দেবারুণ রায়
জাদুকর গেহলোতের নিখুঁত ম্যাজিকে মাঠে মারা যাচ্ছে বিজেপির গণেশ ওল্টানোর গেম। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গজেন্দ্রসিং শেখাওয়াতের সঙ্গে শচীন সঙ্গীদের গোপন কথার রেকর্ড আগে অস্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত সত্যি বলতে বাধ্য হয়েছে বিজেপি। পরিস্থিতি এতটাই ল্যাজেগোবরে। এখন কেন্দ্রের বিজেপি নেতারা আইন ও নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে বলছেন, আঁড়ি পাতা কতখানি খারাপ। সুতরাং রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলোত প্রথম দানে তরুণতুর্কি তিরন্দাজ শচীনের গ্ল্যামারে মাত হলেও খেলাটাকে শেষ পর্যন্ত ঘুরিয়ে দিয়েছেন তুখোড় চালে। আর বিজেপির বিধি এতটাই বাম যে বাজিকর গেহলোতের বাজির ঘোড়া হয়ে উঠেছেন গেরুয়া শিবিরের মাথা খোদ বসুন্ধরা রাজে ।
রাজ্য রাজনীতিতে গেহলোতের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বসুন্ধরা। তাঁর সরকারকে ভোটে হারিয়েই ক্ষমতায় এসেছেন তিনি। বসুন্ধরাই রাজস্থানে বিজেপির মুখ। এবং গোয়ালিয়রের রাজপরিবারের কন্যা ও জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার পিসি। তাঁর ও তাঁর সহোদরা যশোধরার যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেই জ্যোতিরাদিত্যকে দলে টানে বিজেপি। কিন্তু বিজেপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গোয়ালিয়রের প্রয়াত রাজমাতা বিজয়ারাজে সিন্ধিয়ার রাজনৈতিক প্রভাব, আঞ্চলিক জনপ্রিয়তা এবং সম্পূর্ণ সামর্থ্য ও অর্থবলের সুবাদেই রাজস্থান ও উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ হিন্দি বলয়ে পা রাখার জমি পায় বিজেপি। শুধু তাঁর একমাত্র ছেলে মাধবরাও ছাড়া সিন্ধিয়া পরিবারের প্রত্যেকেই বিজেপিতে আসেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর একমাত্র বংশধর জ্যোতিরাদিত্যও কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপি তে ভিড়ে মধ্যপ্রদেশের কমল সরকার উল্টে দেন। সেই পরিবারের সবচেয়ে বরিষ্ঠ জীবিত সদস্য বসুন্ধরা বেঁকে বসেছেন।
এবং রীতিমতো রুদ্রমুর্তি তাঁর। শচীন পায়লটের ” পাঁয়তারা “-য় দলকে পাত্তা দিতে আগাগোড়া বারণ করে এসেছেন বসুন্ধরা রাজে। কারণ বিপুল
উচ্চাকাঙ্ক্ষী শচীনের শেষ টার্গেট যে তিনি, একথা বুঝতে বাঁকি নেই মধ্যপ্রদেশের রাজকন্যে এবং রাজস্থানের রানিমার। তিনি জানেন অনগ্রসর গুজরদের নেতা শচীনের জাতপাতের জ্যামিতি টা জম্পেশ। কারণ কাশ্মীরের নেতা ডা.ফারুক আবদুল্লাহর মেয়ে ও ওমরের বোন তাঁর স্ত্রী। সুতরাং শচীন গেরুয়া শিবিরের নেতা হলে দুর্লভ সংখ্যালঘু ভোটের শিকেও কিছু টা ছেঁড়ার আশায় বিজেপি তাঁকে ব্যবহার করবে। ফলে জাঠ রাজঘরানার রানি ও মারাঠা রাজপুতের মেয়ে হিসেবে জাঠ আর উচ্চ বর্ণের ভোটের সমীকরণের জন্য তাঁর কৌলীন্য আর তেমন কদর পাবেনা। তাছাড়া বয়সের কারণে তাঁকে সরতে হবে যখন , তখন তাঁর উত্তরাধিকারী হতে বাধা থাকবেনা ছেলে দুষ্মন্তর। এই পরিবারের পরিচিতির খাতিরেই দুষ্মন্ত লোকসভায় জেতেন। কিন্তু শচীন বিজেপিতে এলে সেই বাড়াভাতেও তো ছাই পড়বে।
