মানুষ হিসেবে আমার অপরাধসমূহ – ফারহান নূর শারিক

0
68
(সাংবাদিক ও লেখক)

মানুষ হিসেবে আমার অপরাধ অনেক। আমি অপরাধী আমার চিন্তার কারণে। আমি অপরাধী কথা বলার স্বাধীনতা আর আমার মতাদর্শের কারণে। আমি অপরাধী আমার সত্তাকে জাগ্রত করার কারণে। আমি অপরাধী কারণ আমার একটা স্বতন্ত্র সত্তা রয়েছে যা আমাকে জানিয়েছে আমি কে। যা আমাকে দেখিয়েছে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা। আমাকে বলেছে প্রস্তরকালীন সময় থেকে সীমানার মাঝে পধ রোধ করা কাঁটা তারের যে দেয়াল তাকে কেন্দ্র করে সময়টা প্রদক্ষিন করছে শ্রেণি রাজত্বে। তথাকথিক সভ্যতার এই কারাগারে বৃত্তকেন্দ্রিক মূল্যবোধ হলো প্রচলিত ব্যবস্থারই পুনরাবৃত্তি। অর্থচিন্তার রূপান্তর এখানে কেবল পরাধীনতাই নয় অর্থহীনচিন্তার বহি:প্রকাশও। যেমনটা আজ আমরা অসংখ্য বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক, চিকিৎসকসহ নানা পদবীধারীদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি পত্রিকা, টেলিভিশন বা গণমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে। এখানে মূল বিষয় হলো যাদের আমরা যে সব পদবী দিয়ে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি তারা আসলে কতটুকু তা ধারণ করে থাকেন। আমরা কি একজনকে অতিথি হিসেবে নিজ প্ল্যাটফর্মে এনে বলছি যে তিনি বিশেষজ্ঞ? তাকে বিশেষজ্ঞ বা বিজ্ঞানী বলার পরিমাপটা আসলে কি? মিডিয়াতে যারা আসেন তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য একটি আন্তর্জাতিক মান আছে। একাডেমিক ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ দাবি করার ক্ষেত্রে একটি প্যারামিটার হচ্ছে ‘Peer recognition’ । সেক্ষেত্রে জার্নালে আর্টিকেল থাকতে হবে, বই থাকতে হবে এবং সেগুলো `Peer reviewed’ হতে হবে। একই রকম কাউকে হুট করে বিজ্ঞানী বলে ফেলাও যায় না, তার আবিষ্কার বা উদ্ভাবন বা গবেষণারও একটা স্বীকৃতি থাকতে হয়। মূলত আবিষ্কার এবং উদ্ভাবন শব্দ দুটোর মধ্যে পার্থক্য জানলেই বিজ্ঞানী কাকে বলতে হবে সে সম্পর্কে প্রাথমিক একটা ধারনা পাওয়া যায়। পৃথিবীর উন্নত দেশে সে দেশের সবচেয়ে বুদ্ধিমান চৌকস ও মেধাবীরা সাংবাদিকতা করে থাকে। অথচ আমাদের এই দক্ষিণ এশিয়ায় মিডিয়ার দায়িত্ব অনেক হলেও দখা যাচ্ছে, আমরা যাকে তাকে যা তা বানাচ্ছি। মিডিয়ায় কাজ করা সত্তেও, স্রোতের ধারায় গা ভাসিয়ে যে কাউকে প্রতিষ্ঠিত করার ঘোর বিরোধী হওয়াও আমার অপরাধ। কারণ আমি মনে করি, বিজ্ঞানী কিংবা গবেষক কিংবা আর যে পদবীগুলো আছে তা অর্জন করতে হয়। ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকতেই পারে, তার জন্য নিজে যা না, তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যে হীন প্রক্রিয়া তা যথেষ্ট ন্যাক্কারজনক। প্রবাদই আছে- বানরের গলায় মুক্তোর মালা মানায় না। আমি আরও অনেক কারণে অপরাধী। তার মধ্যে অন্যতম হলো আমি আমার ঈশ্বর সত্তাকে অনুসরণ করেছি। বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস এর ব্যাপার আমার কাছে কখনই আপেক্ষিক মনে হয়নি। বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের পেছনে কোনো শক্ত ভিত্তি দেখাবার প্রয়োজনও আমি বোধ করিনি। আমার কাছে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস