স্বরূপ চক্রবর্ত্তী
ব্ল্যাক মিস্ট্রি মেলেনিস্টিক লেপার্ড।
জরুরি নয় যে সবাইকেই দেখতে হবে। ডানডেলি ফরেস্ট পেয়েছিলাম। ক্যামেরা ধরতে পারেনি। সম্ভবও ছিল না। ছবিগুলি গিফট দিলেন বনরক্ষক এন্টোনি মুরুগান। সংবাদপত্রের মানুষ জেনে সমস্ত রকম সহায়তা করেছিলেন। তাঁকে ধন্যবাদ। ডানডেলি ফরেস্টেই কালো চিতার বসবাস। মেটিং টাইমে এরা বেরিয়ে আসে আঁধার ছেড়ে, আধা আঁধারিতে। তখন এরা সাংঘাতিক খতরনাক!সময়টা সেপ্টেম্বরের শুরু নইলে নভেম্বরের শেষ।
অনুরোধ করবো কালো চিতা দেখতে কেউ আসবেন না। কারণ, ও খুব কপালে মেলে। এগারো দিন ছিলাম। মিলেছিল। সঙ্গে ছিল অল্টারনেট করে দুই বনরক্ষী। ফলে বাফারজোনে তো পাবেনই না, পেলে পেতে পারেন কোর জোনে। তবে, আশায় বাঁচে চাষা।
কিভাবে গেলাম :নয়াদিল্লি -গোয়া একটা ট্রেন আছে। প্রায় ছত্রিশ ঘন্টা জার্নি। বেলাগাম নেমে বাসে ৪৫ মিনিট বাসে যেতে হবে। কুভোসি নামতে হবে। ওখান থেকে শুরু জঙ্গল এরিয়া। অনেক গুলো জঙ্গল একসঙ্গে সেরে নিতে পারবেন। কুভোসি থেকে ৬০ কিমি দূরে ডানডেলি ফরেস্ট। বিমানে গেলে দিল্লি -বেলাগাম। রোজই ছেড়ে। বেলাগাম থেকে কুভোসি ১০৭ কিমি দূর। ক্যাব নিতে পারেন। গোয়া -মারগাওঁ রেলপথেও ডানডেলি ফরেস্ট পৌঁছাতে পারেন। ট্রেন আছে নামতে হবে বেলাগাম স্টেশনে। লাগবে তিন ঘন্টা। ওখান থেকে ও ক্যাবে ৩৬ কিমি রাস্তা কুভোসি পৌঁছাতে পারেন। সেখান থেকে পাবেন ডানডেলি যাওয়ার সুমো, মারুতি, জিপসি। ৬০ কিমি। আড়াই তিন ঘন্টা সময় নেবে। আমি গোয়া -মারগাঁও ট্রেন পথে এসেছিলাম।
কোথায় থাকবেন :থাকার জন্য কুভোসিতে পাবেন রিভার উড (৩০০০/-), জঙ্গল নেস্ট (২০০০/-), স্টেট লন (৮০০/-) খাওয়ার জন্য আলাদা চার্জ। বেশিটাই সাউথ ইন্ডিয়ান খাওয়ার। প্রতিদিন ৩০০-৩৫০ টাকা খরচ পড়ে।
কুভোসি থেকে ডানডেলিতে থাকা -খাওয়া খরচ অনেকটাই কম। থাকার জন্য প্রায় ১৬ টা হোটেল, রিসোর্ট আছে। ভাড়া ৬০০-১৮০০ টাকার মধ্যে, তবে মুর্গা মটনের চান্স নেই। পুরো নিরামিষ। ডানডেলি শহর থেকে গিয়ে আমি দুদিন ডিম এনেছিলাম। নিরামিষ তখন আর মুখের রুচিতে নিচ্ছিলো না।
