সবাই যে মূল প্রশ্নটির উত্তর জানতে চায় তা হ’ল এই ভ্যাকসিন কি সত্যিই কাজ করে, এটি কী সত্যিই সুরক্ষা দেয়…… এবং আমরা সেই মাহেন্দ্রক্ষনের অপেক্ষার আছি।”

গবেষকদের করা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে ৯০% লোক মাত্র এক ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে অ্যান্টিবডিগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে তুলতে পেরেছিল। মাত্র দশ জনকে দুটি ডোজ দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে সবাই অ্যান্টিবডিগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে তোলে।

প্রফেসর পোলার্ড আরো বলেছেন যে, “আমরা সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় স্তরটি সম্পর্কে এখনো ওয়াকিবহাল নয় তবে দ্বিতীয় ডোজ দিয়ে আমরা সর্বোচ্চ সাড়ার স্তরে পৌছতে পারি।  “

এবার লক্ষ টাকার প্রশ্ন এটি কী নিরাপদ?

হ্যাঁ, নিরাপদ তবে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে।

যদিও ভ্যাকসিন গ্রহণ করার পর থেকে কোনও বিপজ্জনক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি, তবে, পরীক্ষার ৭০০% লোক জ্বর বা মাথাব্যথার  শিকার হয়েছেন।

গবেষকরা বলছেন এই ধরনের সমস্যা সাধরিন জ্বরের মতই প্যারাসিটামল দিয়ে পরিচালনা করা যেতে পারে।

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সারা গিলবার্ট বলেছেন: “যদিও আমাদের ভ্যাকসিন কোভিড -১৯ মহামারী কে স্থগিত করতে সাহায্য করবে কিনা তা ১০০% নিশ্চিত নই কারণ আমাদের এখনও অনেক কাজ করতে হবে, তবে এই প্রাথমিক ফলাফলগুলি যথেষ্ট প্রতিশ্রুতিমান এবং সাহসের সঞ্চার করে।”

প্রয়োগের পরবর্তী পদক্ষেপগুলি যা যা হতে পারে

এখনও অবধি ফলাফল আশাব্যঞ্জক, তবে গবেষকদের মূল উদ্দেশ্য এই ভ্যাকসিনটি মানুষকে দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত নিরাপদ করে তোলা।

গবেষণাটি এও দেখাতে পারে না যে ভ্যাকসিনটি মানুষ অসুস্থ হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে কিনা বা কোভিড -১৯ এর লক্ষণগুলি হ্রাস করতে পারে কিনা।

যুক্তরাজ্যে পরবর্তী পর্যায়ে এই ভ্যাকসিনের বৃহত্তর ট্রায়ালে ১০,০০০ এরও  বেশি লোক অংশ নেবে।

তবে এই পরীক্ষা অন্যান্য দেশেও করা হয়েছে কারণ যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের প্রকোপ তুলনামূলক কম, তাই শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যের বিচারে এই  ভ্যাকসিন কার্যকর কিনা তা জানা শক্ত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩০,০০০ মানুষের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকার ২,০০০ জন এবং ব্রাজিলের ৫,০০০ জন  মানুষ কে নিয়ে একটি বৃহত্তর প্রয়োগের কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে।

এই প্রয়োগে কিছু “চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল” করার জন্যও  ব্যবস্থা রয়েছে যাতে ভ্যাকসিনযুক্ত ব্যক্তিরা ইচ্ছাকৃতভাবে করোনভাইরাস এ আক্রান্ত চিকিত্‍সার সীমাবদ্ধতার কারণে নৈতিক উদ্বেগ রয়েছে।

আমরা কবে পাব এই ভ্যাকসিন?

