

বিজেপিতে বেমানান মুকুল । এটা তাঁর যোগদানের আগেই সত্যি হবে মনে হয়েছিল, পরে সত্যি প্রমাণিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হতে থাকবে। আসলে বিজেপি তো আর কলি বা মুকুল নেই । রীতিমতো বড়সড় একটা ফুল । পদ্ম ! এখন কি ফুল কুঁড়িতে ফেরানো যায় ? কিন্তু মুকুলের কী করার আছে ? তিনি তো আর বঙ্গ রাজনীতির ব্রহ্মা নন , যে নিজে পদ্ম থেকেই সৃষ্ট বলে তাঁর নাভি থেকেই উদ্গত হবে কমল। মুকুলবাবুর রাজনীতির আদি কুল তো কংগ্রেস। সেই আঁতুড়ঘরের উৎস থেকে চলতে চলতে তিনি তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাতা। কলকাতার এক ডাকসাইটে সম্পাদক তাঁর সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন,”তৃণমুকুল ।” দিনে দিনে তা সত্যি হয়েছে। কিন্তু সেই দল যখন ছাড়ার সময় হল তখন তৃণ-টা তো পড়েই রইল । পাড়ি দিলেন শুধুই মুকুল । এবং সেটা কমদিনের ব্যাপার নয়। দলের জন্য কাঠ কেটেছেন, খড় জুগিয়েছেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছেন। ডায়বেটিস সত্ত্বেও সব্যসাচীর বাড়িতে আলুর দম খেয়ে খেয়ে ‘দাদা’র হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমনই হাত বাড়ালে বন্ধু প্রমাণ করেছেন বেশ ক’জন দোদুল দোলে দোলা তৃণমূলী রাঘববোয়ালকে। সারা দেশের রাজনীতিতে ব্যতিক্রম ঘটাতে পেরেছেন বঙ্গে মুসলমানদের সঙ্গে নিতে টুকটাক টিকিট দিয়ে। টিকি বাঁধা রাজনীতি নিয়ে কটূক্তি শুনলেও কট্টরদের কূটকচালিতে কান দেননি। বাঁকুড়া থেকে ব্যারাকপুরের তৃণমূলী পিচ খুঁড়ে বিজেপির বলে স্পিন ধরিয়েছেন। বীজপুরের বীজটুকুও তুলে দিয়েছেন বিজেপিকে । আঠারো ঘা মেরেছেন প্রাক্তন নেত্রীর ক্যারিশমার সিমেন্টে গড়া তৃণমূল গড়ে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, যা করেছে সব ” দাদার খড়ম ।” পুলওয়ামার পটকথা আর পাকিস্তানের পুল । মুকুলের চাষবাস কীকরে মূল্য পাবে তার সামনে ? অথচ , লোকসভায় বিজেপির তিনশ’ পার অথব থ্রি নট থ্রি হতনা বাংলার আঠারো ছাড়া। দিলিপ ঘোষ ঘোষণা করেছিলেন, উনিশে হাফ, একুশে সাফ । এবার তাঁকে নিয়ে আঠারো হল। গৌরবে বহুবচন হলেন । ভাল রান দিলেন , তাই ক্রিজে থাকা স্বাভাবিক। যদিও ইডেনের মালিকে সবাই ভুলে গেল, যার হাতে তৈরি পিচ । এটাও স্বাভাবিক। দুয়োরানির ছেলে হয়েই রইলেন তিনি । অকুল দরিয়ার বুঝি কুল নাই রে।
অথচ বিজেপি কিন্তু মোটেই ততটা অকৃতজ্ঞ নয়। তবে অটলজি যেমন চুনোপুঁটিকে চুনো বলে হ্যাটা করতেন না। শরিক নেতারা চাইলে চুন চুন কে পূর্ণমন্ত্রী করে দিতেন। কিন্তু মোদিজি কংগ্রেসিদের মতো। হাতে জল গলেনা। কেঁদে কঁকিয়ে প্রতিমন্ত্রী। তাও একষট্টিবার প্রোগ্রেস রিপোর্ট দেখে, লাভ ক্ষতির খতিয়ানে চোখ রেখে এবং ধর্মের নয়, পলিটিক্সের পাঁজি দেখে। ‘অন্য আশা’ কুহকিনী, তোমার মায়ায় মুগ্ধ মানবের মন …..। বক আর শার্দুলের উপকথা। কথা ছিল, গলায় বিঁধে থাকা হাড়ের টুকরো বক যদি ঠোঁটের ডগায় তুলে আনে তাহলে তাকে পুরস্কৃত করবে বনের রাজা। বক সেই আশায় তার হাঁ করা মুখে গলা পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিয়ে ঠোঁট দিয়ে তুলে আনল হাড় । বলল , এবার দাও পুরস্কার। জবাব এল , তোমার জীবনই তোমার পুরস্কার। মুখের মধ্যে গলা পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিয়েও বের করে আনতে পেরেছ। চাইলেই তো তোমার মুণ্ডুটা চিবতে পারতাম। তাতো করিনি বাপু ? তো এটা কি কম তোফা ?
