কাহনের সাথে আমার আর বনলো না। এমনটা না, যে চেষ্টা করিনি। করেছি অনেকবার । কিন্তু তাও আটকাতে পারলাম না ওকে। ও চলে গেল। একপ্রকার আমিই ওকে যেতে সাহায্য করলাম। এখন এই থ্রিবিএইচকের ঘর আমায় গিলে খায়। প্রত্যেকটা দেয়ালের নক্সা থেকে শোপিস সব কাহনের হাতে পছন্দ করা। গোটা ঘর ওরই সাজানো।
ওই তোহ একতারাটা, ওটা সেবার শান্তিনিকেতন থেকে কেনা। সারারাত ড্রাইভ করে ভোরে শান্তিনিকেতন পৌঁছানো। বিকেলে খোয়াইয়ের পাড়ে বসে ও আমায় একতারাটা গিফ্ট করলো। টুংটাং করে বাজিয়ে গান ধরলাম, দেখেছি রূপসাগরের মনের মানুষ কাঁচা সোনা। বিকেলের হলুদ আলো কাহনের ফর্সা গালে এসে পড়েছে। সবুজ শাড়ি, সাদা লং স্লীভ ব্লাউস আর পোড়ামাটির গয়নায় বনদেবী লাগছিল ওকে। ও নাচ করছিল। আমি গাইছিলাম,
তারে ধরি ধরি মনে করি… ধরতে গেলেম.. আর পেলেম না।
আর পাওয়া হলো না কাহনকে। একতারাটা তুলে নিলাম হাতে, এটা দিয়েই আজ..
আমার পরিচয়টা দিইনি এখনো। অবশ্য গুছিয়ে লিখতে আমি কোনোদিনই পারিনা তেমন। ছোট খাটো কবিতা বড়জোর। এইটুকুই আমার দৌড়। ওই কবিতা থেকেই কাহনের সাথে আলাপ। প্রেম। একসাথে থাকা.. না অন্য প্রসঙ্গে ঘুরে যাচ্ছি, পরিচয়টা দি আগে।
আমি শাক্য। আইটি সেক্টরে চাকরি করি। বেশ ভালো পদেই আছি। রাজারহাটে ফ্ল্যাট কিনেছি।মোহিনী। নামটা কাহনেরই দেওয়া। মা বাবা বেহালার পুরোনো বাড়ি ছেড়ে এখানে আসতে চায়নি। জোর করিনি কোনো, আমি মাঝে মধ্যে গিয়ে দেখে আসি ওদের।
বইমেলাতে আমার সাথে আলাপ হয় কাহনের। বোধিসত্ত্বদা আমার কবিতার বই ছাপাল সেবার। আমার কলেজের সিনিয়ার ও। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কবিতা পড়বার পর ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম বাইরে, তখন কাহন আলাপ করতে আসে। কবিতা পড়ছিলাম যখন , তখন দুএক বার চোখ পড়াতে দেখেছি ওকে, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে।
কথাটা বরাবর গুছিয়েই বলি আমি। সেদিনের সন্ধ্যেয় কি ছিল জানিনা। কাহনের চোখে কি দেখেছিলাম জানিনা। শুধু আস্তে আস্তে রাত গাঢ় হলো। আমরা একসাথে বেরোলাম মেলা থেকে। পায়ে পায়ে হেঁটে বেড়াতে লাগলো অপু দুর্গা থেকে আলতামিরার গুহার ছবি। ভিনদেশী তারার খোঁজ পেতে পেতে আমরা একে অন্যকে আবিষ্কার করছিলাম। ওর প্রিয় রং নীল। আমার সাদা। দুর্গাপুজো এলে বাতাসের গন্ধটা আমরা দুজনেই পাই। দুজনেই পাহাড় ভালোবাসি। দুজনেরই বই ভালো লাগে। নন্দনের কাঠের চেয়ার থেকে ফুটপাথের ধোঁয়া ওঠা মোমোর মধ্যে দিয়ে আমরা জড়িয়ে পড়ছিলাম দ্রুত। একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়েছিলাম আমরা। নরম আলো গায়ে মেখে বসে ছিল কাহন। মুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া অবাধ্য চুল সামলানোর চেষ্টা করছিল। আমি কাঁচের গ্লাস থেকে অল্প অল্প করে চুমুক দিচ্ছিলাম জল। ভাগাভাগি করে আমার প্লেটে নুডুলস তুলে দিচ্ছিল ও। আমি চুপ করে বসে শুধু ওকেই দেখছিলাম। একটানা কথা বলে যাচ্ছে কাহন। মাস্টার্স শেষ করে, দু বছর হলো পিএইচডি করছে কেমিস্ট্রিতে। কত কথা। আমার কানে সেসব ঝাপসা হয়ে আসে। কেবল ওর হাসি, ওর চোখের পলক, ওর নাকের নথে আমি আটকে ছিলাম।
সে রাত্রে বাড়ি ফিরে প্রথমবারের জন্য ফাঁকা ফাঁকা লেগেছিল ঘরগুলো। মোবাইলটার দিকে টানা তাকিয়ে ছিলাম কখন মেসেজ আসে কাহনের। একরকম ছট ফট করছিলাম বলতে গেলে। এই বয়সে এসে এভাবে দমকা হাওয়ায় ভরে গেল ঘর! এই শীত কুয়াশার জাল ছিঁড়ে প্রানপনে বেরিয়ে আসতে চাইছে বসন্ত। তাকে ঠেকানোর ক্ষমতা আমার নেই। বসন্তের সামনে নতজানু হয়ে বসবার নিয়মই চিরকালীন। আমিও বসলাম।
তারপর আমাদের দুজনের একসাথে মোটা হবার পালা। না একতরফা মোটা! আমিই বলতে গেলে! কাহনের পাল্লায় পড়ে রাস্তার ধারের ফুচকার ঝাল চাখা থেকে শুরু করে কাকভোরের টেরিটি বাজার। রাস্তায় ধপ করে বসে পড়ে বিড়াল চটকাতো কাহন। আমার আবার আঁচড় কামড়ের ভয় লাগে। লোকজন অবাক হয়ে দেখতো কাহনকে। এমন সুন্দর একটা মেয়ে ধূলো মেখে বিড়াল চটকাচ্ছে। আমি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম কাহনের পাশে। ছবি তুলতাম। তারপর বেশি দিন লাগেনি। আঁচড় কামড়ের ভয় উল্টে কায়দা করে বিড়াল ধরাও শিখে গেলাম। আমিও কাহনের সাথে একসাথে বসেই আদর করি ওদের।