দুটি আমার চিন্তার উপসংহার। ব্যাখ্যার না। আমি অন্ধকার দেখেছিলাম যখন মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা বুলডোজার দিয়ে শহরের তিন হাজার বছরের পুরনো প্রাচীর ও ভাস্কর্য মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। টাইগ্রিস নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই ‘নিমরুদ’ ছিলো আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী। যারা এই ভাষ্কর্য ভেঙেছে তারা দাবি করেছে এই নিদর্শনগুলো ‘প্রথা সম্মত’ নয়। তাই এগুলোকে ধ্বংস করা প্রয়োজন। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীর এই প্রাচীর ও ভাস্কর্যগুলো ছিল প্রাচীন ইরাকি সমাজ ও সংস্কৃতি তথা বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন। যুগ যুগ ধরে স্থাপত্যকলার ওপর এই বর্বর হামলা আমরা প্রতিরোধ করতে কতটুকু পেরেছি? এর আগে আফগানিস্তানেও একইরকম হামলা হয়েছে। ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে হাজার বছর পূর্বের সভ্যতার চিহ্ন। এই রকম হামলা আমাদের এই অঞ্চলেও হয়েছিলো। ঢাকার অপরাজেয় বাংলা নির্মানের ২৯ বছর পর ১৫ই অক্টবর ২০০৮, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সামনের গোলচত্বরে নির্মীয়মান লালনের ভাষ্কর্য মুফতি আমিনীর নেতৃত্বে এক দল মাদ্রাসার ছাত্র ভেঙে দেয় এবং হজ মিনার নির্মাণের দাবি তোলে এবং পরবর্তীতে সেটা নির্মাণও হয়। কিন্তু তখন তারা একধরনের ভয়ংকর ত্রাস সৃষ্টি করে। লালনের ভাষ্কর্য ভাঙার দেড় মাস পর ২৯ নভেম্বর তারা ভাঙে মতিঝিলের বলাকা ভাষ্কর্য। এছাড়া তারা হুমকি দেয় এ দেশের সমস্ত ভাষ্কর্য ভেঙে ফেলার। তারা কুষ্টিয়ায় লালনের আখরায় হামলা করে। বাউল শিল্পীদের ওপর হামলা করে। তাদের নির্যাতন করে। ঠিক সেই অন্ধকার সময়ে এই সকল হামলা প্রতিহত করতে তখন সূত্রপাত হয় বাংলার সংস্কুতি আন্দোলনের। নতুন করে শিল্প নির্মাণ করেই শিল্প ভাঙার প্রতিবাদ করা হয়। এবং সে আন্দোলনে সে সময় রক্ষা পায় এদেশের ভাষ্কর্যগুলো। আমাদের শিল্প। আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের সংস্কৃতি। কিন্তু লালনের ভাষ্কর্যটি আমরা পুনরায় তৈরি করতে কি পেরেছি? লালনের দর্শন কি আমরা আজও বুঝতে পেরেছি? যখন লালন এই মাটির। তিনি কি কেবল বাউল শিল্পি? মিডিয়া তথা সমাজ তাকে কিভাবে উপস্থাপন করে? হুমায়ুন আজাদ অনেকদিন আগে বলেছিলেন- এদেশের মুসলমান একসময় মুসলমান বাঙালি, তারপর বাঙালি মুসলমান, তারপর বাঙালি হয়েছিল। এখন আবার তারা বাঙালি থেকে বাঙালি মুসলমান, বাঙালি মুসলমান থেকে মুসলমান বাঙালি এবং মুসলমান বাঙালি থেকে মুসলমান হচ্ছে। যেমন পৌত্রের ঔরসে জন্ম নিচ্ছে পিতামহ। আফসোস, তাকেও মত প্রকাশের জন্য চাপাতির আঘাতে জীবন দিতে হয়েছে। আমার মাঝে এরকম অসংখ্য উদ্বেগ জন্ম নেয়ার জন্য আমি অপরাধী। আর উদ্বেগগুলো সমাজের অশ্লিলতম প্রহসনগুলোর কারণে। কারণ- এখনও আমদের ভাললাগা-ভালবাসার মাঝে রয়েছে প্রাচীন প্রথার দেয়াল। তবে, এত অনিশ্চয়তার মধ্যেও বিশ্বাস নামক ভয়ংকর ব্যাপার আমার মাঝে নেই বলে আমি সুখ বোধ করি। প্রেম-ভালবাসা ও প্রজ্ঞায় গুণান্বিত হয়ে আমি নিজেকে বোধ সম্পন্ন সহৃদয় ব্যক্তি মনে করি। আর এটাও আমার অপরাধ হতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here