কুভোসিতে একটা অসাধারণ ব্রিজ করেছে কর্ণাটক সরকার। জঙ্গলের ভিতরে গাছের গায়ে গায়ে একটা ঝুলন্ত সেতু। ৩০ ফুট জঙ্গলের মাটি থেকে উঁচু আর লম্বা প্রায় ২৪০ মিটার। প্রচুর পর্যটক যাচ্ছে। বন দফতর থেকে আমায় বলল, ” ভারতের প্রথম ক্যানোপি”। আমি বললাম, লোলেগাঁওতে আজ থেকে ৩০ বছর আগেই হয়ে গিয়েছে এই জিনিস। এটা মোডিফায়েড, লোলেগাঁওতে এতটা আধুনিক নয়। রাতে থেকে গেলাম কুভোসি। এখানে ক্যানোপি দেখতে বেরিয়ে পড়লাম সকাল সকাল সকাল। ডানডেলি আমার গন্তব্য। সকালেই ক্যানোপিতে। ৩০ ফুট উঁচু মানে সত্যি বেশ উঁচু আর জঙ্গলের নিচে চাইলে বেশ রোমাঞ্চ বোধ হয়। সঙ্গী ফরেস্ট অফিসার জানালেন, “এখানে পাখি আর প্রজাপতির মেলা বসে যায়। তবে, সেটা বর্ষায় বেশি। আর বসন্ত কালে ফুলে ফুলে কোর যায় জঙ্গল, একবার বসন্ত কালে আসুন, দেখবেন ক্যানোপির মজাই বদলে যায় “। নিচে তখন দুটো বাইসন চড়ছিল। আমরা এখন ঠিক ক্যানোপির মাঝখানে। শেষের দিকে আসতেই চমকে গেলাম অবিরাম শব্দে। দুরন্ত ছবির মতো একটা ঝর্ণা পড়ছে ক্যানোপির সামনেই। নদীর নাম কালী।
ডানডেলির জঙ্গলের এসে পৌঁছেছি। এখন বেলা তিনটে। দুপুরের আহার সারলাম। সাম্বার, ভাতে। চারিদিকে গভীর জঙ্গল। ব্যাগ, জিনিস পত্র রেখে জঙ্গলের দিকে বেরিয়ে পড়লাম যখন, তখন প্রায় সাড়ে তিনটে। এখন হালকা শীত। রাতে বাড়বে। কোথাও একটা পাখি ডাকছে। সম্ভবত ধনেশ। এখানে ধনেশ পাখির আস্তানা বলতে পারেন। রকমারি ধনেশে ডানডেলির জঙ্গল সমৃদ্ধ। জঙ্গল বয়ে আনছে সন্ধে। ফলে পাখিরা ঘরে ফিরছে। দু চারজন গ্রামবাসী ফিরছে ঘরের টানে। আমাকেও ফিরতে হবে। আমি কারও সঙ্গে কথা বলিনি, কারণ, আমি কন্নর আমি জানি না। সাহসও পাইনি কথা বলার। রাতে কেয়ারটেকার কাম বনরক্ষী বলল, “আপনি চিতার সন্ধানে এসেছেন বটে, তবে নিরানব্বই শতাংশ চান্স না পাওয়ার। ঘরের দেওয়ালে একটা কালো চিতার ছবি। চোখ দুটো হলুদ। ঝকঝক করছে। রাতে সম্বর আর রুটি খেয়ে ঘুম।
এবার থেকে রোজই বেরোচ্ছি সকালে আর ফিরছি রাতে। সঙ্গে রোজ পরোটা, একটা সবজি নিয়ে। রাতে ফিরছি। জঙ্গলে ছানবিন মারছি। বনরক্ষী এন্টোনি রোজই আমার সঙ্গে। আটদিনের ভাড়া পড়লো ৯৫০০ টাকা। রোজই কোর এরিয়ায়। মানে আমরা যেখানে আছি তার থেকে বাইশ কিমি ভিতরে। জঙ্গলের সেফ জায়গায় খেয়েছি। জিপে উঠেছি, ঘুরেছি ক্যামেরা বাগিয়ে। জন্তু জানোয়ার বলতে হরিণ, হাতি, ভাল্লুক, সম্বর, শিয়াল পেয়েছি। ফুল রবার গাছ। এখানে আংশি আর ডানডেলি দুটো জঙ্গল একসঙ্গে। ১৩৬৫ স্কোয়ার কিমির জঙ্গল। কুলগি, গুন্দ, ফাসোই, অংসি