কাহনকে দেখে আমি শিখেছি প্রতিনিয়ত জীবন কিভাবে বাঁচতে হয়। আমাদের এই একমুখী স্রোতের জীবন থেকে বেরিয়ে এসে পাড়ের দিকে সাঁতরে ভিড়তে কেমন লাগে। কত ছোট ছোট জিনিসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে কত বিশাল বিশাল ভালোলাগা ,কাহনের থেকেই শিখেছি। কি প্রচন্ত ছোট্ট বাচ্চার মতো সরল হয়ে ও আমায় গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খায় আচমকাই। আমার সংকোচ আমার লজ্জার পরত গলে যেতে থাকে আস্তে আস্তে। এই মুহূর্ত টুকুই সত্যি। এই প্রত্যেক মুহূর্ত প্রতিটা চোখের পলকে যেটা মিলিয়ে যাচ্ছে অনবরত, এই পলকগুলোয় প্রাণভরে বাঁচাটুকুই সত্যি।
আমরা কেউই মন্ত্রপূত মালাবদল আচার নিয়মে বিশ্বাসী নই। প্রায় দেড় বছর লিভ ইন করার পর, আমাদের কাগুজে বিয়ে। মহীনের ঘোড়াগুলি বেজেছিল আমাদের বিয়ের রাতে সানাইয়ের বদলে। একে একে বদলে যাচ্ছিল সুমন থেকে রবি ঠাকুরে। আমরা আস্তে আস্তে নাচ করছিলাম তালে তালে। রেড ওয়াইনের গ্লাস হাতে ধরা ছিল কাহনের। ওর পছন্দের। ওর নিশ্বাস গাঢ় হয়ে আসে। আমার ঠোঁটের উপর পড়ে। কি মায়াবী লাগছে ওকে। মাথার উপরের কাঁচের ঝাড় থেকে টুকরো টুকরো আলো এসে ওর মুখে পড়েছে ইতস্তত। আমি ওর ঠোঁট দুটোকে আদর করলাম। ঠোঁটে ঠোঁট চুবিয়ে আমরা বিছানায় গেলাম। মোমের আলোয় ঘর ভরা। নারী দেহ একটা ক্যানভাস। আদর ,সম্ভ্রম, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা, এরা হলো রং। আর পুরুষ শরীর তুলি। যৌনতা আসলে শিল্প। আর আমরা শিল্পী। পরস্পরের শরীরকে ঠিক সেভাবেই মন প্রাণ ঢেলে নিবেদন করতে হয় সাধনায়। তুলির স্পর্শে পরতে পরতে রং এসে লাগে। নরম লাল আর ভালোবাসার গাঢ় লাল রঙে আদরের ক্যানভাস জুড়ে ফুটিয়ে তুলতে হয় ছবি। ধীরে ধীরে সাধনার চরম শিখরে উঠেই পরিপূর্ণ হয় শিল্প। কাহনের বুকের ভিতর মুখ গুঁজে যখন ঘুমিয়ে গেছি তখন ভোর হয়ে এসেছে। দুজনে তখন সারারাত জুড়ে আঁকা রঙ উপচানো স্টারি নাইট।
আমাদের জীবনে ভ্রমর এসেছে তিন মাস হলো। অতো কালো অতল চোখ দুটো থেকেই ভ্ৰমর নাম দেওয়া। আমরা দুজনেই বরাবর চাইতাম মেয়ে হোক আমাদের। হলোও তাই। ভ্রমরকে একবিন্দু কাছ ছাড়া করেনা কাহন। কোনো কোনোদিন তোহ আমরা একসাথে শুইও না। ভ্ৰমর আসার আগে পর্যন্ত আমরা এরকমটা ভাবতে পারিনি কখনো। আমি কাহনকে চিরকাল বলতাম, দেখ আমি কিন্তু রোজ রাতে তোকে চাই। বুকে লেপ্টে মিশিয়ে রাখতে চাই। শেষ দিন অব্দি।
কিন্তু কই ! আগে অফিস থেকে ফিরলে বেল বাজাতেই কাহন দৌড়ে এসে দরজা খুলতো। আমায় জাপ্টে ধরতো বাচ্চাদের মতন। আমিও ওকে কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে সোফায় ফেলতাম। পাগলের মতো আদর করে সারাদিন না দেখার গর্তটা ভরিয়ে নিতাম প্রানপনে। কিন্তু এখন ! কাহনের আমায় জড়িয়ে ধরবার সময়টুকুও নেই। কোনোমতে দরজা খুলেই ভ্ৰমরের কাছে ফেরত চলে যায়। এরকমটা হওয়ার কথা তো ছিলোনা। ভ্ৰমর কোথাও যেন আমার থেকে কাহনকে টেনে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে হিংসে হয় ভ্রমরের উপর আমার। এমনটা না যে ভ্রমরকে ভালোবাসি না আমি। প্রচণ্ড ভালোবাসি। তবে কাহনকে একটু বেশিই ভালোবাসি। আমি একমুহূর্ত বাঁচতে পারবোনা কাহনকে ছাড়া। মনে পড়েনা শেষ কবে আমরা আদর করেছি একে অন্যকে। ভালো করে চুমুটুকুও খাইনি কতদিন। কাহনকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই ঝটকা মেরে সরিয়ে নেয় নিজেকে ও। সব সময় আদর ভালো লাগেনা ওর এখন। বিরক্ত হয়। যে গান ওর প্রাণ, সেই গানও ছেড়ে দিয়েছে। আমার লেখা সবার আগে পড়ত কাহন। আগে ও পড়বে তারপর বাকি সবাই। এখন খোঁজটুকুও রাখে না আমার লেখার। সারাটাদিন শুধু ভ্ৰমর ভ্ৰমর আর ভ্ৰমর।
কাহনের মৃতদেহটা বাথটাবে শুইয়ে রেখেছি। অনেক ভেবে চিন্তে এটাই ঠিক করেছি। আমায় এখন বেরোতে হবে। বেশি দেরি করা যাবেনা। কাজের মেয়েটাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি যে কাল থেকে আর আসতে হবেনা। একমাস ছুটি দিয়ে দিয়েছি। আগাম মাইনে পেয়ে বেশি কিছু জানতেও চায়নি মেয়েটা। ভ্রমরকে দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়ালাম। এবার না বেরোলে দোকান পাট খোলাও পাবোনা। গাড়ি নিয়ে শহরের একটার পর একটা মলে গিয়ে মধু কিনছি। হ্যাঁ মধু। হিসেব করে দেখেছি প্রায় আশি লিটার মতো মধু লাগবে কম করে। মলে কেনার এটাই