সিংগালিলা অভিযান – অভিজিৎ আঢ্য

0
180

দার্জিলিং মেলের টিকিট মুঠোয়। ছয়ে সব সয়। উঠে পড়লাম ট্রেনে। বিনয় সবিনয়ে রাতের আহার নিয়ে পড়ল, যেন সবটাই ওর কেনা। আমরা হাসতে হাসতে ওর আহার দেখি আর বাহার পাই। ও শুধু বলল, “বস খাটনি আছে। খাওয়াটাই মূল ব্যাপার, বুঝলি?” শিলিগুরি পৌঁছে জাইলোটা যেন ড্রাইভারের হাতে পরে উড়ল টিকিয়া উড়ান। গাড়িতে ড্রাইভারকে আবার অনুরোধ, দেবর্ষির, “ভাই কাল রাতে সব খেয়েছে, বিনয়। একটু থামতেই হবে, ভীষন খিদে।” চালক তাই করলেন। আলুর পরোটা, দারুণ সবজি আর চাটনি দিয়ে জমজমাট জলখাবার। বিনয়, অর্ণব, সৌমিত্র, বাসুদেব, দেবর্ষি আর আমি। গন্তব্য  জোরথাং। প্রায় ঘন্টা সাড়ে ছ’ঘন্টার গাড়ি পথ। তবে মাঝখানে টুকটাক ব্রেক, ছবি তোলা, আর বিন্দাস আড্ডা ছিলই। সেখানেই দূর পাহাড়ের দিকচক্রবালে আচমকাই খেলা করছিল রূপসি সোনার পাহাড় । মেঘ কখনো আলোকময়, কখনও প্রেমের তুফান তুলে ঢেকে দিয়ে যায়। যেন এই রাজ্যের একক সম্রাট এই মেঘ পাহাড়ের ঘনঘটা। এসব করতে করতেই হিলে এসে গাড়ি ডেড স্টপ। দূরের ঢেউ খেলানো মাঠে ধাপ চাষ হচ্ছে, আগামী দিনের খাদ্য সম্ভার মজুদ করতেই। চায়ের চাষ হচ্ছে পাহাড়ি ধাপে। চমৎকার শৃঙ্খল তাদের এই বুননে। আর বড় রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে যেমন উঁকি দিয়ে যায় শাল সেগুনের গাছ তেমনই বার্চ, পাইন। গাড়ি ভাড়া গুনতে হবে। খুঁজতে থাকলাম বিনয়কে, কিন্তু কোথায়? ও কেটেছে। আমরাই কোমরে গুঁজে রাখা পার্স থেকে টাকা বার করে ড্রাইভার ভাইয়ের হাতে গুঁজে দিলাম। সে চমৎকার হাসে। পাহাড়ি সরলতা তার ঝাঁ চকচকে দাঁতে। বাসুই বাড়ির কথা বেশি ভাবে কী না জানা নেই, ফটাস করে মুঠো ফোন থেকে বাড়িতে খবরটা দিয়ে দিলই শুধু নয়, আমাদের বাড়িতেও পৌঁছে গেল খবরটা। বিনয় ফিরল দন্ত বিকশিত করে। শীত যেন শরীরে ঢুকে পড়ল আচমকাই। পাহাড়ে সন্ধ্যা দ্রুত নামে। হিলের হোটেল বুকিং ছিলই। আজ থেকে যাওয়া। মুড়ি এত সময়োপযোগী সকলেই জানতাম, তাই সঠিক সময়ে মনে পড়ল। চানাচুর দিয়ে যথেষ্ট রেলিস করেই মাখা হল। ততক্ষণে চায়ের জন্য কেয়ার টেকার বন্ধু খবর নিয়ে গিয়েছে।

