সালাহউদ্দিন সুমন (সাংবাদিক, যমুনা টেলিভিশন)
২০ মে ২০২০, কালো এক রাতের সাক্ষী হয় দুই বাংলার কয়েক কোটি মানুষ। সুপার সাইক্লোন আম্ফানে বিধ্বস্ত হয় পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল সহ উত্তর পশ্চিমের বেশ কিছু জেলা। পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ৭২ জনের মৃত্যু, বাংলাদেশে সংখ্যা টা ১৬। সরকারী হিসেবে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় অম্ফানের তাণ্ডবে প্রাথমিক ক্ষতির সাড়ে এগারোশ কোটি টাকা। সুন্দরবন উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ, রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট সহ অবকাঠামোর পাশাপাশি ঘরবাড়ি, কৃষি এবং চিংড়ি ঘের সহ মাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বিদ্যুতহীন হয়ে পড়ে দেশের ২৫টি জেলায় প্রায় দেড় কোটি মানুষ। দক্ষিণ পশ্চিমের বিভিন্ন জেলায় পানের বরজ থেকে শুরু করে রাজশাহীতে মৌসুমী ফল আম এবং উত্তরের অন্য জেলা গুলোয় ধান এবং সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে আম্ফানের এমন ক্ষতি ছিল মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। তবে উপকুলের যোদ্ধারা বসে থাকার পাত্র নন। তাদের জীবনের আশীর্বাদ হয়ে আসে স্বেচ্ছা শ্রম। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মহতপ্রাণের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলো। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা শ্যামনগরে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। কগজ-করমে গোটা বিশেকের হিসেব থাকলেও অনিবন্ধিত রয়েছে কয়েকশ। ফলে বৈশ্বিক মহামারির মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উপকূলের আসহায় মানুষের পাশে দাড়ায় তারা। ঝড়ের আগে থেকে শুরু হয় তাদের মানুষকে সতর্ক করার কার্যক্রম। একই সাথে চলে ক্ষতিগ্রস্ত ভেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সিডিও’র প্রতিষ্ঠাতা গাজী ইমরান বলেন “আমরা সব সময় মানুষের কল্যানে কাজ করে যাচ্ছি। সাধ্যের মধ্যে যেখানে যতটুকু প্রয়োজন আমাদের সংগঠ তা করে যাচ্ছে। আমাদের কার্যক্রম শুধু ত্রানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর ব্যপ্তি ছড়িয়েছে মজবুত উন্নয়নের পথে। বৃক্ষ রোপন থেকে শুরু করে খাদ্য সরবরাহ, চিকিৎসা সেবা, ভেড়িবাঁধ নির্মান, স্বচেতনতা বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন কার্যক্রম। সিডিও ছাড়াও কোভিড ৯ এর প্রাদুভাবের মধ্যে প্রতিনিয়ত জীবন বাজী রেখে কাজ করে যাচ্ছে ছোট বড় অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।”
ঘুর্ণিঝড় বুলবুলের চেয়ে সুপার সাইক্লোন আম্ফানে সুন্দরবনে ক্ষতি হয়েছে ৩ গুণ বেশি।আম্ফানে ভেঙ্গে যায় সুন্দরবনের প্রায় সাড়ে ১২ হাজার গাছ। বন বিভাগের হিসেবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে সুন্দরবনের ৪ হাজার ৫৮৯টি গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ঝড়ের পর দিন নোন জলে নিমজ্জিত উপকুলে দেখা দেয় তীব্র পানীয় জলের শঙ্কট। প্রশাসনের পাশাপাশি এগিয়ে আসে হৃদয়বান মানুষ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলো। কোভিডের প্রভাবে কমে যায় বিশেদী এনজিও গুলোর তৎপরতা। এগিয়ে আসে কিছু সংখ্যক স্থানীয় এনজিও। তবে সবচেয়ে চোখে পড়ার মত ছিল স্বেচ্ছাসেবীদের অবদান। ঝড়ের রাত থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বদলেছে স্বেচ্ছাসেবীদের কাজের ধরণ তবে থেমে থাকেনি মানব সেবা। আপদকালীন সংকট মোকাবিলা শেষে এখন কেউ কেউ করছে দূর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি। করছে সামাজিক বনায়ন।
এতো গেল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলোর অবদান। এবার আসা যাক এক ক্রিকেটের পাগল ভক্তের কথায়। বাংলাদেশের আইকনিক ক্রিকেট ফ্যান টাইগার শোয়েব বা শোয়েব আলি। গত ঈদ-উল ফিতরের পর থেকে এখন পর্যন্ত নিভৃতে উপকুলে কাজ করে যাচ্ছেন।
রিতিমত সুন্দরবন উপকূলে আটকে পড়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের আইকনিক ফ্যান টাইগার। সুন্দরবনে বাঘের ভয়ে উপকুল কাঁপলেও সেই বাঘই এখন ত্রাতা, ঘুর্ণিঝড় আম্ফান বিধ্বস্ত উপকুলের মানুষের জন্য। বলছি ,বাংলাদেশের ক্রিকেটের আইকনিক ফ্যান টাইগার শোয়েব বা শোয়েব আলির কথা। ক্রিকেটের টানে মিরপুর থেকে লর্ডস সাকিব-তামিম-মাশরাফীদের উৎসহ দিয়েছেন এশিয় থেকে ইউরোপ। ৭ সমুদ্র পাড়ি দেয়া টাইগার শোয়েব ক্রিকেটের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় যায়গা করে নিয়েছিলেন অনেকের মনে। এবার মন জয় করলেন দক্ষিনাঞ্চলের মানুষের, তবে ক্রিকেট নয় মানবতার ফেরিওয়ালা হয়ে। পেশায় একজন মটর মেকানিক হলেও করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে ঢাকার রাজপথে অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়ে ছিলেন ক্ষুধা নিবারনে। আর ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আঘান হানে উপকুলে। প্রাণ হানি না হলেও বসত ভিটা ও সম্পদের ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয় দক্ষিনে জনপদে। সর্বস্ব হারিয়ে অনেকেই দিন কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে, কারো কারো ঘর থাকলেও তা নিমজ্জিত নোন জলে । অসহায়ের পাশে দাড়াবার মত অর্থ না থাকলেও টাইগার শোয়েবের আছে আকাশের মত বিশাল মন। ঢাকা থেকে তাই মানবতার কল্যানে উপকুলের পথে পাড়ি জমান শোয়েব। তলিয়ে যাওয়া গ্রাম গুলোয় শোয়েব চেষ্টা চালিয়ে যান অসহায়ের ক্ষুধা নিবারনের। খুলনা ও সাতক্ষীরার দুই জেলার সুন্দরবন উপকুলে চষে বেড়ান টাইগার। কখনও সাতক্ষীরার শ্যামনগর, প্রতাবনগর ও চাকলা, আবার কখনও খুলনার কয়রা উপজেলার হরিনখালিতে গলা জলে খাদ্য নিয়ে ছুটেছেন তিনি। খুজে খুজে ঠিকই বের করেছেন কার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন খাদ্য, পানীয় জল কিংবা জরুরী ঔষুধের। এই ভাবেই টাইগার শোয়েব নিজেকে নিয়োজিত করেছে মানব সেবায় । ক্রিকেটের আইকনিক ফ্যান হয়েও আজ তিনি অনেক মানুষের কাছেই এক নতুন পথের দিশারী ।আর এবাভেই বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবাসীর ঘুরে দাঁড়ানোর উপাখ্যান।