সুবিধা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতে আসেনা এত মধু কেন কিনছেন। এক জায়গা থেকে বেশি কিনছি না তাই। ঘুরে ঘুরে কাজ মিটিয়ে ফিরতে বেশ দেরি হলো। লিফটে করে দুই বারে তুললাম পুরোটা। না কেউ দেখেনি। ঘরে ঢুকে দরজা দিলাম ভালো করে। ভ্ৰমর ঘুমাচ্ছে। যাক। ব্যাগগুলো নিয়ে বাথরুমের ভিতরে আসলাম। দুধসাদা বাথটাবের ভিতর নীল গাউন পরা কাহন যেন ঘুমাচ্ছে। আমি আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। হাউহাউ করে কেঁদে ফেললাম। এ কি হয়ে গেল আজ আমার হাত থেকে। যাকে আমি আমার প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি, আমার কাহন, আমার কাহনকে আমি মেরে ফেললাম।
আজ শনিবার। আমার ছুটি থাকে। দুপুরে বিছানায় শুয়ে ল্যাপটপে সিনেমা দেখছিলাম। কাহন স্নানে গেছে। হঠাৎ ল্যাভেন্ডারের গন্ধে ভরে গেল ঘরটা। মুখ তুলে দেখলাম সদ্য স্নান সেরে কাহন ঘরে এসে ঢুকেছে। ভেজা চুল থেকে জলের কুঁচি ঝরে ঝরে পড়ছে। বুক অব্দি তোয়ালে জড়ানো। যৌবন উপচে পড়ছে সারা গা থেকে। স্নানের পর সব মেয়েকেই কি এতটাই স্বপ্নিল দেখায়। কাহন এবার তোয়ালেটা খুলে নীল গাউনটা পরলো। অসম্ভব লাবন্যময়ী ফর্সা ত্বক থেকে দ্যুতি যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। বুকের কাছটা খোলা। ফিতেটা বাঁধেনি কাহন। দুধের ভারে পাকা ধানের শীষের মতো আনত হয়েছে স্তনদুটো। মুখে ক্রিম ঘষছে কাহন। হাত দুটো মাথার পিছনে নিয়ে গিয়ে ঘাড়ে মাখছে। আমি আর পারলাম না বসে থাকতে। কাহনকে পিছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম। ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে ওর গন্ধটা নিলাম ফুসফুস ভরে। ওর বুকদুটোতে হাত রাখলাম। কতোদিন পর।
-আমি যে শুকিয়ে মরে যাচ্ছি কাহন। তুই কি আমায় দেখিসও না।
-ঢং করিস না তো।
– উঁহু ঢং না রে। সত্যি বলছি। কতোদিন আদর করিনি তোকে। কতদিন একসাথে কাটাইনি আমরা। তোর কি আমায় আর পেতে ইচ্ছে করেনা কাহন। আমি যে মরে যাবো রে তোকে ছাড়া। পাগলের মতো কাহনের নরম শরীরের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে বলি আমি।
– নাটক করিস না। সারাক্ষন তোর আদর আর আদর। আদর কি ফুরিয়ে যাচ্ছে নাকি। এই সময়টা ভ্রমরের। আমরা তো আছি। আদর তো থাকছে।
আমি কাহনকে চুমু খেতে খেতে বিছানায় টেনে নিয়ে যেতে থাকি। আমার শুষ্ক শরীরটা যেন ওর আদ্র নরম শরীর থেকে এতদিনের না পাওয়া সব আদর গুলো শুষে নিতে থাকে। আমরা একে অন্যের মধ্যে ডুবে যাবার মুহূর্তে বাদ সাধলো ভ্ৰমর। চিৎকার করে কেঁদে উঠলো পাশের ঘর থেকে। কাহন আমার বুকের নীচ থেকে ঝটকা দিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলে আমি ওকে আরো শক্ত করে চেপে ধরি। পাগলের মতো চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকি ওর সারা শরীর। ওর স্তনে মুখ রাখি। বাদামি ফোলা বৃন্তটায় আলতো করে কামড় দি। কাহন এবার আচমকা ওর হাঁটু দিয়ে আমার তলপেটে খুব জোরে আঘাত করে। এক ধাক্কায় আমায় সরিয়ে দিয়ে উঠে পড়ে বিছানা থেকে। ভ্রমরের কাছে ছুটে যেতে চায় দ্রুত। আমি পিছন থেকে ওর গাউনটা ধরে টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে আসতে যেতেই, কাহন টাল সামলাতে না পেরে দড়াম করে পড়ে যায় ড্রেসিং টেবিলের উপর। মাথাটা টেবিলটার নকশা কাটা কোণায় এসে লাগে। মাটিতে পড়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে কিছুক্ষনের মধ্যেই স্থির হয়ে যায় কাহন।
চোখের সামনে সবকিছু এত দ্রুত হয়ে যায় বোঝাবার আগেই। পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ি কাহনের উপর।
কাহন? এই কাহন? কি হলো রে কথা বল? এই কাহন?
মুখ ধরে ঝাঁকাতে থাকি। কোনো সাড়া আসেনা। মাথাটা বাম দিকে ঢলে পড়ে। বুকের মধ্যে কান গুঁজে কোনো স্পন্দন পেলাম না। পাগলের মতো ওর শরীরে একটু ধুকপুকুনি খোঁজার চেষ্টা করছি। নেই। কোনো সাড়া দিচ্ছে না কাহন। নিশ্বাস পড়ছেনা নাক থেকে। মাথাটা কাটেওনি একটুও। কোনো দাগ অব্দি নেই। এ কি হয়ে গেল। কাহনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারালাম আমি।
জ্ঞান ফেরার পর কাহনের ঠান্ডা হয়ে আসা শরীরের উপর থেকে নিজেকে সরালাম। কি করবো আমি এখন। সবাইকে জানাবো?
কিন্তু ওরা জানলে তো কাহনকে নিয়ে চলে যাবে আমার থেকে। কি নিয়ে বাঁচবো আমি?