নিয়ে মোট জঙ্গল। ডানডেলি সীমানা দীর্ঘ। এন্টোনি বললেন “বিগত কয়েক বছর ধরে ইয়ং জেনারেশন জঙ্গলের ভিতর এসে প্লাস্টিক আবর্জনায় ভর্তি করে রাখছিলো। দূষণ বাড়ছিল ক্রমাগত। সরকার খুব কড়া হাতে দমন করছে এখন “। বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। জঙ্গল বাড়ছে। প্রায় ৪৮৩৭ জনের বাস এই জঙ্গলের মধ্যে। এখানে সবথেকে বড় অসুবিধা এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে গোটা চারেক বাণিজ্য পথ। বান্নাবাসবেশ্বর মন্দির ও এই করে এরিয়াতে ফলে প্রচুর ভক্তের সমাগম জীবজন্তুদের অসুবিধায় পড়তে হয়”। চলুন আমরা অংসির দিকে যাই। চিতা গুলো কালো কেন? বলল, ব্ল্যাক পিগমেন্ট মেলানিন থাকার কারণে এই চিতা গুলো কালোই। তবে, এরা কিন্তু হলুদের সঙ্গেই প্রজনন করে। চিতার প্রজনন কমে যাচ্ছে, কারণ চিতার কোনো স্ত্রী চিতাকে পছন্দই হয় না। পছন্দ হলে একসঙ্গে দুজন চিতা একজনকে ভাগ্য করে নিতেও রাজি থাকে।
রোজই বের হই। রোজই জঙ্গলের গন্ধ মেখে হোটেলে ফিরি। বেশ লাগে। এর মধ্যে একদিন ঝিরঝিরে বৃষ্টিও পেলাম। বেশ ঠান্ডা। তখন জঙ্গলের ভিতরেই. সেটা অষ্টম দিন। জঙ্গলের ভিতরে একটা ঝাঁকড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে। দূরে কালী নদীতে ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি পড়ছে জলের উপর। এন্টোনি বলছিলো ও নাকি জঙ্গলের মধ্যেই পড়ে থাকে। প্রচুর ছবি ওর স্টকে। সরকারও ওকে খুব মানে। ওর ছবি দিয়েই সরকারি ব্রোসিওর তৈরী হয়। নেটে হোয়াটসাপে প্রচুর প্রশংসা পেয়েছে ও। “এই দেখুন ক্যামেরা “, বলে ওর জঙ্গল পিট্টু থেকে ক্যামেরাটা বের করলো। প্লাস্টিকে মোড়া। আমরা গাছের গুঁড়িতে বসে খাওয়ার আয়োজন করছি। গাছের উপরে থাকা ধনেশটা চিৎকার করে উঠলো…. ক্যাঁ এ এ এ এ। সামনের রাস্তাটার উপর দু চারটে হরিণ। তখনই কালো চিতাটা সামনের জঙ্গলের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আসছিলো। হনুমানের চিৎকারে চিতাটা তাকালো উপরে. তারপর ছুটলো বুলেটের গতিতে। হরিণ উধাও। আমরা দেখলাম কালো ঝড় বয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির ভিতর দিয়ে। যতদূর চোখ যায় পুরো ফাঁকা রাস্তায় কালো স্বপ্ন। ক্যামেরা নীরব….। কালো চিতার ফোটোগ্রাফস… মনে গেঁথে গেল কালো রহস্যের মতোই…..।