অ্যাথলেটিক্স, ফুটবল, ক্রিকেট—তিনটি খেলাতেই সমান দক্ষ। তিনটি খেলাতেই জাতীয় আসরে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। অ্যাথলেটিক্সে ভারতের হয়ে অংশ নিয়েছেন আন্তর্জাতিক আসরেও। বয়স ২৯ হয়ে গেলেও চারিদিকে হন্যে হয়ে ঘুরেও চাকরি মেলেনি। মানে ওঁর এই সাফল্যগুলো কোনও গুরুত্ব পায়নি। ওঁর ঘনিষ্ঠদের অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, দৃষ্টিহীন হওয়ার জন্যই কি বৈষম্য? স্বাভাবিক ক্যাটেগরিতে যদি কোনও খেলোয়াড় এরকম সাফল্য পেতেন তাঁকে কি এতদিন বেকার থাকতে হত? বাংলার এই দৃষ্টিহীন তারকা খেলোয়াড় সাহেব হুসেন নিজেও এখন অনেকটা দিশেহারা। সাহেবেরও প্রশ্ন, ‘বেকার তকমা নিয়েই কি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে?’
করোনার প্রভাব খেলার মাঠে সবার ওপরই কমবেশি পড়েছে। অনেকে আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত। আবার অনেকে মানসিক দিক দিয়ে বিধ্বস্ত। সাহেব হুসেনের ক্ষেত্রে এই দুটোই সমানভাবে সত্যি। ভাটপাড়ায় রিলায়েন্স জুট মিলের কোয়ার্টার্সে দিদি-জামাইবাবুর কাছে থাকেন সাহেব। জামাইবাবু ওই জুটমিলের কর্মী। তাঁর আয়েই চলে পাঁচজনের সংসার। লকডাউনের প্রথম তিন মাস জুট মিল বন্ধ ছিল। ওই তিন মাসের মাইনেও পাননি। এখন আবার কাজে যোগ দিয়েছেন। সাহেব বললেন, ‘ভীষণ খারাপ অবস্থায় আছি। ওই তিন মাস তো আরও খারাপ অবস্থা গেছে। রেশনের চালটা পাওয়ায় পুরোপুরি না খেয়ে থাকতে হয়নি।’
ফুটবল, ক্রিকেট খেললেও সাহেবের প্রথম পছন্দ অ্যাথলেটিক্স। ২০০৪ সালে কাঁকিনাড়া নারায়ণপুর ইউনাইটেড ক্লাবে অ্যাথলেটিক্স শুরু কোচ গোলক মণ্ডলের কাছে। এখনও ওখানেই প্রশিক্ষণ নেন। জন্ম থেকেই ওঁর দৃষ্টি-ক্ষমতা কম। ৭৫ শতাংশ দৃষ্টিহীন। সাহেবকে দৃষ্টিহীনদের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয় ‘বি ১২’ গ্রুপে। আর প্যারা অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ‘টি ১২’ গ্রুপে। ভারতের প্যারা অ্যাথলেটিক্সে দৃষ্টিহীন খেলোয়াড়দের মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতে আছেন সাহেব। ২০১৬ সালে হরিয়ানায় জাতীয় আসরে ১০০ (১১.৩২ সেকেন্ড), ২০০ (২২.৪৫ সেকেন্ড) ও ৪০০ (৫৩.৩৬ সেকেন্ড) মিটার দৌড়ে রেকর্ড গড়েছিলেন। যা এখনও অক্ষত। ২০০ মিটার দৌড়ে ওঁর জীবনের সেরা সময় (২২.২৬ সেকেন্ড) অবশ্য ২০১৮ সালে দুবাইয়ে প্যারা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে। সেখানে চতুর্থ হয়েছিলেন।
জাতীয় আসরে অ্যাথলেটিক্সে অজস্র পদকজয়ী সাহেব হুসেন দৃষ্টিহীনদের জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় বাংলার হয়ে খেলেছেন ২০১৮ সালে, কেরলে। ফুটবলে সাহেব গোলকিপার। দৃষ্টিহীনদের জাতীয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনবার। ২০১৭ (দিল্লি), ২০১৮ (হায়দরাবাদ) ও ২০১৯ (মধ্যপ্রদেশ) সালে। ক্রিকেটে সাহেব অলরাউন্ডার। মাঠের টানে প্রতিদিনই নারায়ণপুর ইউনাইটেড ক্লাবে ছুটে যান। ওটা যেন গভীর নেশা। কিন্তু লকডাউনের জেরে আটকে পড়েছেন ঘরে। এখন আর যাওয়া হচ্ছে না ক্লাবে। সাহেব বললেন, ‘চারিদিকে যেভাবে করোনা ছড়াচ্ছে, ভীষণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। আমাদের এই অঞ্চলটা ঘিঞ্জি। তাই ঘর থেকে বের হয়ে কোনও ঝুঁকি নিচ্ছি না। ঘরের মধ্যেই এক্সারসাইজ করে ফিটনেস ধরে রাখার চেষ্টা করছি। অনেক কম্পিটিশনই এবার মিস করলাম। এখনও বাতিল না করায়, আশায় আছি যদি ডিসেম্বরে প্যারা অ্যথলেটিক্সের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপটা হয়!’