আর তাছাড়া কাহনকে যে আমিই মেরেছি। আমায়ও তো.. না না। কিছু একটা করতেই হবে। এভাবে সব শেষ হয়ে যেতে পারেনা কিছুতেই। কিছুতেই পারেনা। কাহনকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবনা। সব ঠিক করতে হবে আমাকে। সব ঠিক আগের মতো। কাহনকে ফেরত নিয়ে আসতেই হবে আমায়। যে করেই হোক। তার জন্য যা যা করার আমি করবো।
সবার আগে কাহনের দেহটাকে অক্ষত রাখতে হবে। ল্যাপটপটা অন করলাম। কাহনের পাশে বসেই গুগল করছি। কি করে মৃতদেহ সংরক্ষণ করে রাখা যায়। নাহ ! এত কেমিক্যাল আমার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব না। অনেক ঝক্কি। কিছু তো একটা থাকবে। কিছু এমন জিনিস যেটা সহজলভ্য। লোকজনের সন্দেহের বাইরে থেকে করা যাবে। ভাবতে লাগলাম। কাহনের ঠান্ডা হয়ে যাওয়া শরীরের উপর যত্ন করে হাত বোলাচ্ছি। ওর সিল্কের গাউনটা দেখে চট করে মাথায় একটা ভাবনা এলো। সিল্ক। কোথায় যেন পড়েছি… হ্যাঁ মমি। মিশরীয়রা সিল্কের কাপড়ে মুড়ে রাখতো মৃতদেহ। এসব আধুনিক কেমিক্যাল থেকে বেরিয়ে আমায় ওই প্রাচীন সভ্যতার ভিতর হাতড়াতে হবে। কিছু একটা পেতে হবে। মিশরীয়দের পদ্ধতিতে পেলাম না কিছু। আরো খুঁজছি পাগলের মতো। হাল ছেড়ে দেব সেই মুহূর্তে চোখে পড়লো একটা কলাম। প্রাচীন পারস্যদেশের মমি নিয়ে লেখা।এখনকার ইরান। পারস্যরাও মমি বানাতে পারতো এটা জানতাম না তো! গোগ্রাসে গিলছি লেখাগুলো। হ্যাঁ এই তোহ। মধুর মধ্যে এক রানীর সংরক্ষিত দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মিশরীয়দের নুনের পরিবর্তে এরা মধু ব্যবহার করত। ব্যাকটেরিয়ার দেহ থেকে জল শুষে নিয়ে ওদের সহজেই মেরে ফেলে মধু। ফলে মৃতদেহ পচনহীন অবস্থায় দীর্ঘকাল অক্ষত থাকে। আর মধু নষ্ট হয়না। পিরামিডের নীচ থেকে পাওয়া মধু এখনো খাওয়া যায়।
ল্যাপটপ বন্ধ করলাম। কাহনের ঠান্ডা হওয়া ঠোঁটে চুমু খেলাম অনেকক্ষণ। মাথায় হাত বুলিয়ে বিলি কেটে দিতে থাকলাম। তারপর ওর শরীরটা পাঁজাকোলা করে তুলে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে বাথটাবে শোয়ালাম।
কাহনের গা থেকে গাউনটা খুলে নিলাম আস্তে করে। সম্পূর্ণ অনাবৃত দেহটাকে বাথটাবের মধ্যে ঠিক করে শোয়ালাম। হাতদুটো বুকের উপর ভাঁজ করে রাখা। এবার একটার পর একটা মধুর বোতল খুলে কাহনের গায়ের উপর ঢালতে থাকলাম। ধীরে ধীরে হলদে তরলের নীচে ডুবে যেতে থাকলো কাহনের ফর্সা শরীরটা। শেষ বোতলটা উপুড় করলাম যখন ,তখন কাহন পুরোপুরি মধুর নীচে ডুবে গেছে। প্রায় ইঞ্চি তিনেক গভীরে ঘুমাচ্ছে এখন কাহন।
আমার এখন অনেক কাজ। অফিসে মেল করে দশটা সিএল অ্যাপ্লাই করলাম আগে। সেই কলেজ লাইফে পড়াকালীন বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ডার্ক ম্যাজিক নিয়ে মেতেছিলাম কিছুদিন। প্ল্যানচেটের আসর বসিয়েছি হোস্টেলের চিলেকোঠার ঘরে। বেগুনকোদরে গিয়ে রাতও কাটিয়েছিলাম ওদের পাল্লায় পড়ে। আমি ভূতে বিশ্বাস করিনা। ভয়ও পাইনা তাই সে অর্থে। তারাপীঠের মহাশ্মশানে কৌশিকী অমাবস্যায় ও গেছি শেষবার। কিন্তু অলৌকিক কিছু ঘটনার সম্মুখীন হইনি। আমার মনে হয়েছিল মনের ভিতর এই সব কিছুতে তীব্র অবিশ্বাস রাখবার দরুনই এরকমটা হয়েছে। সেই সময়ে এই সব বিষয় নিয়ে পড়াশোনাও করতাম আধ একটু। প্রাচীন ভারতের খাঁজে খাঁজে রহস্যে মোড়া। একদিকে যেমন তপস্বী সাধু ঋষি সন্ন্যাসীর দেশ তেমনি এসবের পাশাপাশি তন্ত্রসাধনা ডাকিনীবিদ্যা যোগিনীবিদ্যা সম্মোহনী নানাবিধ ডার্ক ম্যাজিকেরও দেশ প্রাচীন ভারতবর্ষ। এসমস্ত গুপ্তযুগের বিদ্যা খুব সতর্কতা অবলম্বন করে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। একমাত্র গুরুই কেবল তার উপযুক্ত শিষ্যদেরকে এই বিদ্যা দান করতেন। গোটা ব্যাপারটাই ছিল মৌখিক। সমস্ত মন্ত্র এবং আচারবিধি মুখে মুখে বয়ে বেড়াতো। লিখিতভাবে কোনো পুঁথি সে অর্থে তাই পাওয়া যায়না। গুপ্তযুগের শেষদিকে এই বিদ্যা বিপুলসংখ্যক লোকের কাছে পৌঁছে যাবার দরুন লোকজন এই গুপ্তবিদ্যার অপপ্রয়োগ করতে শুরু করে। আজকালকার সময়ে আমরা পুরান এবং মহাকাব্যে মুনি ঋষিদের যে সমস্ত অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারি সেগুলো সেই যুগে সত্যিকারের সম্ভবপর ছিল। আধ্যাত্মিকতার চরমে উঠে মানুষ নিজের শরীরের মধ্যেকার আত্মার ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেছিল। প্রযুক্তির ব্যবহার এর মধ্যে দিয়ে বর্তমান সভ্যতা ধাপে ধাপে এগোলেও আধ্যাত্মিকতার ঠিকঠাক প্রয়োগের মাধ্যমে সে যুগের মানুষ শুধু মাত্র নিজের আত্মাকে ব্যবহার করেই অনেক আগেই সারা বিশ্ব ব্রহ্মন্ড সম্পর্কে অবগত হতে পেরেছিল।
এই সমস্ত গুপ্তযুগের প্রভূত বিদ্যা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহস্রাধিক পুঁথির মাধ্যমে সংরক্ষিত করে রাখা ছিল। কিন্তু এক মূর্খ তুর্কী শাসক বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনী ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত পন্ডিত এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের গণহত্যা করে। সেটুকুতেই ক্ষান্ত হয়না এদের ইতিহাস। নালন্দার এই সমস্ত মহামূল্যবান সব পুঁথি আগুনে পোড়ানো হয়। প্রায় তিন মাস ধরে এই আগুন জ্বলে নালন্দায়। পুড়ে খাক হয়ে যায় সেযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়।