         পরদিন সিংগালিলা অভিযান। সকলেই সকালেই তৈরি। ঘনায়মান অন্ধকার খুলছে সিংগালিলা পরতে পরতে তার জঙ্গলঘরের সৌন্দর্য। আমাদের মন বলল, একজন পোটার প্রয়োজন। ব্যবস্থা হতে দেরি হল না। ফুরতোম্বা ফুরফুরে মেজাজের ছেলে, হাঁটে ছোটে, এবং ব্যপক সিরিয়াস। হালকা ফুলকা আহারই সঙ্গে নিয়েছি। সময় হলেই নুডুলস বড় উপকারি হয়ে ওঠে। ফুরতোম্বা আচমকাই আমাদের বলল, “ইঁহা থোড়া ইন্তেজার করনা, ম্যাঁয় আ রহা হুঁ।” সৌমিত্র থমকে গেল, “কী বে কাটল না কি?” খানিকবাদেই হাজির ফুর। আরে ভাইসাব আপলোগ জায়েঙ্গে, লেকিন পারমিশন কাঁহা? ওহি বানানে গয়া থা ম্যাঁয়। বাঙালি দাদা ভাল আছেন?” ঝোড়ো বাতাস বয়ে গেল তার মিস্টি বাংলায়। পথ চলতে থাকল আমাদের পায়ে পায়ে।

         প্রসঙ্গত বলে রাখি, অবশ্যই বন দফতর থেকে সিংগালিলা যাওয়ার অনুমতি পত্র নিয়ে নেবেন, না হলে যেতে পারবেন না। বর্ডার হেতু প্রবল কড়াকড়ি। দেবর্ষি কোথায় সাতজনই তো ছিলাম! বাসুর চিৎকার দে…ব…র্ষি…ই…! ফুরতোম্বা মাঝে। বিনয় প্রথমে, দেবর্ষিকে পিছনে রেখেই হাঁটছিলাম। ও নেই…কোথায়? দেবর্ষি ছিল ব্যস্ত। প্রকৃতির ডাকে। সকালের তারাহুড়োয় ওর হয়ে ওঠেনি। লুকিয়ে ছিল, সারা পর্যন্ত দেয়নি, পাছে আমরা ঝামেলা করি। ফুরের হাসি থামতেই চায় না। গন্তব্যের দিকে মনোনিবেশ করলাম। ভার্সের দিকে হিলে হয়ে চলেছি। রাস্তা প্রায় টানটান চড়াই- উতরাই। তবে লেডিস ট্রেকও বলা যায়। তবে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ধুপ-ছায়ার যে অনিয়মিত খেলা সে বড় সুন্দর। আমরা প্রত্যেকেই মুগ্ধ, এই ভার্সের সৌন্দর্য সত্যিই বিমোহিত রুপসী। কত অচেনা ফুল, নাম না জানা। রঙে আর রূপে সবাই ঝলসে দিয়েছে এই ভার্সের দুনিয়া। তবে এসব যেমন নজর কাড়ছে , তেমনই নজর রাখতে হচ্ছে ফুরতোম্বার দিকে। বহুত ফাস্ট। হইহই করে যেন ছুটছে আর গান গাইছে। আজ আমাদের গন্তব্য জড়িবুটি। ভার্সে থেকে প্রায় ২০ কিমি। এবং বলে রাখা ভাল, আমরা জেদ ধরেছি আজই পৌঁছব। এবার যে পথ সামনে, তা মারাত্মক টাফ। ভিজে আর স্যাঁতসেঁতে। সকালের মালিন্য এখানে কাটতে অনেক দেরি। ফলে, রাতের শিশির পড়ে পথ বেশ পিচ্ছিল। রাস্তাও বেশ খারাপ। ভাঙছি ছোট ছোট টার্ন আর ধস্ত পথ, পথ না বলে এবড়ো খেবড়ো জায়গা বলাই শ্রেয়। এবার বিপদ ঘনিয়ে এল, সামনেই কাদা মাখা পথ, পেরতেই হবে। সেখানেই বিপত্তি ঘটে গেল। প্রত্যেকেই পড়লাম কাদা জলের পাল্লায়। ফলে জুতো টুতো ভিজে একশেষ। এই ঠান্ডার মধ্যে বিনয়ের জুতোর সুকতলা কাদায় ভিত বানিয়েছে। বেলা দুটো নাগাদ ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে জড়িবুটি এসে পৌঁছলাম। বিনয়ের শ্যু-শোক তখন উচ্চমানের, প্রায় কেঁদে ফেলে। ততক্ষণে ফুরতোম্বা ঘন জঙ্গলের মধ্যে টেন্ট খাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমরাও হাত লাগালাম। অদূরেই ঝরনা বাজছিল টিং টাং টিং টাং করে। ফুর ছুটল জল আনতে। বসে পড়লাম ছাতু মাখতে, চিনি দিয়ে কেউ কেউ, কেউ খেল লঙ্কা দিয়ে। মুড়ি, চানাচুর কাঁচা পিয়াজ জমিয়ে খেয়ে টেন্টের মধ্যে সেঁদিয়ে পড়লাম এক এক করে। ঘনায়মান জঙ্গলে আঁধার নামতে লাগল বড় দ্রুত। ভীষণ টায়ার্ড ছিলাম। আমরা কোনওক্রমে রাতের খাওয়া চাউমিন দিয়ে সেরে শুয়ে পড়লাম দ্রুতই। কারণ, ফুর বলল, “এখানে ভাল্লুকের অত্যাচার প্রবল।”

     “সে কী কাণ্ড! আবার ভাল্লুকও আচে? রাতে বাথরুম পেলে কী হবে এ এ এ এ ?” দেবর্ষি ভয়ঙ্কর টেনশনে হঠাৎই আমার পাশ থেকে উঠে ফুরের পাশে গিয়ে শুল। তারপর ফুরের সঙ্গে গল্প শুরু করল মহাভারতের। “জানতা হ্যায় একবার অর্জুনজি নে বন মে ভাল মারা থা, লেকিন ও ভাল অসলি মে কৌই এক দেবতা থা। ব্যস, ওস টাইম মে লক্ষ্ণণজি জানতে পারা হ্যায় কে দুর্ঘটনা ঘটে গা…” বিনয়ের চিৎকার, “বাবা দেবর্ষি, তুই রামায়ণ-মহাভারত গুলিয়ে গ করে ফেলেছিস। ভুলভাল না বলে বক বক বন্ধ কর। বেচারাকে শুতে দে। কাল ওই আমাদের রাস্তা চেনাবে।” ফুর বলল, “বিনয়দা, অভিজিতদা আমি রামায়ণ, মহাভারত দুটোই জানি, নো টেনশন। ভয়ে ভুল বকছে।” দেবর্ষি বলল, “আমি কি তোদের ছেলেখেলার পাত্র? মসকরা মারছিস? যা আমিই প্রথম বাথরুমে যাব, টেন্টের বাইরে। যা হওয়ার হবে…তখন ঘড়িতে রাত ১১ টা ৪২ মিনিট।

ভোর থাকতেই আমরা টেন্ট আর স্যাক গুছিয়ে রেডি হয়ে নিলাম। আজ আমরা কানজার যাবো। আজকের রাস্তা সবথেকে বেশি দুর্গম। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চড়াই পথ। রাস্তা তেমন করে বোঝা যাচ্ছে না। ফুরতোম্বা আগে আগে এগিয়ে চলেছে, আমরা তাকে অনুসরণ করে চলেছি, দেবর্ষি, বাসু ও অনন্য ’র অবস্থা বেশ খারাপ। এরা মানসিক ভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েছে, কোনও রকমে বুকে হেঁটে ওপরে উঠছে। আমরা এগিয়ে চলেছি কানজারের পথে। শুধু চড়াই পথ, মনে হচ্ছে, এই চড়াই এর বুঝি আর শেষ নেই! ফুরতোম্বা বেশ আগে আগে চলছে। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু, তবুও আমরা চলেছি।

     বেলা দুটো নাগাদ আমরা কানজারে এসে পৌঁছেছি। আবহাওয়া বেশ খারাপ, গুঁড়ি গুঁড়ি বরফ পড়া শুরু হয়েছে। আমরা তাড়াতাড়ি টেন্ট খাটিয়ে নিলাম। ফুরতোম্বা জলের ব্যবস্থা করতে গেল। তখনও বাসু, দেবর্ষি ও অর্ণবের দেখা নেই। তাদের জন্য বেশ চিন্তা হতে লাগল। ১ ঘন্টা পর ওরা আমাদের টেন্ট এ এসে পৌঁছল। আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। মাঝে ওরা পথ ভুলে অন্য পথে চলে গিয়েছিল। যাইহোক আমরা তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে টেন্টে ঢুকে পড়লাম। বরফ পড়ে চলেছে অনবরত। আর ভয় হচ্ছে যদি সমস্ত রাস্তা ঘন বরফে মুড়ে যায় তাহলে, এখান থেকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। সিংগালিলা পথ আর অতিক্রম করা যাবে না।

