এক মৃত নগরীর রূপকথা

1
181

বিপ্রনাথ মজুমদার

অতীত ইতিহাসের ধূসর পরতে আচ্ছন্ন এক হীন- রোশনাই স্তব্ধ শহর। শহর না বলে একে শব-শহর বললেই যথাযথ বলা হয়। চকমিলান দোমহলা মঞ্জিল,নাছদুয়ারের সংলগ্ন হাভেলি  আর দৌলতআনার নিভু নিভু ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে থমকে রয়েছে এক আস্ত নগর। মাথার ওপর খররোদ নিয়ে জেগে থাকা আশমানীর রং আকাশও যেন এই শহরকে আধুনিকতার ফ্লুওরোসেন্ট রঙে রাঙ্গাতে পারেনি। রঙের হুল্লোরের পরিবর্তে এই নগরীর অবয়বে জড়িয়ে থাকে আতীত ইতিহাসের রুখা জরদা-তসর। তাই বাস্তবের বর্তমানে দাঁড়িয়ে থাকলেও আতীত গাঁথাই যেন এই নগরীর ভবিতব্য। নগরীর নাম-পানাম। ১নম্বর জাতীয় সড়ক,বাংলাদেশ ধরে ঘন্টা খানেকের রাস্তা। বাংলাদেশের ঢাকা শহর থেকে মাত্র ৩২ কিলোমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার বুকে জেগে থাকা ছোট্ট একটুকরো ইতিহাসের নাম পানাম নগরী। এ নগর নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও থানার অন্তর্ভুক্ত। এক জনহীন নগরী।

বাংলাদেশে পর্যটন বিকাশ সংক্রান্ত এক সেমিনারে যোগ দিতে এসে ঢাকা শহরে থাকতে হয়েছিল দিন দুই। ‘সাপ্তাহিক নতুন কথা’ সংবাদ পত্রর সম্পাদক শ্রী বাপ্পাদিত্য বসু ছিলেন আমাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে। সংবাদ পত্রর দপ্তরে বসে টুকরো কথাবার্তার ফাঁকে তিনিই আমাদের সন্ধান দেন ইতিহাস বিজরিত পানাম নগরীর। হাতে একবেলা সময় থাকায় কালবিলম্ব না করে আমার সঙ্গি অরুপ আর স্থানীয় বন্ধু লিমন বরুয়াকে সঙ্গি করে বাসে চেপে রওনা দিলাম নারায়ণগঞ্জের জাতীয় সড়ক ধরে। উদ্দেশ্য,পানাম নগরীকে কাছ থেকে দেখে নেওয়া আর ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার।

পানাম নগরীতে ঢুকতেই বিবর্ণ ইতিহাস আর তার বিবর্তিত স্মৃতি-মহল গুলো যেন মনকে অতীতের বাঁধনে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধতে শুরু করে দেয়। অবশ্য এই নগরীতে প্রবেশের মুখেই এক বড় ধাক্কা। রবিবার হওয়াতে,বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী আজ পানাম নগরী দর্শন বন্ধ। কিন্তু সব দেশেই বোধহয় আইনের তালাতে যথাযথ চাবি পড়ে না। একে ‘ইন্ডিয়া’ থেকে এসেছি তার উপর হাতে আর কাঁধে ক্যামেরার সমারোহ দেখে গেটে বসে থাকা মুরুব্বী গোছের কিছু লোক অম্লানবদন-উৎকোচের বিনিময়ে আমাদের ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিলেন। বুঝলাম সরকারি বিধি-নিষেধ এখানে কিছুটা শিথিল। গেটে প্রবেশের মুখে দুটি সাইন বোর্ড নজরে পড়ল, যা থেকে বুঝতে পারলাম এই নগরীর রক্ষণাবেক্ষণ এখন প্রত্নতত্ত্বঅধিদপ্তরের অন্তর্গত-‘বাংলাদেশ সরকার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়’-এর অধীনে। আর পানাম নগরী পরিদর্শনকালীন সময়সুচী হল মঙ্গলবার থেকে শনিবার পুরো দিনের জন্য। রোববার পুরো বন্ধ আর সোমবার অর্ধেক। আর এই নির্জন নগরীতে প্রবেশ করতে গেলে সরকারী পরিদর্শনের হার সার্ক ভুক্ত  দেশের নাগরিকদের জন্য পঞ্চাশ টাকা আর সার্ক বহির্ভূত নাগরিকদের জন্য একশ টাকা। প্রাথমিক ঝামেলা মিটিয়ে আমরা ধীর গতিতে প্রবেশ করলাম এক সুদৃশ্য ইতিহাসের থমকে থাকা চৌরাহায়।

হালকা ঘুমের পরতে আচ্ছন্ন এই মৃতনগরী যেন কোন মন্ত্রবলে অতীতের পথ ধরে হেঁটে, থমকে সেঁটে রয়েছে  হাজার বছর পেছনের ইতিহাসের পাতায়। যেন কোন যাদুকর তার জীয়নকাঠি হারিয়ে ফেলেছে এই নগরীরই কোন গোপন অলিন্দে, তোষখানার কোন গোপন কোনায়, কাঠের কড়িবরগা, জানলার খিলান কিংবা সাবেক দেউড়ীর আনাচেকানাচে।  আর আমরাও সেই সময় সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে  হাঁটতে দেখে নিতে থাকি হারিয়ে যাওয়া রাজ্য। হারাই ইতিহাসের অতলে। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে এই বোধহয় মন্দুরা থেকে ধুলো উড়িয়ে ছুটে আসবে হাজার হাজার অশ্বারোহীর দল কিংবা চারিদিক সরগরম হয়ে উঠবে বাহারি বাজারে, দৌবারিকের হাঁকে ডাকে, নর্তকীর নুপুরের নিক্কনে অথবা শঙ্খর  নিনাদে। প্রতিহারীরা আটকাবে পথ, কারণ পাইক-বরকান্দাজরা হয়ত এখুনি নাছদুয়ার থেকে বার করে পালকিতে ওঠাবে কোন জমিদারকন্যাকে অথবা কোন প্রহরীর হাতের উদ্যত তরবারিতে প্রতিফলিত খররোদের বিজলী চমক চোখ ঝলসাবে এই অলস দুপুরে। সোনালী রোদ আটকে আছে বিবর্ণ লাল নীল কাঁচের তৈরী চৌখুপীতে। বয়ে যাওয়া ইতিহাস আর থমকে থাকা বর্তমানের সীমারেখার দলিল হয়ে আজও জেগে থাকে মাকড়শার জালের মতন দেওয়াল-ফাটল, বিবর্ণ ঝাড়বাতি আর খসে পড়া পলেস্তারার চিত্ররেখা। যেন কোন নিঝুম, নিকষ কালো রাতে আবার তা যেন জেগে উঠবে ঘুঙুরের নিপুণ তালে, নাচের চেনা ছন্দে। ভাঙা সিঁড়ি, বিবর্ণ নাচঘর, নিস্পন্দ আঙিনা, সাবেক দেউড়ী আর ঝুলবারান্দাতে এইরকম খন্ডচিত্র খুঁজতে গিয়ে বারেবারেই বর্থ্য হয়েছি। বদলে পেয়েছি আদূর গায়ে লুঙ্গি পরা দামাল বাচ্চাদের আলসে টপকানো বা ক্রিকেট খেলার খন্ডচিত্র। একমুখী বয়ে চলা গরম হাওয়াতে যেন নির্যাতিতের হাহাকার। আর আর আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি প্রাসাদের লাল ইঁটের কঙ্কাল, প্রাচীন জনপদ আর রয়ে যাওয়া সময়ের স্মৃতি আঁকড়ে।  নাছোড় বৃক্ষ আর বেখায়ালী লতাগুল্ম অতীত ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে আঁকড়ে ধরে থাকে হাভেলির ভাঙ্গা দেওয়াল কিংবা খিলানের বিবর্ণ গাঁথনিকে।