এই বছর শেষের আগে এটি করোনা ভাইরাস নির্মূল করণে কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে, তবে এই মূহুর্তে এটি ব্যাপকভাবে বাজারে পাওয়া যাবে না।

যাদের বয়স বেশি বা চিকিত্সা জনিত কারণে কোভিড -১৯ থেকে উচ্চ ঝুঁকির সুযোগ আছে তার অগ্রগণ্য। এছাড়া ডাক্তার ও  স্বাস্থ্য কর্মীদেরও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

যাইহোক, যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুসারে চলে  তাহলে আগামী বছরের প্রথম দিকে বৃহত্তর ভাবে টিকা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছিলেন: “অবশ্যই আমি আশাবাদী এবং ১০০% আত্মবিশ্বাসী যে আমরা এই বছর বা প্রকৃতপক্ষে পরের বছরের শুরুর দিকে একটি ভ্যাকসিন পাব”।

অন্যান্য  দেশেও কী এই ধরণের ভ্যাকসিন নিয়ে অগ্রগতি হচ্ছে?

অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন এই পর্যায়ে পৌছানোর বিষয়ে প্রথম নয়, ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের গবেষকরা ও এই একই ফলাফল প্রকাশ করেছেন।

এই দৌড়ে মার্কিন সংস্থা ‘মোদারনা’ই প্রথম ভ্যাকসিন যা নিষ্ক্রিয় অ্যান্টিবডিগুলি তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে গবেষকরা করোনাভাইরাস আরএনএ (এর জিনগত কোড) ইনজেকশন দিচ্ছে যা প্রতিরোধের প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করে ভাইরাল প্রোটিন তৈরি করা শুরু করে।

ইতিমধ্যে বায়নটেক এবং ফাইজার সংস্থাটি তাদের আরএনএ (RNA)  ভ্যাকসিন ব্যবহার করে ইতিবাচক ফলাফলও পেয়েছে।

চিনে বিকশিত অক্সফোর্ডের অনুরূপ একটি কৌশলও আশাব্যঞ্জক ফলাফল প্রকাশ করেছে।

যাইহোক, এই সমস্ত পদ্ধতি বিজ্ঞানের চূড়ান্ত সীমানায় দাঁড়িয়ে করা এবং এর আগে এই কাজ কোনভাবে প্রমাণিত হয়নি।

এই পদ্ধতির পাশাপাশি ভ্যাকসিন বিকাশের আরও প্রচলিত পদ্ধতিগুলিও যথেষ্ট ভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। ভালনেভা নামক সংস্থাটি পুরো করোনভাইরাসটি গ্রহণ করছে, সেটিকে নিষ্ক্রিয় করছে এবং তারপরে এটি কে ভ্যাকসিন হিসেবে প্রয়োগ করতে চলেছে।

এখনো পর্যন্ত সারা বিশ্বে চলতে থাক ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলিতে মোট ২৩ টি করোনভাইরাস ভ্যাকসিন রয়েছে এবং আরও ১৪০ টি ভ্যাকসিন পরীক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

সর্বশেষে আসা যাক আমাদের দেশের  পরিস্থিতিতে। ভারতভিত্তিক জৈবপ্রযুক্তি সংস্থা ভারত বায়োটেক তার কোভিড -১৯ ভ্যাকসিন ‘কোভাক্সিন’ এর মানবিক ক্লিনিকাল পরীক্ষার সম্মতি পেয়েছে।

ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল (ডিসিজিআই) এর কাছ থেকে নিয়ন্ত্রক অনুমোদন এটিকে পরীক্ষায় প্রবেশের জন্য ভারতের ঘরোয়া ভ্যাকসিনের প্রথম নিয়ন্ত্রক অনুমোদনের চিহ্নে চিহ্নিত করে। সেই সাথে ডিসিজিআইয়ের অনুমোদন কোম্পানীকে প্রথম পর্ব এবং দ্বিতীয় অধ্যয়ন পরিচালনা করতে সক্ষম করবে, যা পরের মাসে শুরু হতে চলেছে।

শেষেও সেই রবিদাদুর কথা দিয়েই শেষ করি “চলব সোজা রাস্তা দেখে / বিপদ যদি এসে পড়ে/ সরবো না , ঘরের কোণে সরবো না”।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, ইংল্যান্ড এবং টাইমস অফ ইন্ডিয়া। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here