স্পেসটাইম ও মহাকর্ষ

0
97

ডঃ অনিন্দ্য দাস

মহা বিশ্বকে যদি একটি প্রসারনশীল বেলুন ভাবা যায়, তবে আমরা বা আমাদের সৌরজগত ও মিল্কিওয়ে সহ বহু গ্যালাক্সি উহার উপরিতল বরাবর অবস্থান করছে। বিজ্ঞানী হাবল 1920সালে পর্যবেক্ষন করেন বিভিন্ন দূরবর্তী গ্যালাক্সি ও নক্ষত্র থেকে যে আলোকরশ্মি পৃথিবীতে এসে পৌঁছায় তাতে রেডশিফ্ট বা লাল তরঙ্গের আলো পাওয়া যায়। কোনো আলোর উৎস ক্রমাগত দূরে সরে গেলে ডপ্লার এফেক্ট অনুযায়ী এরকম হওয়ার কথা। এথেকে সিদ্ধান্তে আসা যায় গ্যালাক্সীগুলি পরস্পর দূরে সরে যাচ্ছে। তবে পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা দেখেন গ্যালাক্সীগুলি তাদের হিসেবের থেকেও দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে। তাহলে কোন শক্তির প্রভাবে এই অতিরিক্ত গতি? তখন তারা ডার্ক এনার্জির হদিশ পেলেন। আধুনিক বিজ্ঞানের অদেখা এই প্রকল্পিত ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটার ব্রম্হান্ডের 95% দখল করে আছে! অর্থাৎ ব্রম্হান্ডে শূন্যস্থান বলতে কিছু নেই।

যদি কোনো বিন্দু থেকেই ব্রম্হান্ডের জয়যাত্রা বা ইভোলিউশন শুরু হয়, তবে বলা যায় ওই বিন্দুর কোনো ডাইমেনশন ছিলো না। মহাবিস্ফোরনের ফলে তিনটি ডাইমেনশন দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও উচ্চতা সৃষ্টির সাথে যোগ হলো নতুন চতুর্থ ডাইমেনশন সময়। এভাবে কসমিক ওয়াচ টিক টিক করে চলা শুরু করলো। স্থান ও কালের সমন্বয়ে গঠিত হলো বহুল চর্চিত স্পেস টাইম। আমরা পদার্থবিদ্যার সাধারন জ্ঞানে নিউটনের তত্ত্ব অনুযায়ী জানি gravity বা মহাকর্ষ বলের প্রভাবে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। কিন্তু আইনস্টাইনের মত অনুযায়ী পৃথিবী ও সূর্যের ভর দ্বারা স্পেস টাইমে সৃষ্ট বক্রতার কারনে পৃথিবীর এই ঘূর্নন সম্পন্ন হয়। স্পেস টাইম অনুযায়ী শুধু স্পেস বা শুধু টাইম অর্থহীন। যেমন ধরুন আপনি আপনার গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ডকে বললেন ২০জানুয়ারি ৫টার সময় দেখা করবেন। এক্ষেত্রে স্থান বলাটা খুব জরুরী, আবার যদি কেবলমাত্র স্থান যথা পার্ক হোটেল বললেন সময় না বললে সেটাও অর্থহীন। একইভাবে সময়ের একমুখী মাত্রা ব্যতীত শুধু ত্রিমাত্রিক স্থান ব্রম্হান্ডে অর্থহীন। সৃষ্টি যদি বিগব্যাং ধরা হয় তারপর থেকে এই স্পেসটাইম চারটি মাত্রা নিয়ে যে বক্রতা প্রাপ্ত হয় তা ক্রমপ্রসারমান। তাই স্পেসটাইম বরাবর পিছনে গেলে এর সংকোচন একটি বিন্দু বা সিঙ্গুলারিটিরই ইঙ্গিত বহন করে।

আইনস্টাইনের মত অনুযায়ী, মহাবিশ্বে আলোর গতি একমাত্র ধ্রুবক এবং কোনো বস্তু আলোর সমান গতি লাভ করিতে পারে না। দ্বিতীয়ত সময় নামক মাত্রাটি একমুখী হওয়ায় ধরে নেয়া যায় স্পেস টাইম বরাবর পেছনে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই টাইম ট্রাভেল কল্পবিজ্ঞানে সম্ভব হইলেও বাস্তবে অসম্ভব ধরা যাইতে পারে। কিন্তু স্থান কাল আপেক্ষিক। সবথেকে মজার বিষয় আলোর গতির কাছাকাছি কোনো মহাকাশযান বানানো সম্ভব হইলে উহার আরোহীর কাছে ভূপৃষ্ঠ অপেক্ষা সময় ধীরে চলিবে। একারনেই স্পেস স্টেশনে সময় পৃথিবী অপেক্ষা কয়েক ন্যানোসেকেন্ড মন্থর। অর্থাৎ স্পেস বরাবর দ্রুত গতিতে চলার অর্থ সময় বা টাইম বরাবর ধীরে চলা! অপরদিকে আলোর গতির 10% গতিতে কোনো বস্তু ধাবিত হইলে উহার ভর পৃথিবী অপেক্ষা 0.5%বৃদ্ধি পায়। আলোর গতির 90% গতিপ্রাপ্ত হলে উহার ভর পৃথিবীতে উহার ভর অপেক্ষা দ্বিগুন হয়। এভাবে উহার গতি যতো আলোর গতির কাছাকাছি হয়, উহার ভর ততো দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে, ফলে উহার গতি বৃদ্ধি করিতে প্রয়োজনীয় শক্তির পরিমান বাড়িতে থাকে ও অসীম হইয়া যায়। একারনে নিজস্ব ভরযুক্ত কোনো বস্তু আলোর গতিপ্রাপ্ত হয়না। কেবলমাত্র আলো বা অনুরূপ কোনো তরঙ্গ যাহার নিজস্ব ভর নেই উহাই আলোর গতি প্রাপ্ত হইতে পারে।

এবার আসা যাক স্পেসটাইম বা স্থানকালের আরও আকর্ষণীয় আলোচনায়। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা জানি মহাবিশ্বে পার্থিব বা মহাজাগতিক যে কোনো দুটি বস্তুর মধ্যে এক রহস্যময় আকর্ষন বল ক্রিয়া করে। একে মহাকর্ষ বল বলে। নিউটন এর উৎপত্তি ব্খ্যা করতে পারেননি। আইনস্টাইনের মতে অভিকর্ষ কোনো তথাকথিত বল নয়। এখন কথা হলো তবে পৃথিবী সূর্যের চতুর্দিকে ঘোরে কিভাবে? আমরা স্পেসটাইমকে কোনো চাদরের সাথে তুলনা করলে বলতে পারি, নির্দিষ্ট ভর স্পেসটাইমে বক্রতা সৃষ্টি করে। সূর্যের দ্বারা সৃষ্ট এরকম বক্রতার মধ্যে গ্রহগুলি থাকায় উহারা সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। তাই সূর্য কখনো হঠাৎ করে অনুপস্থিত হলে এই বক্রতায় যে আলোড়ন বা অস্থিরতা তৈরী হবে তার প্রভাবে পৃথিবী কক্ষচ্যুত হবে।

স্পেস টাইম চাদরের বক্রতা বরাবর আলোকরশ্মিও চালিত হয়। টাইম স্পেসে আলোক রশ্মি ভর দ্বারা সৃষ্ট বক্রতা দ্বারা দুটি বিন্দুর মধ্যে সর্বাপেক্ষা সংক্ষিপ্ত পথে চালিত হয়, এই পথকে জিওডেসিক বলা যেতে পারে। আলার এই বক্রপথে গমনের কারনেই কখনো কখনো ব্ল্যাকহোলের আড়ালে অবস্থিত কোনো নক্ষত্র আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। সূর্যগ্রহনের সময়ও সূর্যের আড়ালে থাকা নক্ষত্র ভিন্ন অবস্থানে আমরা দেখে থাকি।

এভাবেই আইনস্টাইনের তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানে আমাদের প্রচলিত ধ্যানধারনা সম্পূর্ন বদলে দিয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here