নির্মলকুমার সাহা
অলিম্পিক হকিতে অবিভক্ত ভারতের শেষ সোনা জয় ১৯৩৬ সালে বার্লিনে। ফাইনালে হিটলারের সামনে তাঁরই দেশ জার্মানিকে ৮-১ গোলে চূর্ণ করে সোনা জিতেছিল হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদের ভারত। সোনাজয়ী ওই দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন আলি ইকতিদার শাহ দারা। তবে তিনি খেলেছিলেন মাত্র দু’টি ম্যাচ। সেমিফাইনাল ও ফাইনাল। শুধু তাই নয়। দেশ ভাগের পর প্রথম অলিম্পিক হয় ১৯৪৮ সালে লন্ডনে। স্বাভাবিকভাবেই সেই অলিম্পিকে ভারত ও পাকিস্তান আলাদা দেশ হিসেবে অংশ নেয়। লন্ডনে নতুন দেশ পাকিস্তানের অধিনায়ক ছিলেন আলি ইকতিদার শাহ দারা-ই। ৭ ম্যাচে তাঁর গোল ছিল ৯।
বার্লিনে দারা কেন খেলেছিলেন মাত্র দু’টি ম্যাচ? আসলে কর্মস্থল সেনাবাহিনী থেকে ছুটি মেলেনি। তাই বার্লিন অলিম্পিকের ভারতীয় দলেই ছিলেন না দারা। রাখা হয়েছিল স্ট্যান্ড বাই হিসেবে। স্ট্যান্ড বাই রাখার পেছনে নির্বাচকদের যুক্তি ছিল যদি পরে প্রয়োজনে সেনা কর্তৃপক্ষকে রাজি করানো যায়। দলে দারাকে না পাওয়ায় অধিনায়ক ধ্যানচাঁদও ব্যথিত হয়েছিলেন। যাই হোক, জার্মানিতে পৌঁছে অলিম্পিকের আগে ৯টি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছিল ভারত। যা শুরু হয়েছিল ১-৪ গোলে হার দিয়ে। প্রতিপক্ষ ছিল জার্মান আন্তর্জাতিক একাদশ। প্রথম প্রস্তুতি ম্যাচে হারের পরই নড়েচড়ে বসতে হয়েছিল টিম ম্যানেজমেন্টকে। সেই রাতেই অলিম্পিক ভিলেজ থেকে ভারতের সহকারি ম্যানেজার পঙ্কজ গুপ্ত চলে গিয়েছিলেন বার্লিন শহরে। সেখান থেকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন ভারতীয় হকি ফেডারেশনের সভাপতি জগদীশ প্রসাদকে। অনুরোধ ছিল, যে করেই হোক দারাকে বার্লিনে পাঠানো হোক। শেষ পর্যন্ত সেনা কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেওয়ায় দারা বার্লিন যেতে পেরেছিলেন। অবশ্য অনেক দেরিতে। গ্রুপ লিগের খেলা যেদিন শেষ হয়, সেই সন্ধ্যায় (১০ আগস্ট) দারা বার্লিন পৌঁছন। ১২ আগস্ট ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে দারা প্রথম খেলতে নামেন। ভারত জিতেছিল ১০-০ গোলে। দারার গোল ছিল দু’টি।
একদিন বিশ্রামের পর ১৪ আগস্ট ছিল ফাইনাল। প্রতিপক্ষ জার্মানি। কিন্তু প্রবল বৃষ্টিতে সেদিন ফাইনাল শুরুই হতে পারেনি। খেলা হয়েছিল একদিন পর ১৫ আগস্ট সকালে। হিটলারের সামনে জার্মানিকে ৮-১ গোলে হারিয়েছিল ভারত। কাকতালীয় হলেও এটাই সত্যি, ১১ বছর পর ১৯৪৭ সালে ওই দিনই ভারত পেয়েছিল স্বাধীনতা।
দেশ ভাগের পর ফৈজলাবাদের ছেলে এ আই এস দারা থেকে গিয়েছিলেন পাকিস্তানেই। উদ্যোগী হয়েছিলেন পাকিস্তানের হকির উন্নতি ঘটাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারত ভাগের পর প্রথম অলিম্পিকের আসর বসে লন্ডনে। নতুন দেশ পাকিস্তান ওই অলিম্পিকে হকি দল পাঠাবে কিনা, তা নিয়েও দ্বিধা ছিল অনেকের। কিন্তু প্রায় একার উদ্যোগে সরকারকে রাজি করিয়ে দল নিয়ে গিয়েছিলেন লন্ডনে। বার্লিন অলিম্পিকে খেলা কোনও খেলোয়াড়ই লন্ডনে ভারতীয় দলে ছিলেন না। কিন্তু পাকিস্তান দলে ছিলেন দারা। ভারত ও পাকিস্তান, দুই দেশের হয়েই অলিম্পিকে খেলা প্রথম খেলোয়াড় তিনিই। লন্ডনে দারা ছিলেন পাকিস্তানের অধিনায়ক। পরে অলিম্পিকে পাকিস্তানের কোচ ও ম্যানেজার হয়েছেন একাধিকবার। ধ্যানচাঁদ নিজের সময়ের সেরা ভারতীয় একাদশ গড়তে গিয়েও তাতে রাইট ইনে রেখেছিলেন দারাকে।
খেলা ছাড়ার পর পাকিস্তানের হকির উন্নতির জন্য আজীবন চেষ্টা চালিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের নানা পদে থাকার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক হকি সংস্থার সহ-সভাপতিও হয়েছিলেন। বার্লিন ও লন্ডন অলিম্পিকের মাঝের সময়ে চাকরি সূত্রেই কর্নেল এ আই এস দারাকে অংশ নিতে হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও।
ভারত-পাকিস্তান সুসম্পর্ক তৈরি হতে পারে খেলার মাধ্যমেই। এখন নানা মহলে এই ধারণা গুরুত্ব পাচ্ছে। এটা প্রায় অর্ধ-শতাব্দী আগেই উপলব্ধি করেছিলেন দারা। ১৯৭১-এর যুদ্ধের পর ভারত-পাকিস্তান হকি টেষ্ট শুরুর উদ্যোগ তিনিই প্রথম নিয়েছিলেন। এশিয়ান অল স্টারস দল গড়ে নানা জায়গায় ম্যাচ খেলার উদ্যোগও ছিল তাঁরই। ১৯৭৪ সালে এশিয়ান অল স্টারস দল ভারতের নানা শহরে ম্যাচ খেলেছিল। দিল্লিতে ম্যাচের আগে পুরনো বন্ধু ধ্যানচাঁদকে ঝাঁসির বাড়ি থেকে ডেকে এনেছিলেন দারা। দিল্লিতে এশিয়ান অল স্টারস দল গিয়েছিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে। দারা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ধ্যানচাঁদকেও। দু’জনে মিলে ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেছিলেন, দু’দেশের সফর বিনিময়ের ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে। অবশেষে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে হকির সফর বিনিময় বা টেস্ট সিরিজ শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সালে।
পাকিস্তানের হকির প্রাণপুরুষকে আজ জন্মদিনে প্রণাম।
জন্ম: ১ এপ্রিল ১৯১৫
মৃত্যু: ১৬ জানুয়ারি ১৯৮১