মানুষ মারলে সভ্যতা শেষ হয়না। সভ্যতার ধ্বংস হয় মানুষের গাঁথা পুঁথি ইতিহাসের দলিল পুড়িয়ে ধুলিস্মাৎ করে দিলে। সেই সাথে সাথে গুপ্তযুগের সমস্ত বিদ্যা নালন্দার মাটিতেই মিশে শেষ হয়ে যায় চিরকালের মতো। আগামী ভারতবর্ষের মানুষ, আমাদের কাছে তাই এসব জিনিস গল্প এবং বুজরুকি হয়েই থেকে যায়। আজকাল এসবের নামে স্রেফ লোক ঠকানোর ব্যবসাই চলে। ভণ্ডামি।
এতকিছু বলার একটাই কারণ। আমি যে জিনিসটা এখন করতে যাবো বলে মনস্থির করেছি। সেটার সাথে নালন্দার কোথাও না কোথাও কোনো যোগসূত্র হয়তো আছে। আমি আজ অব্দি স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আজ করবো। আজ প্রানপনে বিশ্বাস করবো বলেই কাহনের মৃতদেহটা নগ্ন করে বাথটাবে চুবিয়ে রেখেছি। কাহনকে ফেরত পাবার বিশ্বাসেই।
কাহনের সাথে দেখা হবার আগের বছর, সাগরমেলায় গেছিলাম আমি আর বোধিসত্ত্বদা। স্রেফ ছবি তুলবার লোভেই রাজি হয়েছিলাম যেতে। নইলে এসব ধর্মস্থান পুজো অর্চনায় আমি খুব একটা থাকিনা। বোধিসত্ত্বদার কুম্ভমেলা নিয়ে একটা আর্টিকেল লেখার ছিল। প্রয়াগ যাবার আগে,একদিন রাতে ও আমায় ফোন করে জানায় গঙ্গাসাগর চ, ঘুরে আসি।কাছেই হবে।
প্রথমে আমি গাইগুঁই করলে বোধিসত্ত্বদা ছবি তোলাবার লোভ দেখায়। এরপর আমি আর রাজি না হয়ে থাকতে পারিনি।
গঙ্গা বঙ্গোপসাগরে এসে মিশছে মোহনায়। চারদিকে অজস্র লোকজনের ভিড়। সবাই স্নান করতে এসেছে। প্রথামতে বারো বছর পর পর নাকি এক বিশেষ অবস্থানে চাঁদ সূর্য পৃথিবী অবস্থান করে। তাই এই সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগর পুণ্যভূমি বা যোগপুঞ্জে পরিণত হয়। সেই কারণেই এত স্নান করার বহর। চারিদিকে নানা বেশের সন্ন্যাসী। নাগা সন্ন্যাসীও দেখলাম কতক। ছাই মাখা সর্বাঙ্গ ধ্যান করছে। ছোটবেলায় শুনেছি এখানে নাকি হিমালয়ের গুহা থেকে সন্ন্যাসীরা নেমে আসেন এই সময়। আপনমনে ছবি তুলে যাচ্ছি একের পর এক। ক্যামেরাটা জুম করে লং শট নিচ্ছি একটা। স্নান করে পাড়ে উঠে আসছেন সৌম্যদর্শন একজন সন্ন্যাসী। এক মাথা জটা। সাদা দাঁড়ি। কোমরে লাল শালু। সন্ন্যাসীর ফর্সা গায়ের উপর প্রথম সূর্যের আলো এসে পড়েছে। আমি ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে দুচোখ ভরে দেখলাম ওনাকে। কেমন যেন দেখলেই ভক্তিভাব জাগে। কি অদ্ভুত প্রসন্ন মুখ ওনার। ক্যামেরায় চোখ রেখে ওনার পায়ের কাছটা ফোকাস করতে যাবো, ঠিক তখনই দেখলাম জিনিসটা। হাতখানেক দূরেই বালির মধ্যে কি একটা চকচকে জিনিস নড়ে উঠলো যেন। আমি ক্যামেরাটা সেদিকে জুম করতেই দেখতে পেলাম স্পষ্ট। বালির মধ্যে সারা শরীর লুকিয়ে শুধু মুখটুকু বের করে আছে একটা সাপ। চেরা জিভটা চকচক করে উঠছে। আর কয়েক পা এগোলেই ওই সন্ন্যাসী পাড়া দেবেন নির্ঘাত। শুনেছি সমুদ্রের সত্তর শতাংশ সাপই নাকি বিষধর। আমি ক্যামেরা নামিয়ে কি বলে ডাকবো বুঝতে না পেরে ছুট লাগলাম সন্ন্যাসীর দিকে পড়িমরি করে। মোক্ষম সময়ে ওনাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে না দিতে পারলে কিছু একটা অঘটন হয়ে যেত। ঠিক এক হাত দূরে সাপটা আওয়াজ শুনে বালির উপর দিয়ে কিলবিল করে দ্রুত বেগে অদৃশ্য হয়ে গেল ওপাশের আবর্জনার মধ্যে।
বালির উপর বসে আছি আমরা দুজন। আচমকা আমার ধাক্কার বেগ সামলাতে না পেরে উনি পড়ে গেছেন মাটিতে। আমিও। ওনার স্নান করে আসা পরিষ্কার গায়ে এখন বালি লেগে।
আমি কি বলবো ইতস্তত করছি দেখে উনি বললেন, তুই আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য ঝুঁকি নিয়েছিস আজ। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে নতুন জন্ম দিয়েছিস তুই আমায়। তোকে আমি আশীর্বাদ করবো না। আমার প্রাণ বাঁচানোর বিনিময়ে তোকে একটা প্রাণ ফেরানোর মন্ত্র দেব। আমি এটুকুই দিতে পারি। নিবি?
আমি থতমত খেয়ে বললাম ,প্রাণ ফেরানোর মন্ত্র বলতে?
মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র। কেবল মাত্র একবারই ব্যবহার করতে পারবি তুই।
আমি ঘাড় নাড়ালাম।
ক্যামেরাটা অন করে সন্ন্যাসীর দিকে ধরলাম। উনি বারণ করলেন না।
তিনি তারপর বলতে থাকলেন এক অদ্ভুত গল্প। যার সত্যি মিথ্যে যাচাই করার কোনো ইচ্ছেই আমার জাগেনি আজ পর্যন্ত। বখতিয়ার খলজির নালন্দার সেই আক্রমণ থেকে পালিয়ে বাঁচা এক বৌদ্ধ ভিক্ষু হিমালয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন। তিনি ছিলেন নালন্দার গুপ্তবিদ্যার পুঁথিপত্র সংরক্ষণ বিভাগের প্রধান। যোগবলে নিজ দেহ সক্ষম রেখে তিনি তপস্যার মধ্য দিয়েই হিমালয়ের গুহায় দীর্ঘজীবন কাটিয়েছেন। সমাধিস্থ হবার আগে তিনি তার উপযোগ্য শিষ্যকে তার সারাজীবনের অর্জিত সম্পদ স্বরূপ গুপ্তবিদ্যাগুলো দান করে যান। সেই শিষ্যই এই সৌম্যদর্শন সন্ন্যাসী। যাকে আমি মৃত্যুর ছোবল থেকে ফেরাতে পেরেছি বলে তিনি আমায় তার গুরুর থেকে পাওয়া মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র দান করবেন। যেটা এরপর থেকে তিনি নিজে আর কখনো ব্যবহার করতে পারবেন না।
ল্যাপটপে রাখা আছে সেদিনের সেই ভিডিওটা। আজ অব্দি কাউকে জানাইনি। কাহনকেও না। কে জানে। হয়তো সন্ন্যাসীর কথা গুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল বলেই। হয়ত উনি জানতেন আমার সাথে এরকম কিছু হবে, তাই আমায় দান করেছিলেন। পৃথিবীতে সব কিছুই কি কোনো না কোনো উদ্দেশ্যেই ঘটে! আমরা টের পাইনা সেটা বেশিরভাগ সময় !
হেডফোন লাগিয়ে ভিডিওটা চালালাম।
“..যার প্রাণ ফেরাতে চাস। তার সাথে তোর জীবদ্দশায় সবচেয়ে গভীর স্মৃতিকে আহুতি দিতে হবে। তার বিনিময়েই ফিরবে প্রাণ।..”