দুর্জন সংসর্গ ছেড়ে সাধু সমাগমে থাকতে বলেছে শাস্ত্র। যে যা বলেছে , তাবিজ কবচ মাদুলি মিডিয়া সবই তো হল। স্থানীয় ভোট , জাতীয় ভোট, এমন কি ভোটের সমীক্ষাও হয়ে গেল। একুশের সভা করোনাক্রমে ভার্চুয়াল হল । একুশের ভোট পিছনোর রূপোলি রেখা বাংলার ঘোলাটে আকাশে। রাজ্যপাল সকাশেও মন্ত্রণা ।তবু যন্ত্রণার উপশম হলনা । মধ্যপ্রদেশের মত গো বলয়ের রাজ্যেই ২২ জন কং বিধায়ক কমল সরকারের ইতি করে ইতিহাস গড়ল । জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার ডাকে । বিজেপি কিন্তু তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করেনি । মন্ত্রী করার শুধু একটা গাজর । শর্ত টর্ত নয় । গর্ত খুঁড়লেন সিন্ধিয়াই । কমলনাথের কবর । গর্ত বোঁজানোর পর করোনার সরকার। নেতা সেই আদি অনন্ত অনন্য বিজেপি-ব্রহ্ম শিবরাজ মামা। প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হওয়ার সময় আডবাণী মোদিকে করার প্রস্তাবে কাঠি দেন।সেই পবিত্র কাঠি শিবরাজ। পরে যথারীতি শরণং গচ্ছামি করে আছেন। মোদি ও শাহকে সংঘের ঢেঁকি গিলতে হয়েছে। রাতারাতি কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে এলে ভোলবদল হয় হয়ত। কিন্তু গোল বা সোল ( লক্ষ্য ও আত্মা ) বদল হয়না। কিন্তু জিনে হিন্দুত্ব আছে। মাধবরাও ও একদা জনসংঘি ছিলেন। ঠাকুমা পিসিমারা তো দলের স্তম্ভ। তবু ও ঐ রাজ্যসভার আসনটুকুই। লকডাউনের মধ্যে কিভার্চুয়াল শপথ রাষ্ট্রপতি ভবনে ? অসম্ভব। ওদিকে অবুঝ পায়লট মুখ্যমন্ত্রী হবেন বায়না। সঙ্গী সেই আঠারো জন। নবকলেবর । অতএব ঘেঁটে গেছে রাজস্থানি রামায়ণ। সুতরাং , বাংলা বাজারে ডামাডোল তো স্বাভাবিক। দল ও সংঘের নিরিখে যোগ্য মুখ তো কয়েকজন। দিল্লির দুজন আর বাংলার দুজন। সেইসঙ্গে এমন এক অশ্বমেধের ঘোড়ার কথা ভাবা হচ্ছে যার নামে তাবড় জননেতাদেরও ঢোঁক গিলতে হচ্ছে।
এই চিত্রনাট্যের মধ্যে মুকুলবাবুর দশা ব্র্যান্ডেড যন্ত্রাংশের মতো। লোকাল চলেবল্ মেশিনে দামি ও ব্র্যান্ডেড জিনিস ফিট করেনা। মিসফিট।কিন্তু এতৎসত্ত্বেও তাঁর আপাতত আর কোনও অপশন নেই । তিনি এককভাবে ভোটে জিততে বা জেতাতে পারবেন না। নতুন কোনও দলও গড়তে পারবেন না। তিনি নেপথ্যে কুশলী রাজনীতিবিদ। জননেতা নন। হওয়ার কোনও উচ্চাশা নেই। কূটনৈতিক কলা রপ্ত করতে চান। দলীয় সংগঠন ও মন্ত্রক চালানোর দক্ষতা ষোলআনা থাকা সত্ত্বেও জনমোহিনী ভাবমূর্তি নেই। উপরন্তু ছত্রছায়া ছাড়া রাজনীতি করতে অপারগ। সিবিআইয়ের তদন্তাধীন সারদা,নারদ,রোজভ্যালির মত কেস তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের ক্ষেত্রে কম্পাস বলেই মনে করেন তাঁর পুরনো দলের সহকর্মীরা।
