ইলিশ মাছের সাতকাহন – আহেলী দাস

0
50

বাঙালি জীবনের অনবদ্য অঙ্গ হচ্ছে মাছ। এটি ছাড়া বাঙালিরা বিশেষত চোখে অন্ধকার দেখে। পেটের রোগ থেকে মনের রোগ বাঙ্গালির সব রোগেরই অব্যর্থ দাবাই হচ্ছে মাছ। বর্ষাকাল। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর কাদার অনাসৃষ্টি। সেই কবে কোন যুগে কবি সত্যেন দত্ত বলে গেছেন-“হাল্কা হাওয়ায় মেঘের ছায়ায়ইলশে গুঁড়ির নাচইলশে গুঁড়ির নাচন দেখেনাচছে ইলিশ মাছ”।
অতিবৃষ্টি হোক বা করোনার অনাসৃষ্টি প্রকৃতির সৃষ্টি ইলিশ আসে, ফিরে ফিরে আসে। হয়তো প্রকৃতির টানেই আসে। এই রূপোলী শস্য নিয়ে গল্পকথার কোনো অন্ত নেই। মধ্যযুগের ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর থেকে আধুনিক যুগের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা রবীন্দ্রোত্তর যুগের সৈয়দ মুজতবা আলি প্রমুখের লেখনীতে ফুটে উঠেছে ইলিশ প্রেমের কথা।ইলিশ মাছ একটি “মাইগ্রেটারী ফিশ”। এই কথাটি ল্যাটিন শব্দ “মাইগ্রের” থেকে এসেছে যার অর্থ ভ্রমণ। ইলিশ ভ্রমণপ্রিয় মাছ। এই কান্ডকারখানা অনেকটা পিত্রালয়ে ফেরার মত। বছরে দুইবার শীত এবং বর্ষাকালে সন্তানের জন্ম দিতে ইলিশকে আসতে হয় তার পিত্রালয়ে অর্থাৎ নদীতে। একসাথে দল বেঁধে যখন ইলিশ যখন সমুদ্র থেকে নদীতে প্রবেশ করে তখন তাকে বলে অ্যানাড্রোমাস পরিযান। গঙ্গা থুড়ি পদ্মা, রূপনারায়ণ, ব্রহ্মপুত্র, গোদাবরী, নর্মদা, তাপ্তি, ইরাবতী, সিন্ধু সবেতেই প্রতি বছর সাগর উজিয়ে ইলিশ আসে কমবেশি। দ্বাদশ শতাব্দীতে বিখ্যাত লেখক জীমূতবাহন তাঁর “কালবিবেক” গ্রন্থে সর্বপ্রথম মাছটির নাম দিয়েছিলেন “ইলিশ”। তবে গঙ্গা-পদ্মা নদীতে যে ইলিশ পাওয়া যায় তার নাম “ইলিশ” হলেও স্থান-নদী ভেদে নাম ও স্বাদও বদলায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মৎস্যবিজ্ঞানী হামিলটন মাছটির বিজ্ঞানসম্মত নাম দেন “হিলশা-হিলশা”। পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে এই মাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম রাখা হয় ‘টেনুয়ালোসা হিলশা’। সৈয়দ মুজতবা আলির লেখা “পঞ্চতন্ত্র”-এ পাওয়া যায় যে নর্মদার ইলিশ ‘মাদার’, তেলেগু ভাষায় ইলিশকে পোলাসা, তামিলরা ইলিশকে ‘উলম’, গুজরাটে ইলিশ মাছ মোদেন (স্ত্রী) বা পালভা (পুরুষ) এবং পাকিস্তানে পাল্লু নামে পরিচিত। এগুলি ছাড়াও খাস বাংলাতে ইলিশের অনেক নাম খয়রা ইলিশ, গৌরি ইলিশ, চন্দনা ইলিশ, সকড়ি ইলিশ, ফ্যাসা ইলিশ, জাটকা ইলিশ ইত্যাদি পুব বাংলায় বিল থেকে পাওয়া ইলিশ বিলিশ নামে ডাকা হয়। সমুদ্রে থাকার সময় ইলিশ ছোট এবং কম স্বাদযুক্ত হয়। মিষ্টিজলে ঢোকার পর নীল-সবুজ শ্যাওলা, রেটিফারের মত নদীর জলে মিশে থাকা খাবার থেকে পুষ্টি পায় যার ফলে ইলিশ হয়ে ওঠে স্বাদেগন্ধে অতুলনীয়। দূষণের প্রভাবে স্বাদ কমলেও এই বছর লকডাউনের ফলে নদীর জলের মান বেড়েছে এবং এই বছর ইলিশেরও স্বাদ বাড়বে বলেই মত মৎস্যবিজ্ঞানীদের। বর্তমানে সাময়িক লকডাউনের ফলে নদীর জলের মান বাড়লেও ইলিশ মাছ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। গঙ্গাতে উল্লেখযোগ্যহারে ইলিশ কমেছে। প্রশাসনের উদাসীনতা এবং চাহিদাবৃদ্ধির দরুণ মাছ ব্যবসায়ীরা যথেচ্ছ হারে ৫০০ গ্রামের কম বা খোকা ইলিশ শিকার করছেন যার ফলস্বরূপ বড় ইলিশের জোগানে টান পড়ে তেমনই বংশবিস্তারও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বছরের পর বছর এরকম চলার ফলে গঙ্গার ভাগীরথী শাখায় ইলিশ জোগান কমছে। আরো একটি কারণ হচ্ছে হুগলী এবং রূপনারায়ণ নদীতে পলি জমে গভীরতা কমে যাওয়ার ফলে ধীরে ধীরে ইলিশ-শূন্য হয়ে পড়ছে অঞ্চলগুলি। অন্যদিকে পাকিস্থানেও সিন্ধুনদের গভীরতা কমে যাওয়ার ফলে ইলিশ সেখানে প্রায় বিলুপ্ত। বাংলাদেশ, মায়ানমার ইত্যাদি দেশে প্রশাসনের কঠোর নীতির ফলে ইলিশের পরিমাণ সদর্থক। দুঃখের বিষয় এই যে চাহিদা মেটাতে ভারতকে বাংলাদেশ ও মায়ানমার থেকে ইলিশ আমাদানি করতে হয়। এখনও সময় থাকতে কঠোর নীতি-নিয়ম তৈরি করে ইলিশকে বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে হবে। নয়তো ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষিত ইলিশ এবং ইলিশের ছবি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here