বিপ্রনাথ মজুমদার
ক্যাসেল রক। নামেই যেন পাথুরে দুর্গের হাতছানি। ল্যাটেরাইট – লালের রুক্ষতা আছড়ায় স্টেশনের হলুদ কালো নাম ফলকে। পর্তুগীজ ঘরানার হারিয়ে যাওয়া মুর্ছনা আর ধূসর ইতিহাস পেছলাতে থাকে অলস রেল লাইনে শুঁয়োপোকার মত আটকে থাকা
অমরাবতী এক্সপ্রেসের বগিগুলোর গা ছুঁয়ে। দু রাত্রি কাটানো ট্রেনের যাত্রীদের অলস শরীরের মতই একঘেয়ে বগির চলনেও যেন কিছুটা গতিমন্থরতা । অলস শরীর ঋজু হয় কিছুটা আলসেমি কাটাতে আর বাকিটা ট্রেনের জানালার বাইরে বদলে যাওয়া প্রকৃতির সৌন্দর্যের হাতছানিতে। জংলা জমিতে কিছুটা লালচে আভাস মনে করিয়ে দেয় রাঙামাটির বীরভুমকে। পশ্চিম উপকূলের চিরহরিৎ অরণ্যের ধুলোপড়া সবুজের সাথে রুক্ষ গ্রানাইট আর ব্যাসাল্টের যুগলবন্দি কারোয়ারের প্রান্তিক স্টেশন ক্যাসেল রককে সবে মোহময়ী করে তুলছে। ঘন্টা আর মিনিটের কাঁটার সহবস্থান বোঝায় সময় এখন ঠিক দুপুর বারোটা । ইঞ্জিনের পেল্লায় মাথা যেন তখন কর্নাটকের শেষ স্টেশনকে পিছনে ফেলে,’এ পারফেক্ট হলিডে ডেস্টিনেশন’-এর মোড়কে থাকা গোয়া টুরিসমের ক্যাচলাইনকে যথাযথ মর্যাদা আর যাত্রীদের স্বস্তি দেবার জন্য গোয়ার কোলেমে ঢুকে পরার জন্য ব্যাস্ত। আর ঠিক তখনই জানলার ধারের আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম অমরাবতী এক্সপ্রেসের হাটখোলা দরজার সামনে। ডিসেম্বেরের শেষ হলেও পেরিয়ে এসেছি অসহ্য গরমের ঘেরাটোপে থাকা ওড়িশা,অন্ধ্রপ্রদেশ আর কর্ণাটকের লেজটুকুকে। কর্ণাটকের প্রান্তিক স্টেশনকে ছাড়ালেই আমরা ঢুকে পড়ব গোয়ার চৌহদ্দিতে। আকরিক সমৃদ্ধ লোহা মাটির টরে টক্কা যেন সেই সংকেত পাঠিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির হাত ছুঁয়ে আর ওই চলমান ইষ্টম্যান কালারের খেল দেখতে দেখতেই চোখে পড়ল দুধসাদা এক সুন্দরীর শিফন পতন। ঘন অন্ধকারের পেটের ভিতর এক সুরঙ্গ থেকে বের হতেই আলোর সাথে চোখের দোস্তি হবার অনতিকাল পরেই নজর গিয়ে বিঁধলো এক জলপ্রপাতের দুধসাদা দেওয়ালে। যেন স্লো মোশানে ঘটে চলা এক মোহময়ী প্রপাতের অভিসার চলন। নিশ্চিন্তে কিন্তু আলগোছে। আগুয়ান ট্রেন এঁকে বেঁকে চলে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার শরীর পেঁচিয়ে, স্বপ্নের মত এক দৃশ্যর মায়াজালের মধ্যে দিয়ে আর ঘর কাটার আগেই হাত নাগালের মধ্যে ধরা দেয় এক দুর্ধর্ষ জলপ্রপাত দুধসাগর। জলকনার মিহি টুকরো অনুতে অনুতে ভেঙ্গে মুখমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে নিয়ে আসে অভ্যর্থনার মিহি চিঠি। হাত নাগালের মধ্যে , চলমান ট্রেনে প্রকৃতি বোধহয় একমাত্র এখানেই ধরা দিয়ে পিছলে চলে যায় গীত আর কালের চিরায়ত নিয়মকে সত্যি করে । ‘ওয়েলকাম টু গোয়া’র রঙীন বিজ্ঞাপন তখন এক টুকরো ‘অতুল্য ভারত-এর হাত ধরাধরি করে চলে আর সুউচ্চ পশ্চিমঘাট পাহাড়ের উপর থেকে ধাপে ধাপে নেমে আসা উজ্জ্বল দুধসাদা জলধারা তার রুপবদল করে