অন্যদিকে বিজেপি তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড মুকুল রায়ের কাছ থেকে যে সাহায্য আশা করেছিল তা কতটুকু পূরণ হয়েছে, সেটাও প্রশ্ন। আবার এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নৈতিকতার পাল্টা যুক্তিও ফেলে দেওয়ার নয়। দল বদলালেই বিশ্বাস ভঙ্গ করতে হবে কেন ? রাজস্থানের এক বিজেপি নেতা মৃত রাজেশ পায়লটের কথা দাবি করে সনিয়া গান্ধী সম্পর্কে মন্তব্য বাজারে ছেড়েছেন। নৈতিকতার এমন বিপন্নতা ! মৃত মানুষের গোপন কথা যাচাই করার উপায় নেই। এবং বলে থাকলেও সেটি জনান্তিকে বলা , প্রকাশের বৈধতা নেই। অফ রেকর্ড কত কথা নেতারা বলেন। হট কেক বাজারে ছাড়লে যে ছাড়ে তাকে মাপকাঠিও ছেড়ে দেয়। এবং বিভীষণের ভূমিকা রামায়ণে যেভাবেই চিত্রিত হোক , বিভীষণ ঘরের শত্রু বলেই চিহ্নিত। তাই মুকুলবাবুর বিপক্ষের যুক্তি যাই থাক, পক্ষের যুক্তি ফেলনা নয়।মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে যে আসন দিয়েছিলেন সেই আসনের সুবাদেই তো তিনি বিজেপিতে সমাদৃত। এপর্যন্ত পরিণত রাজনীতির লোক হিসেবেই চলার চেষ্টা করেছেন। কাদার রাজনীতি করতে গেলে নিজের হাতেও কাদা লাগে একথা জানেনা কে ? তাছাড়া সাধে কি আর কেউ স্বহস্তে গড়া সাধের সাতমহল ছেড়ে আসে ? মুকুল জানেন, তৃণমূলের সঙ্গে যে শিকড়ের টান তা অতীতের কংগ্রেস বা বর্তমানের বিজেপির সঙ্গে মিলবেনা কোনওভাবেই। তাই লকডাউনের রাজনীতির সহজপাঠ অনুযায়ী চলছেন। রেটিনার চিকিৎসায় দৃষ্টি আর দৃষ্টিকোণ স্বচ্ছ হচ্ছে প্রতিদিন। মন চায় চক্ষু না চায়। তাই বলতে পারেন না , বাঁচাও কে আছো মরেছি যে প্রেম করে, বাঁচাও ….. ।
হতে পারেন তিনি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা। কিন্তু অনেক কিছুই তো হতে পারতেন। অধীর তো প্রতিপক্ষ শিবিরে বাংলার সবচেয়ে বড় নেতা। লোকসভায় বিরোধী দলনেতা কে কবে ছিলেন কংগ্রেসে ? অন্য কেন্দ্রীয় জাতীয় দলে কোথায় বাংলা ? বিজেপি, সিপিএম ? কংগ্রেসে সনিয়া বাংলাকে সম্মান দিয়েছেন তাহলে ? কংগ্রেসের ইতিহাসে এটা হয়েছিল শুধু লোকসভার নেতার পদে প্রণব মুখোপাধ্যায়। বিজেপির কোন বঙ্গসন্তান এই সম্মান পেয়েছেন ?
তাই মনে হয়, কংগ্রেসেই হতে পারতো মুকুল রায়ের মূল্যায়ন, শান্তি স্বস্ত্যয়ন। কিন্তু হারানের নাতজামাই হতে কে চায় ?