তারপর দৃঢ় কন্ঠে সন্ন্যাসীর সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ।
বার তিনেক শুনলাম ভিডিওটা টানা। মন্ত্রের জায়গাটা ফরওয়ার্ড করে করে। কিছু জায়গা দুর্বোধ্য লাগে। প্রায় সারারাত ধরে মন্ত্রটা বার বার শুনে পুরোটা বুঝতে পারলাম। নোটপ্যাডের কাগজে মন্ত্রটা লিখে শেষ করলাম যখন, তখন পূবের আলো জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। এসবের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাদিনের ধকলের পর।
ঘুম ভাঙলো ভ্রমরের কান্নায়। বেলা গড়িয়েছে অনেক। ধড়ফড় করে উঠে ভ্রমরের জন্য দুধ বানালাম। কাল রাত থেকে ওর প্যান্ট পাল্টানো হয়নি। কি দশা করেছি আমি ওর এই কয় ঘন্টায়! কাহন কি বলবে আমাকে! ভ্রমরের এই খেয়াল রাখছি আমি! ভ্ৰমরকে খাওয়ালাম। চেঞ্জ করলাম। ওর সাথে খেললাম সারাটা দুপুর। ভ্ৰমর ঘুমিয়ে পড়লে উঠলাম। সকাল থেকে কাহনকে দেখিনি এখনো আমি।
একি সারাঘর ভর্তি লাল পিঁপড়ে কোথা থেকে এলো! দৌঁড়ে গেলাম। হ্যাঁ, বাথরুমের ভিতরেই পিঁপড়ের সার। কাহনের বাথটাবের মধুর চারধারে থিক থিক করছে লাল পিঁপড়ে। হায় ভগবান! এ কি জ্বালায় পড়লাম। স্নান খাওয়া মাথায় উঠলো আমার। সারা দুপুর ধরে হিট স্প্রে করে সব কটাকে নিকেশ করলাম। ঘর বাড়ি মুছে পরিষ্কার করতে করতে বিকেল হয়ে গেল। ফ্রিজে কাহনের রান্না খাবার দাবার যা কিছু ছিল গরম করে খেলাম। আজ রবিবার। কাহন আর আমি এই প্রথম আলাদা খাচ্ছি। কান্না পাচ্ছে খুব। যে করেই হোক কাহনকে আমায় ফেরাতেই হবে।
স্নান করে সন্ধ্যে বেলায় কাহনের কাছে আসলাম। কাহন একই ভাবে ঘুমাচ্ছে। কাহনের পারফিউমটা স্প্রে করলাম বাথরুমে। কাহন কাহন গন্ধ চারিদিকে। একটানা কতক্ষন বসে ছিলাম জানিনা। আমাদের একসাথে কাটানো প্রত্যেকটা মুহূর্ত মনে পড়ছিল। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না কাহন নেই। না উঠতে হবে। কাহনকে ফেরানোর বন্দোবস্ত করতে হবে।
আমার সাথে কাহনের সবচেয়ে স্মৃতিজড়ানো জিনিস বলতে প্রথমেই মাথায় এলো আমার লেখা বইটা। যেটাতে কাহনকে অটোগ্রাফ দিয়েছিলাম বইমেলার সেই সন্ধ্যায়। আমাদের প্রথম দেখার স্মৃতি। বইটা বের করে নিয়ে বাথরুমে আসলাম। আহুতি অর্থে এখানে ঠিক কি বলতে চেয়েছিলেন উনি। পোড়াতে হবে? বিনিময়ে ফেরত পাবো..তার মানে তোহ নষ্ট করতে হবে জিনিসটা! কিভাবে নষ্ট করবো আমি।
মোমবাতি জ্বালালাম। কাহনের সামনে বসে একাগ্র মনে ধ্যানে বসলাম। মন স্থির করবার চেষ্টা করছি প্রানপন। হচ্ছেনা। লক্ষ কোটি চিন্তারা ছেঁকে ধরছে আমায়। কি হবে যদি কাজ না হয় মন্ত্রে? কি হবে যদি প্রাণ না ফেরে কাহনের? প্রায় একঘন্টার যুদ্ধের পর মন একাগ্র করতে পারি। চোখ খুলি। মোমবাতিটা শিখাটা আমার নিঃশ্বাসে তিরতির করে কাঁপছে। কাগজে লেখা সেই মন্ত্রের দিকে তাকালাম। আমার অটোগ্রাফ করা কবিতার বইটার পাতাটা আগুনে ধরে উচ্চারণ করতে লাগলাম..
ওঁম হুম জুম স্বহ:
ওঁম ভূ ভূব: স্বহা ওঁম তৎসা ভির্তুরভরেন্যাম ভ্রায়ামবকম যজামহে ভার্গৌ দেবস্যা ধীমাহি সুগান্ধীম পুষ্টিবর্ধনাম ধিয় য়নাঃ প্র্যাচোদয়েত
উর্বরুকমিভ: বন্ধানামৃত্যো-মূর্শীয় মাৎমৃতাত
ওঁম স্বহ: জুম হুম ওঁম।।
পুড়ে ছাই হয়ে গেল পৃষ্ঠাটা। একমিনিট.. দুইমিনিট..চার.. কই কোনো পরিবর্তন দেখতে পারছিনা তো কাহনের মধ্যে! সেই একইরকম ভাবে ঘুমাচ্ছে ও। তাহলে কি আমি ভুল উচ্চারণ করলাম কিছু! নইলে কিছু হলোনা কেন!
আগুনের তাপে দরদর করে ঘামছি। সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই আমার। ফের আরো জোরে দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করতে লাগলাম..
ওঁম হুম জুম স্বহ:
ওঁম ভূ ভূব: স্বহা ওঁম তৎসা ভির্তুরভরেন্যাম ভ্রায়ামবকম যজামহে ….
কই এবারও হলোনা তো কিছু! পাগল পাগল লাগছে আমার। ফের পড়লাম। তাও হলোনা কিছু। তিনবার পড়লাম।
বইটা পুড়ে নিভে গেছে। স্রেফ কালো ছাই ভরা মেঝেতে। কাহন একই ভাবে ঘুমাচ্ছে। এবার উঠলাম। বেরিয়ে এসে এক্সস্ট ফ্যানটা চালিয়ে দিলাম বাথরুমের। জল ঢেলে পরিষ্কার করে দিলাম ছাইগুলো।
ভ্রমরকে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে একটা ভাবনা মাথায় এলো। কাহন আর আমার সবচেয়ে স্মৃতিপূর্ণ জিনিস তাহলে বইটা নয়! আমারই ভুল হয়েছে। অন্য কিছু নিশ্চয় হবে। সারাঘর তো ওর পছন্দের জিনিস ভর্তি করা। আমাদের এত এত ছবি। ফটোফ্রেম। জন্মদিনের উপহার। আমাদের এনগেজমেন্ট রিং। আরো কতো কি! এতো রাশি রাশি জিনিসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কোনটা! কি করে খুঁজে বের করবো আমি!