ইতিহাস বলছে, যে সোনারগাঁওয়ে এই পানাম নগরী সেই সোনারগাঁও পনের শতকে ছিল বাংলার স্বাধীন সুবাদার ইশা খাঁ-এর রাজধানী।  তবে সেই সময়ে এই নগরী তার স্বপ্রভায় উজ্জ্বল ছিল কিনা সে নিয়ে ঈতিহাসিকদের দ্বিমত আছে। তারও আগে তের শতকের শেষ দিকে সোনারগাঁও এ যখন দেব বংশীয় হিন্দু রাজাদের রাজত্ব চলছিল তখন তার রাজধানী  ছিল এই পানামকে ঘিরেই। পরে মুঘুল সম্রাটদের হাত ধরে শ্রীবৃদ্ধি হয় এই অঞ্চলের এবং এই নগরীর নাম হয় ‘পানাম’ যা আদতে এক ফরাসী শব্দ। বাংলাতে এর মানে আশ্রয়স্থান। সেসময়ে বহু উচ্চবিত্ত রাজকর্মচারীদের বাসস্থান ছিল এই পানাম। তবে পূর্ব-পশ্চিমদিকে চলে যাওয়া রাস্তার দুধারে যে লাল ইঁটের তৈরী অট্টালিকাগুলি রয়েছে তার মধ্যে উত্তরদিকে রয়েছে ৩১টি এবং দক্ষিণদিকে রয়েছে ২১টি যার কোনটির নির্মাণশৈলীতেই মুঘল ঘরাণার ছাপ নেই। বরং প্লাস্টারে তৈরী নকল দরজা জানালা, খিলান, ভেন্টিলেটর, থাম, লোহার তৈরী ব্রাকেটের কারুকাজ কিংবা সিরামিক
চিনামাটি বা টাইলস এর ব্যবহারে রয়েছে ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীর ছোঁয়া। তবে ১৬১১ সালে সোনারগাঁও মুঘল শাষকদের দখলে আসার পর রাজধানী শহরের সাথে পানামের সংযুক্তিকরণ ঘটে এবং তা মূলতঃ সড়কপথ আর জলপথে ঘটে-তার প্রমান আজও রয়ে গেছে। প্রাচীন দু তিনটি সেতু আর তিনদিকে খালে ঘেরা পানাম যে সোনারগাঁও এর উপনগরী তা বেশ বোঝা যায়।

মুঘলদের পরে ব্রিটিশ শাসন কালেও সোনারগাঁও এর গুরুত্ব বাড়ে শীতলক্ষ্যা নদীর পারে গড়ে ওঠা এক বর্ধিষ্ণু বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজত্ব কালে এ অঞ্চলের খ্যাতি ছিল মূলতঃ থান কাপড় মসলিন আর জামদানি শাড়ির ওপর ভিত্তি করে। এবং তা মূলতঃ আমদানি আর রপ্তানী ভিত্তিক। সোনারগাঁও এর পশ্চিমপাড়ে শীতলক্ষ্যা নদীর পারের তুলো গাছ থেকে তৈরী মসলিনের খ্যাতি তখন জগত জোড়া। সেই বস্ত্র বাণিজ্যের হাত ধরে বেশ কিছু বর্ধিষ্ণু হিন্দু বস্ত্র ব্যবসায়ী উঠে আসেন তৎকালীন সময়ে। তারাই নিজেদের বসবাসের জন্য নির্বাচন করেন পানাম নগরীকে যা ছিল সোনারগাঁও এর অনতিদূরবর্তী। তাদের হাত ধরেই ঘটে পানামের চরম বিকাশ ও শ্রীবৃদ্ধি। নজর করলে তৎকালীন বাঙালী তালুকদারদের নাম ফলক আজও তাদের বসবাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। নীল মিনাকারীর কাজে সদর দরজার উপর খোদাই করা-‘কাশিনাথ ভবন,সন ১৩০৫’- সেই ইতিহাসেরই নীরব সাক্ষী হয়ে থমকে থাকে পানাম নগরীতে। কিন্তু ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্থানের যুদ্ধর সময় ব্যাপক লুঠতরাজে ভীত সন্ত্রস্ত ব্যবসায়ী মহল পানাম ছেড়ে পাড়ি জমান ভারতে। ইতিহাস আর অধঃপাতের হাত ধরে সেই থমকে থাকা নির্জন নগরীর উত্থানের শেষ অধ্যায় রচিত হয় সেদিন থেকেই। প্রাচীন অলিন্দে খোদিত হতে থাকে বঞ্চনার দিনলিপি। অযত্নে আর অবহেলাতে দীন হতে থাকে ইতিহাস।

দেখতে দেখতে বিকেল গড়ায় গোধূলীতে। গোধূলী বেলার পরন্ত লালচে রোদ আরও এক বার রঙীন আভা তোলার শেষ চেষ্টা করে সদরে,দেউরীতে আর অন্দরে। একফালি লালচে আলো ভগ্নপ্রায় দোমহলার বুকে লুটিয়ে পড়ে শেষ আকুলি নিয়ে। কিন্তু ভিতর ঘরের মলিনতা আর, অধঃপাতের কালো অন্ধকারকে কিছুতেই উজ্জ্বল করতে পারবেনা জেনেই গোধুলীর শেষ বেলার লালচে আলোও স্তিমিত হয়ে পড়ে ধীরে ধীরে। আর আগুয়ান অন্ধকারেই মুখ ঢেকে নেয় মৃতেরনগরী পানাম। আরও একবার।

1 COMMENT

  1. খুব ভালো লাগল । শুধু লেখা পড়েই জায়গাটা চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here