বাঁকা চাঁদের মত রেল পথের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই। কখনও সে বাঁয়ে আবার কখনও তা ডায়ে । তার সাথে পাল্লা দিয়ে হুল্লোড় ওঠে ট্রেনের এ বগি,সে বগিতে। গুঞ্জন আর উল্লাসের নানান শব্দে জারিত মন বলে প্রকৃত অর্থেই এই বেড়ানো যেন এক ‘প্লেজারট্রিপ’,যার সূচনা হল এই অসাধরন দৃশ্যপটের পটভূমিকাতে। বুঝতে পারি আগামী কয়েকদিন ভ্রমণ নেশারু হবে শুধুমাত্র কাজু ফেণীতে নয়, দেশী বিদেশী পর্যটকদের হুল্লোড়ে ,রঙীন বারমুডা, বিকিনি আর বীচ শর্টসে, রোমাঞ্চকর ওয়াটার স্পোর্টস, বাইকিং আর প্যারাসেলিং এর ছন্দে, আরবসাগরের সাদা বালির বীচে নীল জলের মাদকতায়, গোয়ানীজ স্পাইস কারির ঝাঁঝালো গন্ধে, ডাব নারকেল আর ডেকচেয়ারের পিছনে পুঁতে রাখা রঙীন ছাতার বর্ণালী-বিচ্ছুরণে।সেক্ষেত্রে গোয়াতে ঢোকার আগেই দুধসাগর জলপ্রপাতের এই ছোট্ট ট্রেলর একে বারে টুরিস্ট-ফ্রেন্ডলি, তা সে অমরাবতীর দু রাতের ট্রেন জার্নি যতই ধকলের হোক না কেন। আর তাই ট্রেনে বসেই ঠিক হয়ে গেল বর্ষশেষের রঙ্গীন গোয়াকে দেখে নেবার ফাঁকে অবশ্যই অমাদের ভ্রমন তালিকায় থাকবে দুধসাগর জলপ্রপাত, আরও কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখার জন্য।
বছরের শেষ আর নতুন বছরের প্রাক মুহুর্তে গোয়া শহরে যে এক আশ্চর্য মাদকতা আর উৎসবের বাতাবরণ তৈরী হয় তা গোয়া শহরের মারগাও এ পা দেওয়া মাত্রই বুঝতে পারলাম। আর তা আরও পরিস্কার হয়ে উঠল দক্ষিনের এক প্রান্ত শহর ভারকাতে যাবার পথে পথেই। পর্তুগীজ ঘরানার বাড়ি ঘর,ছোট বড় রেস্তোরা,প্রতিটি দোকান,চার্চ আর রাস্তাগুলি রঙ্গীন তারা,হরেক আলো আর ক্রিসমাস ট্রি তে সেজে উঠেছে। বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরামের শক্তিশালী বাণের আঘাতে সাগরের জল সরে গিয়ে গোমন্তক বা অধুনা গোয়া রাজ্যের প্রতিষ্টা হবার পুরানো গল্প যতই চালু থাকনা কেন একথা সত্যি যে,আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগে সহ্যাদ্রি পর্বতের পায়ের তলায় আরব সাগরের তীরে যে দিনটিতে মাত্র কুড়িটি যুদ্ধ জাহাজ আর বারশ সৈন্য নিয়ে আলফানসো ডি আলুবকার্ক যুদ্ধে আদিলশাহীকে পরাজিত করে এ শহরের দখল নেন,সেদিন থেকে গোয়ার ইতিহাসের অভিঘাত পর্তুগীজ উপনিবেশের আঙ্গিকে লেখা হয়ে যায়। তাই আজও আশ্চর্য করার মত তথ্য এই যে,ভারতবর্ষের একমাত্র শহর গোয়া যেখানে পাঁচ পাঁচটি ভাষায় কথোপকথন চলে এবং তা ইংরাজি,কোঙ্কনি,হিন্দি,মারাঠি ছাড়াও অন্যটি হল পর্তুগীজ। অবাক করার মত ঘটনা এটাও যে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত গোয়ার সরকারী ভাষা হিসাবে পর্তুগীজ ভাষাই স্বীকৃত ছিল। সুতরাং আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর অবস্থানগত বাণিজ্যের সুযোগসুবিধার জন্য পর্তুগীজ,ডাচ্,ফ্রেঞ্চ এবং ব্রিটিশরা যে গোয়ার আকৃষ্ট হয়েছিল তা নয়,প্রলুব্ধ করেছিল এখানকার বিখ্যাত মশলার অসাধারণ ভান্ডারের হাতছানি,যা আজ এতকাল পরেও গোয়ার রেস্তোরা গুলিতে চিকেন কারি,মটন ভিন্ডালু,রিকার্ডো,রিভা ফ্রায়েড ফিশ ,চিকেন জাকুটির মত খাবারে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বকে মাত করে রেখেছে।তাই গোয়া মানে শুধু নীল আকাশ,সাদাবালি,স্থাপত্যশৈলীতে অনন্য সব গির্জা,কাজু-ফেণী ,ক্র্যাব কারী আর স্বল্পবাস বিদেশিনীেদের মুক্তাঞ্চলের নীল হাতছানি নয়,গোয়া মানেই আনেক ইতিহাস,অজানা তথ্য আর তার সাথে জুড়ে থাকা ‘এ পারফেক্ট হলিডে ডেষ্টিনেশন’-এর
ক্যাচলাইনের সহবস্থান। এই গোয়া শহরে পর্তুগীজদের হাত ধরেই আসে প্রথম ছাপাখানা যা ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম। এবং এশিয়াতেও। ভারতবর্ষের প্রথম মেডিকাল স্কুল আর ইংরাজি মাধ্যমের স্কুল ও তৈরী হয় গোয়াশহরে। আয়তনের নিরিখে ভারতবর্ষের সব থেকে ক্ষুদ্রতম রাজ্য গোয়াতে জাতীয় সড়ক মাত্র পঁচাত্তর মাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও ভারতবর্ষের ধনীতম রাজ্যের শিরোপা একমাত্র কিন্তু এ শহরের মাথাতেই। দেশী আর অসংখ্য বিদেশী পর্যটকদের নিয়ে স্থানীয় মানুষদের শান্তিপূর্ণ সহবস্থান আর শৃঙ্খলই আজ এই রাজ্যটিকে এহেন স্থানে নিয়ে গেছে। প্রচুর পর্যটক নির্ভাবনায় ঘুরে বেড়ান গোয়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে শুধুমাত্র ‘পাইলট’কে সঙ্গী করে। পাইলট হল এখানকার সুপরিচিত দুচাকার ট্যাক্সি যা সাধারণভাবে মোটরসাইকেল! ড্রাইভার নিশ্চিন্তভাবে গোয়ার আনাচে কানাচে ঘুরিয়ে দেবে অত্যন্ত দ্রুততায়। পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা শহরের মুকুটে এও এক রঙ্গীন পালক বৈকী।
আমরাও গোয়া শহরের আনাচে কানাচে বেড়িয়ে পরিচিত হলাম অসাধারণ কিছু সমুদ্র সৈকত, ঐতিহ্যবাহী চার্চ গোয়ানীজ সংস্কৃতি, নাইট লাইফ, ক্যাসিনো, দুর্গ আর হরেক বিদেশী পর্যটকদের জীবনযাত্রার রঙ্গীন কোলাজের সঙ্গে। আমাদের সমস্ত কিছুর সঙ্গে পরিচয় আর তথ্য দিয়ে সাহায্য করছিল আমাদেরই গাড়ীর অত্যন্ত শিক্ষিত এবং মার্জিত ড্রাইভার ববি। চলমান গাড়ীতেই দেখেনিচ্ছিলাম লাল টালির ছাদের ছোট্ট বাংলো, বাঁক খাওয়া খোয়া পাথরের রাস্তা, অজস্র নারকেল গাছ, পর্তুগীজ ঘরনার আবেশ মাখা রোমান ক্যাথলিক চার্চ আর ঝুলবারান্দার নীচে থমকে থাকা নিশ্চিন্ত জীবনচর্চা। সোনালী রোদ মাখা ভারকা, বেনোলিম, কোলভা, মিরমার, কালাঙ্গুট, বাগা, আঞ্জুনার সৌন্দর্য যেমন উপভোগ করলাম, পড়ন্ত সূর্যের আভায় দেখেনিলাম কাভোলোসিম,আগোন্ডা আর কানাগুইনিমের অতুলনীয় সৈকত। কাবোদে-রামার দুর্গের উপর থেকে হাজার নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যাস্তের দৃশ্য যেন টিপিকাল গোয়ার ক্যালেন্ডার ফ্রেম। এ বীচে, সে বীচে ছড়িয়ে থাকা নানা দৃশ্যর রঙ্গিনে কোলাজ যেন প্রতিটি বীচকে এক হতে না দিয়ে স্বতন্ত্রতা দিয়ে আলাদা করে রেখে দেয়। কোথাও স্থানীয় যুবকেরা পয়ষার বিনিময়ে বিদেশীনির ইমপোর্টেড ত্বকে এঁকে দিচ্ছে উজ্জ্বল ট্যাটু, তো কোথাও হয়ত চরম উল্লাসে চলছে দুঃসাহসী জলকোল, কোথাও সুন্দরী বিদেশী যুগলের স্বল্পবসন ভাব জমাচ্ছে সোনালী বালির সঙ্গে, তো কোথাও নারকেল গাছ আর ডেকচেয়ারের ফাঁকে নির্জনতাকে সঙ্গী করে থমকে আছে শান্ত সৈকত। এরকমই বেশ কয়েকটি সমুদ্র সৈকত দেখে ফেলার পর আরবসাগরের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে সুন্দর এক সকালে বেড়িয়ে পড়লাম দুধসাগর জলপ্রপাতের দিকে। কারণ ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ এই জলপ্রপাত শুরুর দিন থেকেই মোহিত করেছিল আমাদের।
বহুদিন আগের কথা, এই সহ্যাদ্রি পাহাড়ের কোলে ছিল গজদন্তে তৈরী এক দুধসাদা রাজপ্রাসাদ। সে প্রাসাদে থেকেই রাজা পরিচালনা করতেন তার রাজকার্য। আর এই রাজ প্রাসাদেরই এক হাভেলিতে থাকতেন রাজার কন্যা। আনিন্দ্যসুন্দর এই রাজকুমারী অবাধে বিচরণ করতেন পাহাড় ঘেরা এই প্রাসাদের আনাচে কানাচে, জঙ্গল আর হ্রদে। সখীদের নিয়ে উড়ে বেড়াতেন পাখী আর প্রজাপতিদের মাঝখানে। পাহাড়ের মধ্যে থাকা এক নীল হ্রদে প্রতিদিনই রাজিকুমারী তার সখীদের পরিবৃত হয়ে করতেন অবাধ জলক্রীড়া। বাধাহীন ভাবে। সঙ্গে থাকত তার বিশাল এক স্বর্ণপাত্রে ভরা সফেদ ফেনিল দুধ আর মধু। স্নানপর্বের ঠিক আগে সেই মধু মাখা দুধে চুমুক দিয়ে রাজকুমারী তৈরী হতেন তার জলকেলির জন্য। কিন্তু কোন একদিন ঘটল ছন্দপতন। স্নানের ঠিক আগে, অনুভবে তিনি বুঝলেন কোন এক রাজকুমার গাছের ফাঁক দিয়ে তার দৈহিক রুপ সুধা পান করছে। লজ্জায় রাঙা হলেন রাজকুমারী, তুলে নিলেন মধু মিশ্রিত দুধের স্বর্ণপাত্র। লজ্জা নিবারণ করতে রাজকুমারী দুধের পাত্র উপুড় করলেন তার সর্বাঙ্গে। দুধের ধারা নেমে এলো তার আনিন্দ্যসুন্দর দেহগাত্রের প্রতিটি কোল বেয়ে। তৈরী হল এক আবরণ, নিবারিত হল তার লজ্জা। আর সেই ফাঁকে রাজকুমারীর সখীরা তার কোমল তনু ঢেকে দিল রেশমী কাপড়ের আড়ালে। পাহাড়ের আনাচে কানাচে গড়িয়ে পড়া সাদা দুধের ধারাতে তৈরী হল এক দুধসাদা প্রপাত। বরফের মত ঠান্ডা যার জল আর মেঘের মত সাদা তার বর্ণ। নেমে এল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। আর সেই দুধ সাদা জলপ্রপাতই আজকের দুধসাগর । অদ্ভুত এই লোককথা শুনতে শুনতে আমরা পৌঁছেগেলাম গোয়ার ভিতর লুকিয়ে থাকা এক সৌন্দর্য্যর দোর গোড়াতে। মহাবীর স্যাংচুয়ারীর গেটে পৌঁচ্ছে বুঝতে পারলাম এখান থেকেই নিতে হবে জলপ্রপাত দেখার টিকিট, ক্যামেরার ভাড়া, বাধ্যতামূলক লাইফ জ্যাকেট আর ভিতরে থাকার সাফারী-জীপ। পাথুরে লাল ধুলোর পথ ধরে আমরাও ঢুকে পড়লাম মহাবীর স্যাংচুয়ারী গেটে। প্রায় ঘন্টাখানেক জঙ্গল ঘেরা পথের মধ্যে দিয়ে যাবার পর নামতে হল এমন জায়গায়, যার পর আর গাড়ী যাবেনা। প্রচুর লোকজন হেঁটে চলেছে দুধসাগরের পথে।। আমরাও সে পথেই গা ভাসালাম। কাঠের এক মৃত প্রায় সেতুর