বিশেষ করে গেহলোতের বিরুদ্ধে শচীনের বিদ্রোহের রকমসকম দেখে আরও সতর্ক বসুন্ধরা। সুতরাং বিজেপির মুখ হয়েও তিনি কংগ্রেসের সরকার ফেলতে চান না। ম্যাজিসিয়ান গেহলোত আঁচ করেছিলেন এমনটাই। তাছাড়া কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা দিগ্বিজয় সিংয়ের সঙ্গে বসুন্ধরার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব বহুকালের। কেন্দ্র থেকে রাজ্য সর্বত্রই দুজনে দুই মেরুতে নেতৃত্ব করেছেন। কিন্তু বন্ধুত্বে তার আঁচ লাগেনি। দুজনেরই সংকটকালে রাজস্থানের রাজনীতির নেপথ্যকাহিনি এভাবেই নিত্যনতুন নাটকের জন্ম দিচ্ছে। ক্লাইম্যাক্স হল, বসুন্ধরা গেহলোতের নেতৃত্ব ও সরকার বাঁচাতে কোমর বেঁধে নেমেছেন। “মারি অরি পারি যে কৌশলে” , এই রণনীতিতে বসুন্ধরা ও গেহলোতের গোপন বোঝাপড়ার ফল ফলতে শুরু করেছে। কংগ্রেসি পেন্ডুলামদের জনে জনে ফোন করছেন রানিমা। বলছেন, গেহলোতের সরকার টিকিয়ে রাখলেই আখেরে তোমাদের ফায়দা। খাল কেটে কুমীর ঢুকিওনা। শচীনের সঙ্গে গেলে আর ভোটে জিততে হবেনা। আর হেরে গেলে তো টিকিট দেবই না আমরা। কংগ্রেসে ভিতরঘাত করছে যারা তারা কাল আমার দলেও একই কাজ করবে। তাছাড়া তোমরা যাদের হারিয়ে জিতেছ, আগামী ভোটে তারাই তো বিজেপির প্রার্থীপদের হকদার। কিসের জন্য তাদেরকে সরিয়ে শচীনের সঙ্গীদের বিধায়ক করবে বিজেপি। বসুন্ধরা অবশ্য এই নেপথ্যকাহিনি স্বীকার বা অস্বীকার কিছুই করেন নি। তিনি শুধু বলেছেন, আমি দলের শৃংখলাবদ্ধ সৈনিক। দলের স্বার্থরক্ষাই আমার কাজ। যদিও শচীনের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও জাতপাত রাজনীতির সমীকরণজনিত সম্পর্ক এতটাই তিক্ত যে মুখ্যমন্ত্রী করা তো দূর, ওঁর হাতে দল তামাক খাক এটাই চান না প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তেমন পরিস্থিতি হলে চরম সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আর পথ থাকবেনা, একথা জানিয়েও দিয়েছেন দলকে। তাঁর এই রণং দেহী রণনীতির পাশে আছে বিজেপি পরিষদীয় দল এবং তার জাঁদরেল নেতা গুলাবচন্দ কাটারিয়া। বসুন্ধরা ও কাটারিয়াকে বাদ দিয়ে রাজস্থানে বিজেপির অভিভাবক সঙ্ঘ এক পাও ফেলেনি কোনওদিন । ভৈরোঁ সিং শেখাওয়াতের হাতে গড়া মেবার থেকে মারবারের দলীয় ভিতের ওপরে বসুন্ধরার মত ব্র্যান্ড বিজেপি নেত্রীকে দাঁড় করিয়েছে সঙ্ঘ, সেই হাজার টাকার বাগানের মালিকানা পাবে সঙ্ঘের রাজনীতি ও সংস্কৃতির আগাগোড়া উল্টো পথের পথিক কোনও কংগ্রেসি , এমন ঘটনার নজির কই ? আর আঞ্চলিক দলের নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী করে সরকার গড়ার মত মরুভূমি নয় হিন্দুত্বের ধ্বজ শোভিত রাজস্থান।
এমন পরিস্থিতিতে বিজেপির শিবিরে যারা মধ্যপন্থী হয়ে দুদিক থেকেই মধু খেতে চান তারা শচীনকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, অন্তত ২৫ | ২৬ জন কংগ্রেস বিধায়ক সঙ্গে না আনলে কোনও লাভ নেই। বুঝিয়ে দিয়েছেন, শুধু শুধু শচীনকে মুখ্যমন্ত্রী বানিয়ে বিজেপির কী লাভ ? গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আগুনে ঘি তো দেওয়াই হল। এবার ওরা নিজেরাই ওতে পুড়বে। কিন্তু সংখ্যা ছাড়া মানে ছন্নছাড়া কাউকে নেতা বানানোর মানে হল, অন্যের বাড়ির ঘরোয়া কোঁদলের আগুন নিজের বাড়িতে নিয়ে আসা। লঙ্কা দহনের পর হনুমানজি তো রামজীকে জিতিয়ে ছিলেন। আর বিভীষণই বাৎলেছিল রাবণের মৃত্যুবাণের কথা।
আপাতত রাজস্থানি রামায়ণে বিচ্ছিরি বেকায়দায় কংগ্রেসের বিভীষণ।