নিউট্রন স্টার এক মহাজাগতিক বিস্ময়

0
82

ডঃ অনিন্দ্য দাস

এমনটা যদি হতো যে মাউন্ট এভারেস্টকে এক কাপ কফির মধ্যে ডুবিয়ে দিলাম। বা যদি এমনটা হতো পৃথিবীর সব মানুষকে ১ঘনসেমি জায়গায় ভরে দিলাম! অথবা ৬সেমি ব্যাস বিশিষ্ট একটা নুড়ি পাথর এতো ভারী হয়ে গেলো যে পৃথিবীর খুব শক্তিশালী ক্রেন ও সেটাকে সরাতে পারলো না! কি বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। পার্থিব জগতে এমনটা না হলেও মহাজাগতিক ভরে এমনটা হয়েই থাকে। এটা নির্ভর করবে ভরের ঘনত্বের উপর।

মহাকাশ যেমন অসীম তেমনি তাতে লুকানো রহস্যও অসীম ও অনন্ত। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোটি কোটি নক্ষত্রের একএকটির আয়তন ও ভর কিন্তু ভিন্ন হয়। আমাদের কাছের নক্ষত্র সূর্যের ভরকে ১সোলার মাস ধরলে, সূর্যের থেকে বড়ো বা ছোট ভরযুক্ত বহু নক্ষত্র আছে। সূর্যের মতো ভরের নক্ষত্র গুলি উহাদের জীবদ্দশায় নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটিয়ে শক্তি উৎপাদন করে, অর্থাৎ এক্ষেত্রে নক্ষত্রের জ্বালানি হিসেবে সন্চিত হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিনত হয় ও বিপুল পরিমান শক্তি নির্গত হয়। সূর্য থেকে নির্গত এই শক্তিই পৃথিবীতে প্রানের উৎস বলে ধরা হয়। কিন্তু নক্ষত্র সে যতো আয়তনে বড়ো হয়, তার জ্বালানি হাইড্রোজেন ততো তাড়াতাড়ি খরচ হয়। অর্থাৎ বড়ো নক্ষত্রের জীবদ্দশা সংক্ষিপ্ত হয়। জ্বালানী শেষ হবার পর নক্ষত্রের ভবিষ্যৎ কি হবে তা নির্ভর করবে উহার ভরের উপর। প্রথমেই আসা যাক সূর্যের ভবিতব্যে। যেকোনো নক্ষত্র নির্দিষ্ট আকার বা আয়তন প্রাপ্ত হয় দুটি বলের প্রভাবে। নিউক্লিয়ার ফিউশনের ফলে তৈরী হয় বহির্মুখী বল আর নক্ষত্রের ভিতর কাজ করে অন্তর্মুখী অভিকর্ষ বল। এই দুই বলের সাম্য উহার নির্দিষ্ট আকার ও আকৃতি নির্ধারন করে। নক্ষত্রের ভিতর হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম, হিলিয়াম থেকে কার্বন তৈরী হয়। এভাবে ক্রমাগত উহার কেন্দ্রে কার্বনের সন্চয় বাড়তে থাকে ও জ্বালানী কমতে থাকে। ফলে নিউক্লিয়ার ফিউশান কমে যায়, এবং বহির্মুখী বলের প্রভাবে উহার আয়তন বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে বিকিরিত আলোকরশ্মি লাল তরঙ্গদৈর্ঘের হয় বলে নক্ষত্রটি লাল বর্নের হয়ে যায়। নক্ষত্রের এই মরনাপন্ন দশাকেই রেড জায়ান্ট বলে। এসময় সূর্যের বহির্ভাগের বস্তু মহাকাশে ছড়িয়ে পড়বে ফলে সুন্দর প্ল্যানেটরি নেবুলা দেখা যাবে। তবে সেটা পৃথিবীর মানুষের দেখার সৌভাগ্য হবে না। কারন সূর্য্য তখন এতো বড়ো হয়ে যাবে যে পৃথিবী এমনকি মঙ্গলও পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আশার কথা এটাই যে তখন সূর্য্যের অভিকর্ষ বল দুর্বল হয়ে যাওয়ায় গ্রহগুলি কিছুটা দূরে সরে যাবে। হয়তো সেকারনে ইউরোপা বা অনুরূপ কোনো অধুনা বরফাবৃত উপগ্রহে প্রানের সন্চার ঘটবে। কয়েক লক্ষ বছর রেড জায়েন্ট দশা অতিবাহিত করে সূর্য্যের সংকোচন ঘটবে ও হোয়াইট ডোয়ার্ফ দশা প্রাপ্ত হবে। কয়েক বিলিয়ন বছর পর উহা শীতল ব্ল্যাক ডোয়ার্ফে পরিনত হয়ে মহাশূন্যে থেকে যাবে। তবে সূর্য্যের হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা রেড জায়েন্টে পরিনত হবার পথে বাধা হতে পারে আর এক বিরলতম মহাজাগতিক ঘটনা, গ্যালাক্টিক কলিশন। হ্যা, আমাদের নিকটবর্তী একটি গ্যালাক্সী অ্যান্ড্রোমেডা ঘন্টায় ৪০০০০০কিমি বেগে ছুটে আসছে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সীর দিকে। উহাদের পরস্পর সংঘর্ষ অনিবার্য। এর ফলে অনেক হিসেব নিকেষ বদলে গিয়ে যে ইলেক্ট্রিক্যাল গ্যালাক্সী তৈরী হবে তার নামকরন বিজ্ঞানীরা করেছেন মিল্কিমেডা।