উপর দিয়ে কিছুদূর হাঁটার পর জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে নজরে এলো দুধের মত জলধারা একাধিক শাখায় ভাগ হয়ে নেমে আসছে পাহাড়ের গা বেয়ে। বুঝলাম হাতের ছোঁয়ার নাগালের মধ্যেই এসেগেছে দুধসাগর। প্রপাতের কাছে যাবার জন্য পাথর বেয়ে পাকদন্ডী পথের রাস্তা বেছে নিতেই হঠাৎ চোখের সামনে খুলে গেল ধরা দিল শ্বেতবসনা জল সুন্দরী, গোয়ার সব থেকে বড় নদী মান্ডাভী থেকে তৈরী হওয়া এই জলপ্রপাত উজ্জ্বল নারীর মতই চারটি ধাপে ভেঙ্গে একদম আমাদের পায়ের নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তার শুভ্র ফেনিল জলভান্ডার নিয়ে। গোয়া-কর্ণাটকের সীমান্তের এই সুউচ্চ জলধারা উচ্চতার অংকে আর নীরস পরিসংখ্যানের নিরিখে ১০১৭ ফুট দীর্ঘ হলেও, নয়নাভিরাম মাদকতা আর রোমাঞ্চকর সৌন্দর্যে আমাদের উচ্ছাসকে তার থেকেও বেশী উচ্চতায় নিয়ে গেল। প্রচুর বিদেশী পর্যটক লাইফ জ্যাকেট পড়ে মেতে উঠেছে প্রপাতের নীচে তৈরি হওয়া নীল-সবুজ জলকুন্ডে । সূর্যের পরন্ত রস্মি ভেঙ্গে টুকরো হচ্ছে বাধাহীন উচ্ছ্বাসের কে বোহোমিয়ানায়, নীল জলের তুফানে তখন হুল্লোরের হাজার পশরা। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বুকে দুধসাগরের এই আসাধারন দৃশ্যের ফ্রেমিং অবশ্যই শাটার ফ্রেন্ডলি। তাই ছবি ওঠে বিস্তর। আমাদের মনেও তখন ‘চেন্নাই এক্সপ্রেসের’ গতি , যে ফিল্মের শুটিং ; স্পটও এই প্রপাত । তাই আমরাও পোষাক বদল করে লাইফ জ্যাকেট এঁটে নেমে পড়লাম বরফগোলা জলের সাগরে। আর লেকের জলাশয় থেকেই চোখে পড়ল পাহাড় কেটে তৈরি হওয়া রেললাইনের ওপরে দুধসাগর জলপ্রপাতের মাঝখান দিয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে চলছে এক মালগাড়ি। অসাধারন দৃশ্য যেন মুহুর্তে বাড়িয়ে দেয় নাড়ীর গতি। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে উঠে এলাম পাথরের পারে।পাথরের আড়ালেই পোষাক বদল। অসাধারন অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে এবার ফেরার পালা।
কিন্তু ফিরব বললেই ফেরা হয়না। জলের গানের শব্দ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকলেও মন পড়ে থাকে সূর্যের আঁচে গরম হওয়া কবোষ্ণ পাথরের কোলে, পাহাড়ী পথে নেমে আসা কোন রাজকুমারীর লাল- লজ্জার মত নেমে আসা শীতল জলের ধারাপাতে, মায়াপৃথিবীতে গাছের ডালে বসে থাকা কোন অচেনা পাখির কলতানে , সামিয়ানা- নীল আকাশের লেখা নতুন কোন লোক গল্পে আর অহরহ আসা পর্যটকদের অসংখ্য পায়ের ছাপের আলাপনতে। নিস্তব্ধ জঙ্গলের লাল ধুলো ওঠা পথকে তাই পেছনে ফেলে গেলেও , মন পড়ে থাকে লোকগাথাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা এক দুধসাদা প্রপাতের আনাচ কানাচ আর তার থেকে ঠিকরে ওঠা শত সহস্র জলকনার মত খুশীর রঙ্গীন বাহারি বুদ্ধুদ মনে ভেসে বেড়ায় হরেকখুশীর পশরা নিয়ে।
চমত্কার লেখা । তথ্য ও সাহিত্যের সুন্দর মেলবন্ধন ।