সারারাত জেগে ঘরের মধ্যে যত জিনিস পেলাম হাতড়ে হাতড়ে সব এক জায়গায় জড়ো করলাম। ছোট খাটো পাহাড় হয়ে গেল। আমার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার পর থেকে এই শনিবার দুপুরে ওর পরা নীল সিল্কের গাউন অব্দি। যা যা মনে করতে পেরেছি সব জড়ো করেছি। গোটা ঘর জুড়ে তোহ শুধু ওরই ছোঁয়া!
আজ আর শরীর দিচ্ছেনা। কাল থেকে শুরু করবো। প্রতিটা ছোট থেকে ছোটতোর জিনিস.. আমাদের যা যা আছে সব কিছু দিয়ে চেষ্টা করতে হবে আমায়।
শেষ পাঁচদিন ধরে চেষ্টা করেছি আমি। যা কিছু জড়ো করেছিলাম প্রত্যেকটা জিনিসকে উৎসর্গ করে মন্ত্রপাঠ করেছি আমি। কাহন জাগেনি। কাহন জাগছেনা। আমার স্নান নেই..খাওয়া নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চিনতে পারছিনা। একগাল খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চোখের নীচটা কালি পড়ে গেছে। ঘুম হয়না রাতে। সারাদিন কাঁদি। স্বপ্নে কাহনকে দেখেছি একদিনই মাত্র। আমি কাছে যেতেই ও ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে যায়। গোটা বাড়িটা একটা ধ্বংসস্তূপ যেন। মাটিতে পা ফেলার জায়গা নেই কোনো। কাহনের বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। ধরিনি। আমার ফোনও সাইলেন্ট করে রেখেছি। সোফাতে বসে ভ্রমরকে দুধ খাওয়াচ্ছি । ভ্ৰমরও চিনতে পারছেনা যেন আমাকে। কাঁদছে আজ কোলে নেবার পরেও। কাহনকে খুঁজছে ও। বুঝতে পেরেছি আমি।
– মা চলে আসবে তোহ সোনা। খুব তাড়াতাড়ি। আমি চেষ্টা করছি রে তোহ বাবু। খুব চেষ্টা করছি সারাদিন। কাঁদিস না সোনা। কাঁদিস না।
আমি আর পারছিনা। কি করবো আমি! আর কি জিনিস বাকি আছে যেটা আমি এখনো পাচ্ছিনা খুঁজে!
ভ্ৰমরকে ঘুম পাড়িয়ে গোটা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলাম। পাচ্ছিনা কিছু। মেঝেতে বসে পড়ে মাথা তুলে চেয়ে আছি উপরের দিকে তখন জিনিসটা চোখে পড়লো। একতারাটা! শান্তিনিকেতনের সেই একতারাটা !
কাহনের দেহে এতটুকুও বিকার হয়নি। মনে হচ্ছে যেন সোনার জলের নীচে ঘুমাচ্ছে অঘোরে। শুধু আমি ডাকলেই জেগে উঠে বসবে। সব ঠিক হয়ে যাবে আগের মতো।
খোদার কসম আমি আর জোর করবোনা আদর করা নিয়ে কখনো। আমি কিছু মনে করবোনা তুই আমার সাথে না ঘুমালে। বিশ্বাস কর আমি কোনো মনখারাপ করবোনা। শুধু একটি বার জেগে ওঠ লক্ষীটি। আর কিচ্ছু চাইনা আমার। আর কিচ্ছুনা। স্রেফ তুই চাই। স্রেফ তুই।
এই একতারাটাই তোর আর আমার শেষ স্মৃতি। আর সব কিছু নষ্ট করে দিয়েছি আমি। এই শেষ সম্বলটুকুতে ভর করে জেগে ওঠ কাহন। আমি মরে যাবো নইলে। আমি মরে যাবো।
চোখ মুছে শেষ বারের মতো আজ মোমবাতি জ্বালিয়ে বসলাম। আজ অন্যদিনের তুলনায় যেন তাড়াতাড়িই মনস্থির হলো। প্রচন্ড বিশ্বাসে মন্ত্রের প্রত্যেকটা শব্দ আওড়াতে থাকলাম। একতারার খোলটাতে আগুন ধরে উঠলো। টং করে তারটা ছিঁড়ে ছিটকে গেল কিছুক্ষনের মধ্যে। গোটা একতারাটা পুড়ে ছাই হবার সাথে সাথে নিভে গেল আমাদের একসাথে কাটানোর সব স্মৃতি। সব ভালোবাসা। সব প্রেমের পাথরফলক। চোখ বুঁজে বার বার মন্ত্রোচ্চারণ করার পর চোখ খুললাম একবুক আশা নিয়ে। বাথটাবের মধ্যে ঝুঁকে পড়ে কাহনকে ডাকতে থাকলাম পাগলের মতো।
কাহন কাহন আর কত ঘুমাবি ওঠ।
কাহনের মাথা দুহাতে তুলে ঝাঁকাতে লাগলাম। আঙ্গুল দিয়ে ওর চোখের পলক জোর করে খোলার চেষ্টা করলাম। মরা মাছের মতো শীতল চোখ। বরফের মতো ঠান্ডা সারা শরীর। কিচ্ছু পরিবর্তন হয়নি। কিচ্ছু না।
চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। মেঝেতে বসে হাসছি। সারা গা ছাইয়ে মেখে একাকার হলো। সব শেষ। সব। সব।
আমায় ঠকাল সন্ন্যাসী! সব মিথ্যে তাহলে! এই মৃতসঞ্জীবনী মিথ্যে! ওনার জীবন বাঁচানোর মূল্য তাহলে মিথ্যে সব। হা হা হা। উফফ..
আমি কি মরবো তাহলে? সুইসাইড করবো? মরলে কাহনের সাথে একসাথে থাকতে পারবো তাহলে। লোকে তো তাই বলে। মরার পর একসাথে থাকতে পারে সবাই। তাই করি তাহলে। কি দিয়ে সুইসাইড করা যায় ! দড়ি? গলায় দড়িটায় বেস্ট হবে। উঠি। দেখি কোথায় আছে দড়ি। খুঁজতে লাগলাম সব জায়গায়। নেই। মরতেও পারবোনা নাকি!
শাড়ি আছে না কাহনের ! শাড়ি পেঁচিয়েও তোহ কাজ হতে পারে। হ্যাঁ তাই তো! কাহনের ঘরে গেলাম। আলমারি ফাঁকা। কিচ্ছু নেই। কোথায় শাড়ি! সব কিছু তোহ পিন্ডি চটকেছি এই কয়দিন। সব বস্তা পুরে পুরে নীচের ভ্যাটে ফেলেছি। কোনো চিহ্ন নেই কাহনের সারা বাড়িতে আর। মেঝেতে শুয়ে কাঁদতে লাগলাম।
অ্যান আই ফর অ্যান আই। চোখের বদলে চোখ। তাহলে প্রানের বদলে প্রান !