প্রসঙ্গান্তরে যাবার আগে আর একটি মহাজাগতিক ঘটনার কথা না বললেই নয়। ২০২২সালের পর কোনো একদিন রাতের আকাশে তাকিয়ে আছেন, হঠাৎ করে আপনার চোখের সামনে আতশবাজির মতো আলোর ঝলকানি স্থির হয়ে যেতে পারে। অমাবস্যার আকাশ রঙ্গীন জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে যেতে পারে। পূর্নিমার আকাশে চাঁদের আলোও যার কাছে ম্লান হয়ে যাবে। দিনের বেলা মেঘমুক্ত আকাশেও সে আলোর দ্যুতি দেখা যাবে। হ্যা সুপারনোভার কথা বলছি। প্রায় ৬০০আলোকবর্ষ দূরে বেটলজিউস নক্ষত্রের মৃত্যু আমরা প্রত্যক্ষ করবো। ৬০০বছর পূর্বেই তার মৃত্যু ঘটেছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারনা। কিন্তু সেই আলো পৃথিবীতে এসে পৌছতে ৬০০বছর লেগে যাবে এবং হয়তো আমরাই সেই বিরল ঘটনার সাক্ষি থাকবো। এর আগে ১৬০৪খ্রী এমন ঘটনা তৎকালীন পৃথিবীর মানুষ অবাক নয়নে প্রত্যক্ষ করেছিলো। সর্বোপরি সূর্যের কাছাকাছি কোনো কল্পনাতীত বড়ো নক্ষত্রের সুপারনোভায় সৃষ্ট মৌলগুলিই গ্রহ উপগ্রহ প্রানী উদ্ভিদ দেহে পাওয়া যায়।

এখন কথা হলো কোনো নক্ষত্রের সুপারনোভা কখন ও কেনো হয়? সাধারনত কোনো হোয়াইট ডোয়ার্ফ সূর্যের ভরের 1.44 বা তার বেশী ভরযুক্ত হলে উহার হাইড্রোজেন জ্বালানী শেষ হলে টাইপ১ সুপারনোভা ঘটে। আর একটি হোয়াইট ডোয়ার্ফ সন্নিহিত কোনো নক্ষত্রের জ্বালানি চুরি করলে টাইপ২ সুপারনোভা হয়।

সূর্যের ভরের 8-10গুন ভরের নক্ষত্রের মৃত্যু হলে উহা নিউট্রন স্টারে পরিনত হয়। উচ্চঘনত্বের নক্ষত্রের জীবদ্দশায় H>He>C>Ne>O>Si>Fe পরিবর্তনের মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন হয়। উহার কেন্দ্রে আয়রন এর সন্চয় যতো বাড়তে থাকে কেন্দ্রে নিউক্লিয়ার ফিউশন কমতে থাকে ও একসময় বন্ধ হয়ে যায়। তখন প্রবল মহাকর্ষীয় বলের ক্রিয়ায় টাইপ১ সুপারনোভা বিস্ফোরন ঘটায় ও সমগ্র ভর কেন্দ্র অভিমূখে চালিত হয়। এই সংকুচিত ভর সর্বাধিক ২৫কিমি ব্যাস বিশিষ্ট হয় এবং পরমানুর ইলেক্ট্রন ও প্রোটন একত্রে নিউট্রনে পরিনত হয়। এই উচ্চ ঘনত্বের নক্ষত্রের দেহাবশেষ কেবলমাত্র ঘনীভূত নিউট্রন দ্বারা গঠিত হয় বলে একে নিউট্রন স্টার বলে। এর মহাকর্ষ বল এতোই প্রবল হয় যে পৃথিবীতে কোনো ব্যক্তির ওজন ৫০কেজি হলে নিউট্রন স্টারে উহার ওজন ১০০০০বিলিয়ন কেজি হবে। Law of conservation of angular momentum অনুযায়ী নিউট্রন স্টার গুলির প্রবল ঘূর্নন গতি দেখা যায়। এখনো পর্যবেক্ষন করা নিউট্রন স্টারের সর্বাধিক ঘূর্ননগতি 716 rotation per sec। এধরনের প্রবল ঘূর্নন গতির জন্য নিউট্রন স্টার বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় বিকিরন ঘটাতে পারে। এমনকি উহা তীব্র চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরী করে। বিকিরন সৃষ্টিকারী নিউট্রন স্টারকে রেডিও পালসার ও উচ্চ তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র যুক্ত নিউট্রন স্টারকে ম্যাগনেটর বলে। J0952=0607 নামক রেডিও পালসার নক্ষত্রের প্রতি সেকেন্ডে 707বার ঘূর্নন গতি দেখা যায়। 8.5বছরে নক্ষত্রটি থেকে 220বার গামা রে বিকিরন ধরা পড়েছে। নিকটবর্তী কোনো রেডিও পালসার থেকে নির্গত গামা রে এর একটি পাল্স দুর্ভাগ্য বশতঃ পৃথিবীর দিকে আসলে একমূহূর্তে সমস্ত জীবজগত চিরনিদ্রায় যেতে পারে। অপরদিকে নিকটবর্তী কোনো ম্যাগনেটর কয়েক আলোকবর্ষ দূর থেকে আমাদের রক্তের সকল লৌহপর্যন্ত শোষন করে নিতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here