     সকালে যখন চোখ খুললাম তখন চারিদিক সাদা হয়ে গেছে, অল্প অল্প বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা ঠিক করতে পারছিলাম না এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে, আমরা সিংগালিলা পাস অতিক্রম করে এগিয়ে থাকব, না নিচে ফিরে যাব। আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যদি আবহাওয়া ঠিক হয়, তবেই আমরা এগিয়ে যাব, নতুন করে নিচে ফিরে যাব না। প্রায় ১ ঘন্টা অপেক্ষা করার পর, আবহাওয়া বেশ পরিস্কার হয়ে গেল। আমরা এগিয়ে চললাম সিংগালিলা পাসের উদ্দেশ্যে। আমরা ঠিক করলাম, আজই আমরা সিংগালিলা পাস অতিক্রম করব। চারিদিক বাঁশের ঝোপঝাড় বরফে সাদা হয়ে রয়েছে। স্যাঁতস্যাঁতে পথ যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে! তাই সবাই সাবধানে এগিয়ে চললাম। এই ভাবে প্রায় ঘন্টাদুয়েক চলার পর আমরা সিংগালিলা পাসের মাথায় এসে পৌঁছলাম। তখন চারিদিক সাদা হয়ে গেছে, ভগবানের অশেষ কৃপা, মেঘ সরে গিয়ে আকাশ একদম পরিস্কার হয়ে গেল। আর আমাদের চোখের সামনে একই রেখায় সূর্য উঠল। মাকালু, এভারেস্ট, পান্ডিম ও কাঞ্চনজঙ্ঘা চোখ রাঙিয়ে গেল আমাদের সকলের। যে, স্বপ্ন নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম, তা সার্থক হল। সে রূপ, সে দৃশ্য জায়গা করে নিল আমাদের মনের মণিকোঠায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই আবহাওয়া ফের পালটে গেল, চারিদিক মেঘাচ্ছন্ন নিমেষের মধ্যে। আমরা এবার নামা শুরু করলাম ফালুটের দিকে। আজ কোনও ক্রমে ফালুট আমাদের পৌঁছতেই হবে। কারণ আমাদের কাছে সঞ্চিত খাবার সবই নিঃশেষিত। চারিদিকে ঘন কুয়াশা, দু’হাত দুরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমরা শুধু ফুরতোম্বাকে অনুসরণ করে চলেছি। এর মধ্যে একবার ভুল পথেও চলে গিয়েছিলাম। প্রত্যেকের শরীরের সমস্থ শক্তিই যেন নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছে। আমরা একটা এস. এস. বি ক্যাম্পকে পিছনে ফেলে ফলুয়ারির দিকে এগিয়ে চললাম। এখান থেকে ফালুট ৭ কিমি রাস্তা পেরলেই, আমরা সমস্থ বল প্রয়োগ করে পথ হাঁটছি, তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। আমরা ফালুট এসে পৌঁছলাম।

     ফালুটের ট্রেকার্স  হাটটি দেখতে পেয়ে, যেন আমরা নতুন জীবন ফিরে পেলাম। এবার মন বলল, আমরা বেঁচে ফিরতে পারি। এতক্ষন আমরা সকলেই প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় ছিলাম। আমরা ফালুটের ট্রেকার্স হাটে পৌঁছে সবাই নুডুলস দিয়ে পেটের জ্বালা জুড়ালাম। আমরা ফুরতোম্বাকে তাঁর পারিশ্রমিক দিয়ে, তাঁকে বিদায় জানালাম। এখান থেকে সে তার গ্রাম রিম্বিকে চলে যাবে আগামী কাল সকালে। আমরা রাতের খাবার খেয়ে অনেক দিন পর নিশ্চিন্তে ঘুমতে গেলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here