নিষ্প্রাণ জিনিসের বিনিময়ে এতদিন প্রাণ ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করেছি। কি মারাত্মক বোঝার ভুল আমার। ঠিকই তোহ। সারা বিশ্ব সমতাবস্থায় চলছে। সব কিছুই ব্যালান্সড। কাহনের প্রাণ আমি নিয়েছি। কাহনের প্রাণ ফেরত আনতে তোহ আরেকটা প্রাণ উৎসর্গ করতে হয়। সোজা অংকের হিসেব। দুদিক থেকেই সাম্য থাকবে। কি বোকার মতো এইদিন আমি এই সব জিনিসপত্র শেষ করলাম। তাই মন্ত্র ফলেনি। আমার এই ভুলে ফলেনি।
আমার আর কাহনের সবচেয়ে বড় সংযোগ তোহ ভ্ৰমর। ভ্রমরই কি তাহলে কাহনকে পাওয়ার চাবিকাঠি?
ভ্ৰমর ঘুমাচ্ছে। আমি আস্তে করে কোলে তুলে নিলাম ওকে। বাথরুমে আসলাম। মা মেয়ে দুজনেই ঘুমাচ্ছে। হাঁটু মুড়ে বসলাম কাহনের পাশে। ভ্ৰমরকে দু হাতে ধরে শেষবারের মতো আমার সবটুকু শক্তি বিশ্বাস দিয়ে উচ্চারণ করলাম…
ওঁম হুম জুম স্বহ:
ওঁম ভূ ভূব: স্বহা ওঁম তৎসা ভির্তুরভরেন্যাম ভ্রায়ামবকম যজামহে ভার্গৌ দেবস্যা ধীমাহি সুগান্ধীম পুষ্টিবর্ধনাম ধিয় য়নাঃ প্র্যাচোদয়েত
উর্বরুকমিভ: বন্ধানামৃত্যো-মূর্শীয় মাৎমৃতাত
ওঁম স্বহ: জুম হুম ওঁম।।
ওঁম হ্রুম হ্রুম ভম ভম অম অম মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যে মৃতমুথ্যাপয়োত থাপায়: ক্রিম হ্রিম ভম স্বহা:
শেষ স্তবকটা উচ্চারণ করতে করতে ভ্রমরের ছোট্ট শরীরটা চুবিয়ে দিলাম মধুর মধ্যে। কাহনের বুকের উপর চেপে ধরলাম। ভ্রমরের ছোট্ট হাতটা আমার বুড়ো আঙ্গুলটাকে চেপে ধরেছে। ছোট্ট ছোট্ট বুদ্বুদ নীচ থেকে উপরে উঠে আসছে। সারা বাথটাবের মধু আন্দোলিত হয় ভ্রমরের হাত পা ছটফটানোর দরুন। আস্তে আস্তে ওর মুঠোটা আলগা হয়ে এসে আমার বুড়ো আঙুল থেকে খসে যায়। শেষ বুদ্বুদটুকু মিলিয়ে যায় বাতাসে। ভ্ৰমর মায়ের বুকে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি এখনো চিৎকার করে পাঠ করছি,
ওঁম হ্রুম হ্রুম ভম ভম অম অম মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যে মৃতমুথ্যাপয়োত থাপায়: ক্রিম হ্রিম ভম স্বহা:
আচমকা বাথটাবের মধ্যে সমস্ত মধু তোলপাড় করে উঠে বসে কাহন। কি ভয়ানক হাঁপাচ্ছে ও। জোরে জোরে দম নিচ্ছে।
হে ঈশ্বর! তুমি আছো। তুমি আছো।
আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করে কাহনকে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু এক ঝটকায় আমাকে ছিটকে ফেলে দিলো কাহন। ওর দুচোখে অচেনা দৃষ্টি। অস্থির ভাবে চারিদিকে তাকাচ্ছে। নিজের বুকের দিয়ে চেয়ে আঁতকে ওঠে। হাত দিয়ে কোনো রকমে বুক ঢাকে।
– কোথায় আমি?
– এই তোহ বাড়িতে কাহন। আমি তোকে ফিরিয়ে এনেছি কাহন। আয় কাহন।
– কে আপনি। আমি চিনিনা আপনাকে। আমার সারা গায়ে জামাকাপড় নেই কেন? কোথায় আমি।
– কাহন তুই চিনতে পারছিসনা! আমি শাক্য। তোর বর। তুই আমার বউ কাহন।
– না আমি তোহ বিয়ে করিনি কাউকে। কে আপনি। এটা কি!
ভ্রমরের ছোট দেহটা ভেসে উঠেছে কাহনের কোলের কাছে। চিৎকার করে ওঠে কাহন। তারস্বরে চিৎকার করতে করতে বাথটাব থেকে নামে কাহন। সারা শরীর থেকে মধু গড়িয়ে পড়ছে টপটপ করে। দুই চোখ বিস্ফারিত।
আমি কাহনকে জড়িয়ে ধরতে গেলে ও ছিটকে সরে যেতে গিয়ে মধুতে পা হড়কে পড়ে যায়। সেই অবস্থাতে উঠে দাঁড়িয়ে কোনোরকমে হেঁচড়ে হেঁচড়ে দড়াম করে দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায় কাহন।
শিশুকন্যা হত্যা আর কাহনের উপর শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের দায়ে আমার সাত বছরের জেল হয়েছে। কাহনের বাড়ির লোক অভিযোগ দায়ের করেছে । আমি কিছু বলিনি। কোর্টে কাহন এসেছিল। আমাকে চেনেনি।কাহনের আমার কথা মনে নেই কোনো। ডাক্তার বলেছে শর্ট ফেজ মেমোরি লস হয়েছে ওর। কাউন্সেলিং চলে ওর এখন নিয়মিত। আমি জানি , আমি নিজে আমাদের সব স্মৃতি ওর মাথা থেকে মুছে দিয়েছি একটা একটা করে সব জিনিসগুলো নষ্ট করে। তাই ও আমায় চিনতে পারেনি বেঁচে উঠে। ভ্রমরকেও চিনতে পারেনি।
এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, ভ্রমরকে শুরুতেই নিবেদন করলে হয়ত সব কিছু একই রকম থাকতো। কোনো স্মৃতি নষ্ট হতো না কাহনের। আমার একটু ভুলের জন্য সব তছনছ হয়ে গেল। ভ্রমরকে মধুতে চুবিয়ে মারার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে আমায় সারাটা জীবন। প্রতিটা রাতে গুমরে গুমরে কাঁদি আমি। ভ্ৰমর স্বপ্নে আসে। ভ্রমরের ছোট্ট হাতটা টের পাই। শেষবারের মতো আমার বুড়ো আঙ্গুলটা ও ওর সব শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে। যখন ও টের পায় বাবা আর উপরে টেনে তুলবে না ওকে , তখন ও মুঠোটা আলগা করে দেয়। সরিয়ে নেয় নিজের ছোট্ট হাতটুকু।
বাবা তুমি আমাকে মেরে ফেললে?
এখন সাত বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা। তারপর..
কাহন কি ফের নতুন করে প্রেমে পড়বে আমার, আরেকবার.. বইমেলায়?
(সমাপ্ত)
© সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত